Published : 01 May 2025, 09:07 AM
সরদার ফজলুল করিম [১৯২৫-২০১৪] ছিলেন শিক্ষক, রাজনৈতিক চিন্তক ও সংগঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা এবং পরিচিতি হলেও মূলত তিনি ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের শিক্ষক। যাতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিচিতির প্রয়োজন হয় না। কেউ কেউ মনে করেন তিনি সকলের মতোই সাধারণ একজন শিক্ষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কারণ সকল শিক্ষকের মতো যেভাবে পদোন্নতি, মর্যাদা অর্জিত হয়, তা তাঁর জীবনে ঘটেনি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন গুরু-শিষ্য দু-জনেই; জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও সরদার ফজলুল করিম। স্মরণীয় তাঁরা উভয়েই প্রথাগত শিক্ষক ছিলেন না।
বস্তুত তাঁর সমকালে অন্য শিক্ষকদের তুলনায় সরদার ফজলুল করিম ছিলেন ব্যতিক্রম। অবশ্য কারও সাথে কোনো তুলনা চলে না। তবে তিনি ছিলেন এসব প্রচলিত, সাধারণ চিন্তার উর্ধ্বে। সরদার যেভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ, জাতির মুক্তির জন্য, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ব্যক্তি জীবনের উন্নয়নে কোনো ধরনের প্রাপ্তি তাঁকে আন্দোলিত করতে পারেনি। কোনও আমন্ত্রণেই সাড়া দেননি তিনি। বিদেশি বৃত্তি, ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার গঠন, প্রমোশন ইত্যাদি সকল সুযোগের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোনোটাই গ্রহণ করেননি। এ যেন সাধারণ মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত এক তপস্যা। ব্যক্তিগত জীবনে নীরব আবার সামষ্টিকভাবে সরব থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী ভূমিকা রাখতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ফলে কয়েকদিন পরপর কারাবাস ছিল তাঁর জন্য যেন নির্ধারিত নিয়তি। এ সূত্রে এগারো বছর কারাগারেই কাটিয়েছেন তিনি।
এ-কারাগার যাপনের কারণ তৈরি হয়েছে তাঁর কিশোর-তরুণ বয়সে। বরিশালে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী থাকাকালে বন্ধু ও শিক্ষকদের সান্নিধ্যে তিনি রাজনীতি-সংবেদক ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। সেকালে শিক্ষক-বিপ্লবীদের উৎসাহ-সান্নিধ্য তাঁকে বিপ্লবী রাজনীতি এবং পঠনপাঠনে প্রণোদিত করে। সেভাবে তিনি বইপত্র পাঠ শুরু করেন। একইসাথে তিনি ওই বয়সেই অন্তরে বপন করেন সমাজরূপান্তরের স্বপ্ন। তিনি কী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন, তা শুনেও আমাদের ভেতরে একটা ঝাঁকুনি হয়। তিনি কোনো এক সময় বলেছেন, বরিশালের লঞ্চ/জাহাজঘাটের শ্রমিক হওয়া ছিল তাঁর স্বপ্ন। কেন এমন লক্ষ্য তিনি স্থির করেছেন তখন? নিছক তামাশা করেই কী। মূলত তাঁর জন্ম গ্রামে ও কৃষক পরিবারে। তিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন ‘বরিশারের কৃষক পোলা’। কারণ এই বঞ্চিত, শোষিত জীবন পর্যবেক্ষণে তাঁর ক্ষুব্ধতা ও প্রতিক্রিয়া ছিল। ফলে এসব চিরায়ত বৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিক ও কৃষকবান্ধব এক জীবন কামনা করেছেন। সে হিসেবে কৃষকজীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে তিনি জেনে নিয়েছেন পরিবার ও পারিপার্শ্বিকতা থেকেই। সেদিক থেকে তিনি নিপীড়িত ও বঞ্চিত জীবনের মুক্তি কামনায় তাঁর জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন। অতএব তাঁর পক্ষে কৃষক ও শ্রমিক হওয়ার বাসনা প্রকাশ করাই স্বাভাবিক। আবার তিনি ছিলেন আজীবন শিক্ষক। এ শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত থেকেও সার্বিকভাবে মানুষের মুক্তির লক্ষে যা কিছু প্রয়োজন, তিনি তা করেছেন। লক্ষণীয়, তিনি সাংগঠনিক কাজ করতে করতে শিক্ষক হয়েছেন আবার সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে শিক্ষকতায় বিরতি দিয়েছেন।
১৯৪০ সালে মেট্রিক পাশের পর তিনি ঢাকা চলে আসেন। স্মরণীয়, বরিশালে অবস্থানকালেই তিনি বামপন্থার প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রথমদিকে ঢাকা ছিল তাঁর কাছে বিস্ময়কর এক স্থান। তখন তাঁর কাছে ঢাকা শহরের অনিবার্য অনুষঙ্গ সদরঘাট, ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মূলত ওই ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। তবে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। প্রথমত ঢাকায় প্রবেশের পর তিনি দেখেছেন প্রগতিশীল লেখক শিল্পী সোমেন চন্দের হত্যাকাণ্ড। উল্লেখ্য যে, মুসলিম লীগ সমর্থিত আততায়ী সোমেন চন্দকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এ বিষয়টি তাঁর অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করে। দ্বিতীয়ত তিনি অবলোকন করেছেন উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষ। উল্লেখ্য যে, সে সময় দাঙ্গাবিরোধী কাজ এবং মন্বন্তরে আক্রান্ত মানুষ উদ্ধারে সক্রিয় অংশগ্রহণে তাঁর মনোজগতে ঘটে ব্যাপক পরিবর্তন। বস্তুত পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর সীমাহীন দুর্বলতা তাঁকে পরোক্ষভাবে বিপ্লবী হতে প্রেরণা জোগায়। একইসাথে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মারণান্তিক পরিণাম। এসব বিক্ষুব্ধতার ভেতর রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি গভীরভাবে উপলব্ধির জন্য তিনি তরুণ বয়সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। বিপ্লবী দৃঢ়তার কারণেই তিনি ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন। তৎকালীন রাষ্ট্রীয় নিবর্তনের সামূহিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি ১৯৪৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকতার চাকরি ত্যাগ করেন; এবং পার্টির সিদ্ধান্তেই আন্ডাউরগ্রাউন্ডে চলে যান। বলাবাহুল্য যে, তখন কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ ছিল না। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা অবস্থায়ই তিনি গ্রেফতার হন। স্মরণীয় তিনি কারাগারে থেকেই গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। যা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুমুল প্রতিক্রিয়া হয়। এ বর্ণিল জীবনের মধ্যে তিনি বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করেন।
তাঁর এ জীবন পূর্ণরূপে ব্যয় করেছেন শিক্ষা ও সাধারণ মানুষের মুক্তি সংগ্রামে। কোনো লোভনীয় পদবি ও প্রতিষ্ঠার বাসনা তাঁকে বিচ্যুত করতে পারেনি। এ-ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ জীবনের পরিসরে তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা এবং অনুবাদ করেছেন। অনুবাদকর্মের মধ্যে রয়েছে অ্যারিস্টটল, প্লেটো, রুশো, এঙ্গেলসের রচনা। তাঁর দর্শনকোষ-এর মতো সহজ সাবলীল গ্রন্থের বিকল্প এখনো আমরা পাইনি। এছাড়াও তাঁর রচিত স্মৃতিভাষ্য ও বিভিন্ন পর্বের দিনলিপি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের আকরগ্রন্থ। একইসাথে তাঁর পঠনপাঠন আমাদের বিস্মিত করে। বাংলাদেশের পরিবর্তন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হওয়ার ক্রম-ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা সকল সময় করে থাকি আমরা। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি, বিশেষত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন বিষয়ক বিশ্লেষণ উল্লেখযোগ্য। এসব ঘটনাবলির মধ্যে সম্পর্কসূত্র রচনা করতে যদি ঐতিহাসিক বিবর্তনের পর্বগুলো আলোচনা করি, তা হলে সরদার ফজলুল করিমের লেখা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। বস্তুত এসব আলোচনায় নানা কারণে বিলোপনের তাড়া কাজ করে। যে তাড়নায় চল্লিশের দশক অনেক সময় উহ্য থেকে যায়। যেক্ষেত্রে তাঁর রচনা ওই বিলোপনের ফাঁকটি পূরণ করে দেয়।
লক্ষণীয় এ-উপমহাদেশে আন্দোলন, সংগ্রাম, রাজনীতি ও আদর্শে পূর্বাপর বহমানতা বা কনসিসটেনসির উদাহরণ খুব কম। একইসাথে ব্যক্তির নিষ্ঠতা ও দৃঢ়তার অভাব দৃশ্যমান; ফলে চলতে চলতে মানুষ থমকে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে চলার পথে পথ বেঁকে যায় বলে সাধারণ মানুষ আহত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এসব বৈশিষ্ট্য অনিবার্যভাবে এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিশাল এক ক্ষত। অর্থাৎ এক জীবনে বিপ্লবী হলেও আবার প্রত্যেকেই শেষ জীবনে এসে আত্মসমর্পিত হন। তখন তাঁরা তরুণ ও যৌবনে ধারণকৃত আদর্শচর্চাকে ভুল বলে হিসাব মেলান এবং হয়ে উঠেন ক্ষমাপ্রার্থী। অর্থাৎ একটি আদর্শ জীবনব্যাপী ধারণ ও সেই পথে ক্রম-নিয়োজিত-সক্রিয় থাকা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে সরদার ফজলুল করিম যে আদর্শকে গ্রহণ করেছেন তরুণ বয়সে, সেই আদর্শে অবিচল ও নিষ্ঠাবান থেকেছেন আজীবন। এ উদাহরণ আমাদের দেশে অত্যন্ত বিরল। এর অলোকে তাঁর ‘মানুষ’ ভাবনা আমাদের মুগ্ধ রাখে ও আন্দোলিত করে। আবার তাঁর দৃষ্টিতে যা কিছু ন্যায়সঙ্গত নয়, সেসব ক্ষেত্রে তিনি কখনোই নিজেকে জড়াতেন না; এবং আপোসও করেননি। স্পষ্টত জীবনের শুরু থেকে যে আদর্শ গ্রহণ করেছেন, এর প্রতি আজীবন আস্থাবান ছিলেন। যে যে স্থানে তিনি কাজ করেছেন, এমনকি শিক্ষকতায়ও সেসব স্থানেও আদর্শনিষ্ঠার ধারাবাহিকতা ছিল। এ অবস্থায় তাঁর জীবনাদর্শের সাথে অন্য কোনো জীবনের তুলনা করা সমীচীন নয়। জ্ঞানবিদ্যার প্রতি ছিল তাঁর অসামান্য ঝোঁক। ফলে কোনো কুতর্কে না জড়িয়ে সমস্যা সমাধানে সকলকে বিবর্তন, মানবসভ্যতার ইতিহাসের পাঠ গ্রহণে সুপারিশ করতেন। বলা যায় এটি তাঁর শিক্ষকতা পেশার মূল স্তম্ভ। তাঁর লক্ষ্য ছিল জীবন বদলানো ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। যেখানে স্থিত থাকাই জীবন নয়।
যে কোনো পরিস্থিতিতে তিনি কখনোই হতাশ হতেন না। ফলত জীবন ও কর্মের প্রতি তাঁর অসামান্য নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধ লক্ষ করি। নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে গ্লাসনস্ত- পেরেস্ত্রোইকার কথা। এর ফলে তাঁর সক্রিয় থাকা অবস্থায়ই ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন। অধিকাংশ লোকই তখন বলতে থাকে যে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে, ভবিষ্যতে এর কোনো প্রয়োজন হবে না। এ-অবস্থায়ও তাঁর চিন্তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কারণ তিনি মার্কসবাদকে নিছক তত্ত্ব বা ডগমা হিসেবে গ্রহণ করেননি। জগৎ ও জীবন উপলব্ধির একটি পথ এবং সূত্র হিসেবে তিনি তা গ্রহণ করেছেন। জীবন সাধনা ও রূপান্তরের উপায় হিসেবেও ভেবেছেন। যে কারণে তিনি নিজেও বলতেন মার্কসবাদ স্থিতধি কোনো বিষয় নয়। ঐতিহাসিক বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি এমন ভাবতেন। এ ছাড়াও তিনি মার্কসবাদকে গ্রহণ করেছেন বাস্তব অবস্থা ও স্থানিক পরিবেশের আলোকে। আমরা যাকে লোকেলাইজেশন বলে থাকি। যে কারণে তাঁর মার্কসবাদ চর্চা ছিল পার্টির প্রচলিত ব্যাখ্যা বা তত্ত্বীয় মার্কসবাদচর্চা থেকে দূরবর্তী। তিনি বলেছেন, ‘‘চিন্তার যে বিকাশ এ পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছে, তাতে ‘মার্ক্সবাদ’ শব্দের ব্যবহার এখন আর তত জরুরি নয়। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বললেই বস্তুবাদের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।’’
তত্ত্ব যাই থাক, সবকিছুর চেয়ে এগিয়ে থাকে জীবন ও মানুষ। ফলত সরদার ফজলুল করিম সবসময় জীবনের জয়গান করেছেন। তিনি শিক্ষকতা পেশায় ফিরেছিলেন বটে, তবে প্রথাগত শিক্ষক হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেননি। অনেকেই বলে থাকেন যে, সরদার কী ভূমিকার জন্য সমাজে স্মরণীয় বা বরণীয় হতে পারেন। এমন প্রশ্ন তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক; কারণ তিনি তো সকলের মতো ছিলেন না। বস্তুত তিনি রাজনীতি ও দর্শনচর্চা করেছেন সাধারণ মানুষের জন্য। তিনি নিজেও বলেছেন দর্শন ছাড়া মানুষ হয় না। যখন যা করেছেন, ওই মানুষ ভাবনাকে কেন্দ্র করেই সব আবর্তিত হয়েছে। তিনি নিজেও বহুবার বলেছেন ‘আমি কৃষকের পোলা’। আমরা যা বলেছি, তাঁর চিন্তা বা সাংগঠনিক ক্রিয়াকর্মের কেন্দ্রে সকল সময়ই ওই ‘মানুষ’ ভাবনা। সবকিছুর কেন্দ্র ‘মানুষ’ হওয়ার ফলে জীবনের সম্ভাবনার প্রতি তাঁর নজর ও আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। তাঁর ভাষায়-- ‘‘মানুষ’ শব্দটি রাম-রহিম-করিমকে অতিক্রম করেই মানুষ। তেমন মানুষের সচেতন-অচেতন আত্মপাঠ এবং বিশ্লেষণের কোনো শেষ নেই। সেই আত্মপাঠ আর আত্মবিশ্লেষণেই তার মৃত্যুহীন প্রাণ। ...’’
যে কোনো সংকট, বিপর্যয়ের কালেও হতাশা প্রকাশ করেননি সরদার। কারণ জীবনের প্রতি ছিল তাঁর অসামান্য শ্রদ্ধাবোধ। জীবনের মানে বা অর্থ খোঁজ করতে নানা দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে বিদ্যমান। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন তত্ত্বকথাও হাজির করেন। বিশেষত মৃত্যু নিয়ে অনেকের ভিন্ন কথা রয়েছে। যা কিছু তত্ত্ব কথা, বিশ্লেষণ থাক না কেন মানুষ ও প্রাণিজগতের সকলেরই মৃত্যু অনিবার্য। ফলে এর মাঝে হতাশা, অনর্থকতার বয়ান থাকাই স্বাভাবিক। আবার মৃত্যু না থাকলে জীবনেরও কোনো মানে থাকে না। যে কারণে সরদার ফজলুল করিম সহজ কথায় এ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা হলো, ‘জীবন এবং মৃত্যু পরস্পর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত। তবু মৃত্যুহীন আশাবাদী প্রাণী হিসেবে আমাদের এই প্রত্যয়টিকে ধারণ করতে হবে; জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্বে জীবনেরই জয় হয়। মৃত্যুর নয়। জীবনের নবজন্ম লাভ হয়, মৃত্যুর মৃত্যু ঘটে’। আবার আমরা তো এ প্রকৃতির মাঝেই মানুষ হয়ে উঠি। এ ছাড়াও বিভিন্ন জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি এ প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা কিনা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। যেমন, ‘জীবনকে বুঝতে হলে মৃত্যুকেও বোঝার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ... জীবন কখনো মরে না। ... আমি কোনো একলা আমি নই। আমার পরিবার, বন্ধুজনা, পারিপার্শ্বিক তোমরা সব মিলিয়ে আমি। আমি হচ্ছি সমাজের আমি। আমি শুধু মানুষের সমাজের স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি’।
এর আলোকে তিনি প্রকৃতির সাথে বোঝাপড়া ও সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে জীবনের সার্থকতা বিবেচনা করতে বলেছেন। কেননা আমাদের জীবনকে যাপনের জন্য এ প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। তাঁর ভাষায় প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আমরা আর মানুষ থাকবো না। তাঁর কথা থেকে আমরা জানি, জীবন মৃত্যুর পরিসরে মানুষ হিসেবে জন্ম হলেও মানুষ হয়ে উঠতে হয়। অবশেষে মানুষ তো সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তা। ফলে সাধনার দ্বারাই মানুষ হতে হয়। কারণ এখনও মানুষের মন থেকে হিংসা দূর হয়নি, সৃজনশীল হওয়া সত্ত্বেও স্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারেনি মানুষ। মানবসভ্যতাকে ঠিক সভ্যতার বিপরীত খাদে ফেলে দিয়েছে মানুষই। বস্তুত শ্রেণিগত বৈষম্য, সম্প্রদায়, জাতি, বর্ণ, গোত্র, গোষ্ঠীগত বিবেচনা তাঁর মধ্যে কখনোই ছিল না। এসব বিষয়ে কোনো সমস্যা বা প্রশ্ন উপস্থিত হলে তিনি বলতেন-- ‘আমি মানুষ’। ফলত তিনি প্রায়ই বলতেন ‘আমি তো এখনও মানুষ হতে পারিনি’। তবে অবিচল সাধনা, নিষ্ঠার ভেতর দিয়ে মানুষ হয়ে উঠেছেন বলেই তিনি অনন্য, সরদার ফজলুল করিম। মানুষ হওয়ার পথেই তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন।