Published : 21 Aug 2011, 05:02 PM
১. পূর্ণিমা…?
শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা লাগবার আগে থেকেই বৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। ঢাকা শহরে বসে পূর্ণিমার কথা মাথায় আসার কথা নয়। কিন্তু এই শ্রাবণে মাথায় এসেছিল। ঢাকা শহরের বিশাল এক দালানের মাথায় চাঁদ আটকে গিয়েছিল দেখে ভড়কে গিয়েছিলাম। ভাল করে খেয়াল করে মনে
…….
রানওয়ে ছবির শুটিং এর ফাঁকে সিলেটে তারেক মাসুদ, ২০১০-এ
…….
হোল ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে বহু নিচের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে হারামজাদা। ভয়ডর নাই। ডর লাগছিল যদি অত উপর থেকে আবার পড়ে যায়। মরে গেলে তো গেল। আত্মীয়স্বজন ভাইবোন মাবাবা বন্ধু বান্ধবের কান্নাকাটি হাহুতাশ শোনার মত মর্মভেদী অভিজ্ঞতা জীবিত মানুষের আর কিছুই হতে পারে না। এর চেয়ে বোধহয় মরদেহের গোসল-কাফন-দাফন অনেক সহজ কাজ। যদি আবার হাতপা ভেঙে হাসপাতালে পড়ে থাকে? তখন? আমি ভাবলাম এতো উঁচু দালানে নিশ্চয়ই লিফট থাকবে এবং রাত যতোই হোক দারোয়ান বা পাহারাদার কেউ তো থাকবেই। লিফটে ঐ আকাশের উঁচু থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নিশ্চয়ই নামিয়ে আনা যাবে বেয়াক্কেল চাঁদকে। হলুদ জার্সি খুলে রেখে দিতে হবে বেটার যেন খামখেয়ালী খেলা সে আর খেলতে আর না পারে। কিন্তু কার্নিশ থেকে সরে এসে নিচে নেমে আসবার জন্য ওকে বোঝাবে কে? হুলস্থূল করে রাতের দারোয়ানের খোঁজ করতে করতে শহরে শহরে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন ক্লান্ত আর অবসন্ন হয়ে পড়েছি, তখনই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। জাগবার পরেও আশ্চর্য যে নিজেকে খুব একটা বেকুব মনে হোল না। মস্ত উঁচু দালানে উঠে ছাদের কার্নিশে গিয়ে বসে নিচের যানজট ও বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর দুর্দশা দেখতে চাঁদেরও নিশ্চয়ই শখ হতে পারে। মন খারাপ হয়ে রইল। কার্নিশ থেকে সরিয়ে এনে নিচে নামিয়ে আনবার দায়িত্ব পালন করতে পারলাম না। সকালে আবিষ্কার করলাম আজ পঞ্জিকা অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৯ শে শ্রাবণ, ইংরাজি ১৩ আগস্ট। শনিবার। এবং পূর্ণিমা। নাকি আগেই আমি জানতাম?
পূর্ণিমার মধ্যে বৃষ্টি নাকি বৃষ্টির মধ্যে পূর্ণিমা এইসব এলোপাথাড়ি বাক্য প্রশ্ন চিহ্নের মত একবার সামনে এবং পেছনে ছুটাছুটি করতে থাকে সারা সকাল। এরই মধ্যে একটি মেসেজ এল। তাসমিয়া আফরিন মৌ পাঠিয়েছেন। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। মনে হোল কেউ আমার মাথা লক্ষ্য করে গুলি করে দিয়েছে। সত্য হলে সেটা মন্দ হয় না। অথচ সত্যিকারের গুলি খেয়ে মরার চেয়ে সেটা ভীতিকর। গুলি খেয়েও মরছি না সেটা টের পাচ্ছি। উলটা থর থর জীবিত।
পাঁচজন মারা গেছেন। কিন্তু গাড়িতে আর কারা ছিলেন? তাদের কী অবস্থা? খবর ছড়াতে শুরু করল। শিল্পী ঢালী আল মামুনের অবস্থা গুরুতর। মামুন ও দিলারা বেগম জলির সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হয়েছে, তবে খুব অল্পে ও সংক্ষেপে। চিনি। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ছিল না। শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে আমার নিজের আগ্রহের কারণে ঢালী আল মামুন ও তাঁর সমসাময়িকদের শিল্পকর্মের প্রতি আমার আগ্রহ দীর্ঘ দিনের। লেখালিখি করি বলে শিল্পীদের প্রতি আগ্রহ থাকারই কথা। তাঁর কথাই বেশি মনে পড়তে শুরু করল। সম্ভবত আমি নিষ্ঠুর মনের মানুষ। কিন্তু সত্য আরো নিষ্ঠুর হয়ে আসে তাঁদের জন্য যাঁরা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে নিজেকে নতুন ভাবে জীবনের সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে বাধ্য হন। এ এক নতুন ধরনের লড়াই। দিলারা বেগম জলির জন্যও। যার বাস্তবতা ভিন্ন। মামুন মন বেশি অধিকার করে রইল এই কারণেই। ঢালী আল মামুন যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এরপর মনে পড়ল ক্যাথরিনের কথা, তার পাশ থেকেই তারেক চলে গিয়েছেন। অভিজ্ঞতার এই ভীতিকর ও ভয়াবহ দিকগুলো কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য। অন্যের সান্ত্বনা আকস্মিক আঘাত সামলে উঠতে কতোটা সাহায্য করে আমি জানি না। আমি নিষ্ঠুর হয়ত এই কারণে যে যাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন তাঁদের হারানোর সত্যের চেয়েও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তাদের অতি কাছের মানুষগুলো। যারা আর নাই তাদের অনুপস্থিতি বহন করে বেড়াবার রূঢ় বাস্তবতা তাঁরাই বুঝবেন। মন অধিকার করে রইল তাঁদের স্ত্রী, সন্তান, পরিবারপরিজনদের কথা। মিশুক মুনীরকে দাফন করা হয়েছে ১৬ অগাস্ট, আর ১৭ অগাস্টে ফরিদপুরে তারেক মাসু্দ। কিছুদিন আগে গত হওয়া তাঁর বাবার কবরের পাশে তারেকের ঘুমাবার কথা শুনেছিলাম। ক্যাথরিন মাসুদ তাঁকে বাড়ির উঠানের এক কোনে রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তাঁর কথাই রাখা হয়েছে।
ঢালী আল মামুন চিকিৎসার জন্য ব্যাঙ্ককে…
২. নামের সুনাম এবং নামের নিরাকরণ
মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলা কাজী লাশ দাফনের পর মানব বন্ধনে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজনীতিবিদদের প্রশ্ন করেছিলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, কী করেছেন আপনারা? বলেছেন, এদেশের রাজনীতিবিদরা মানুষ বেচার জন্য রাজনীতি করেন। আলবৎ। কেউ তার বাবাকে বেচে, কেউ বেচে স্বামীকে। সাধারণ মানুষের খবর নেয় না কেউই। তাদের মেরে ফেললেই ল্যাঠা চুকে যায়।
ব্যপারটা তাহলে শুধু সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থার মামলা নয়, পুরা রাজনীতির মামলা। কিন্তু রাজনীতিবিদ বা জাতীয় রাজনীতি আমাদের রাজনৈতিক চেতনা থেকে আলাদা কিছু নয়। গণমাধ্যমগুলো যখন এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার খবর পরিবেশন করছিল তখন সঙ্গত কারণেই তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর খবরটাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মিশুক ও তারেকসহ মারা গিয়েছিল পাঁচজন। বাকিরা? বাকি তিন জনের নাম জানবার জন্য আমি প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্র ঘেঁটেছি, টেলিভিশনের খবরে খুঁজেছি। বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ভাবে দুই একজনের নাম এসেছে, কিন্তু তাদের মৃত্যু যেন গৌণ ও অপ্রাসঙ্গিক একটি বিষয়। সাধারণ মানুষকে নামহীন ও শুধুমাত্র সংখ্যায় পরিণত করবার যে প্রক্রিয়া সার্বক্ষণিক জারি থাকে তারই তুমুল চর্চা দেখলাম। বাংলাদেশে সবসময় তারেক মাসুদ বা মিশুক মুনীর মারা যান না। কিন্তু হরদম হামেশাই সাধারণ মানুষ মরছে। তাদের কোনো নাম নাই। তারা নিছকই সংখ্যা। তাদের নামের নিরাকরণ ঘটছে সবসময়ই। নামি বা দামিদের নাম নেবার মধ্য দিয়ে নামসম্পন্ন সাধারণ মানুষকে নামহীন করবার, মানুষকে শুধু সংখ্যায় পরিণত করবার রাজনীতি সম্পর্কে আমরা নিজেরাও সবসময় হুঁশে থাকি না। কিন্তু হুঁশে আছি জ্ঞান করে যে-রাজনীতির আমরা বিরোধিতা করতে চাই সেই রাজনীতি এই বেহুঁশ হাল থেকেই তার রস ও রসদ সংগ্রহ করে। সামাজিক অবচেতনার এই ক্ষেত্রগুলো আমাদের কাছে পর্যালোচনার বিষয় হয়ে ওঠে নি। সাধারণ মানুষের খবর না নেওয়াটাই আমাদের রাজনীতি নয় কি? সংবাদপত্রের রাজনীতিও সাধারণ মানুষের বেখবর করে দেয়।
নামহীন হয়ে যাবার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষেরও এক বিচিত্র প্রতিরোধের ধরন আছে। যারা কীটপতঙ্গের মতো সড়ক দুর্ঘটনায় নামসম্পন্ন হয়েও নামহারা হয়ে মরে তাদের মানুষ একটি সাধারণ নাম দিয়েছে। 'মফিজ'। এরা লঞ্চের পেটে ট্রেনবাসের ছাদে জীবিকার খোঁজে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যায়। তারেক ও মিশুকের মতো নামি মানুষদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ড্রাইভার মুস্তাফিজ এবং পেছনের সিটে বসা ওয়াসিম ও জামালও 'মফিজ' হয়ে গিয়েছে। তাঁদের মৃত্যুতেও আমি সমান শোকার্ত এবং তাঁদের পরিবারের সহমর্মী। সব মৃত্যুই ক্ষত তৈরি করে।
এই ক্ষোভের দৌড় কতোটুকু? এই দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার সমালোচনা হয়ে থাকবে কয়েকদিন। এখন রাজনীতির আলোচ্য বিষয়ে হয়ত পরিণত হয়েছে। এতোটুকুই। নৌ-পরিবহন এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দুই মন্ত্রীকে সংসদের ভেতরে ও বাইরে তুলাধুনা করা চলছে। এই নাটক কতোটা লোকদেখানো আর কতোটা ক্ষমতাসীন দলের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সেটা সহসা বোঝার উপায় নাই। মনে হচ্ছে সড়কে ও নৌপথে মানুষের নিরন্তর মরা ও পঙ্গু হয়ে যাবার দুর্ঘটনা রোধ করবার বাস্তব নীতি, পথ ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার দরকার নাই কারো। পরস্পরকে দোষারোপ করা ছাড়া। তুমুল নিন্দাবাদের মধ্য দিয়ে ক্ষোভ প্রশমণের চেষ্টাই চলছে শুধু। এই চেষ্টাই অব্যাহত রাখবে। ওতে অবশ্য তারেক ও মিশুক ফিরে আসবে না, কিম্বা ঢালী আল মামুনকে নিয়ে শঙ্কাও দূর হবে না। বৈপ্লবিক রূপান্তর দূরে থাকুক, নিদেন পক্ষে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার সংস্কারের দায়িত্ব নিতে ও কার্যকর পথের দিশা দেবার ক্ষমতা বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলেছে মনে হয়। না, তাও নয়। আমরা রাস্তাঘাট ঠিক রাখতেও জানি না। নিষ্ঠুর এই দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে এই হাস্যকর সত্যটাই বেরিয়ে আসছে…।
৩. বাক্য ভড়কে যাচ্ছে…
মিশুকের সঙ্গে আমার পরিচয় তারেকের সঙ্গেই। অনেক আগের কথা। সেটা দুই একবার কী খবর কেমন আছেন পর্যন্ত। তিনি একুশে থাকার সময় তাঁর গুণমুগ্ধদের কাছে মিশুকের কথা শুনেছি। নতুন কৃৎকৌশল আত্মস্থ করার কায়দা ও একটি প্রজন্মকে নতুন একটি মিডিয়ায় সাংবাদিকতা করবার জন্য দক্ষ করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার অবদান রয়েছে। এটা কাণ্ডজ্ঞানেই টের পাই। ক্যামেরায় তার কুশলতার খবর পেয়েছি। মিশুক মুনীরের প্রতিভা ও কুশলতা সম্পর্কে ধারণা করবার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা যারা তার সঙ্গে কাজ করেন নি তাদের থাকার কথা নয়। তার ঘনিষ্ঠজনরা ছাড়া। যারা আমার মতো তার কাজে আগ্রহী তাদেরও আছে বলে মনে হয় না। এখানে একটা অভাব রয়ে গেছে। মিশুক মুনীর যে টেলিভিশন নেটওয়ার্কে কাজ করতেন সেখানে তার সহকর্মীদের ভালবাসা ও আবেগ আমরা তার মৃত্যুর পর প্রচারের ধরন দেখেই উপলব্ধি করছি। তার মত একজন নির্বাহী কর্মকর্তাকে হারাবার শোকের মাত্রা এতে অনায়াসেই বোঝা যায়। সেটা স্তিমিত হবার আগে তাঁর কাজ সম্পর্কে আরও সম্যক ধারণা পাবার সুযোগ আমরা পাব কিনা জানি না, তবে এই কর্তব্যটি রয়ে গিয়েছে। কাছের মানুষ না হলে মিশুক মুনীরকে বাইরে থেকে চেনা মুশকিল। তুলনায় আমরা তারেক মাসুদের কাজ সম্পর্কে কমবেশি ওয়াকিবহাল। ঢাকায় আসার পর থেকেই তারেক সাহিত্য ও লেখালিখির জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। তার ওপর ছবি বানিয়েছেন বলে ছবির মাধ্যমে তারেককে চিনবার একটা সুযোগ হয়েছে অনেকেরই। তারেক যখন ঢাকায় বসবাস শুরু করে তখন থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে তার গড়ে উঠবার সময়কাল থেকে নিউ ইয়র্কে এবং তারপর তার ফিরে আসার পর তার সঙ্গে বাংলাদেশে সম্পর্ক ছিল সবসময়ই। সোনার বেড়ী তৈয়ারের সময় যে-ঘনিষ্ঠতা ছিল, সেটা নানা কারণে পরে পুরানা মাত্রায় বহাল রাখা সম্ভব হয় নি। তবে মাটির ময়না বানানো অবধি যোগাযোগ ছিল নানান ভাবে। ততোদিনে তার নিজের কাজের ক্ষেত্র যেমন সুনির্দিষ্ট হতে শুরু করেছে, তেমনি তার কাজের ধরন সামাজিক পরিমণ্ডলের সীমাও টেনে দিয়েছে। একই ভাবে আমার কাজের ক্ষেত্র এবং উৎসাহ ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার কাজ সম্পর্কে আগ্রহে কখনও কমতি ছিল না। এর বড় কারণ ছিল তারেক সিনেমার জগতে নিজের একটা জায়গা করে নিতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন, সেটা তার কাছের মানুষেরা অনায়াসেই টের পেত। ব্যাক্তির উদ্যম ও সাধনা তাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে সেই সাধারণ জায়গা থেকে তার সম্পর্কে তার অন্য শুভানুধ্যায়ীদের মতোই সমান উৎসুক ছিলাম সবসময়ই। এরপর তার ছবির ব্যাপারে আগ্রহ তো আছেই।
এই শোকগ্রস্ততার মধ্যেও তারেককে নিয়ে দুই একটি কথা বলব। যদিও তারেককে নিয়ে লিখতে আমি তৈরি না। এই লেখা লিখতে গিয়ে আমি দেখছি আমার বাক্য ভড়কে গিয়ে থেমে থেমে যাচ্ছে। লিখতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছি তারেক নাই। আবার মনে পড়ছে। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এবং তাকে হারাবার আকস্মিকতা সকলের মধ্যেই তুমুল আবেগ তৈরি করেছে। এখন কিছু লেখা কঠিন। তবুও…।
৪. চলচ্চিত্র ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম
তখন পাকিস্তানের যুগ। একই সঙ্গে হিন্দী ও উর্দু ছবির। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষায় কোনো ছবি হতে পারে সেটা ছিল এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সিনেমার কোনো কুশলী থাকবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সিনেমাই যেখানে নাই, সেখানে ক্যামেরাম্যান কি অভিনেতা কোথায় থাকবে? সেই সময় আব্দুল জব্বার খান মুখ ও মুখোশ ছবি বানাবার সাহস দেখালেন। ডাকাতদের গল্প। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা বা সেই সময়ের ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত কোনো বিষয় বা উত্তেজনা ছবির মধ্যে নাই। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ছবি তৈরি করা অসম্ভব সেই ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলাভাষায় প্রথম ছবি (টকিজ) বানানো আরম্ভ হয়। মুখ ও মুখোশ মুক্তি পেল ১৯৫৬ সালে। এরপর ফতেহ লোহানির আসিয়া (১৯৬০), মুস্তাফিজের হারানো দিন (১৯৬১), জহির রায়হানের কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), সুভাষ দত্তের সুতরাং (১৯৬৪) ইত্যাদি। বলাবাহুল্য সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের ছবি নির্মাণ বা বিষয় কোনো দিক থেকেই উর্দু ও হিন্দি ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যের সঙ্গে যেমন পাল্লা দিতে পারছিল না, একই সঙ্গে কলকাতার পরিশীলিত ছবির পাশেও দাঁড়াতে পারছিল না। একদিকে লাহোরী উর্দু ও ভারতীয় হিন্দী ছবির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলা ছবি তৈয়ার করা, অন্যদিকে কলকাতার বাংলা ছবির পাশে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টার গুরুত্ব ছিল সেই সময়ে অপরিসীম। ঋত্বিক ঘটকের নাগরিক (১৯৫২) ও মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), সত্যজিত রায়ের তিন খণ্ডের অপু কাহিনী বা অপু ট্রিওলজি (১৯৫৫-১৯৫৯), জলসা ঘর (১৯৫৮) ও অন্যান্য ছবির প্রভাব প্রতিপত্তির মধ্যে এই উদ্যমগুলো ঘটছে। ছবির নির্মাণ বা বিষয়ের দুর্বলতা কিম্বা তাদের বাণিজ্যিক ব্যর্থতা দিয়ে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে ছবি বানানোর সাংস্কৃতিক-রাজনীতি বোঝা যাবে না। বরং পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ছবি আমরা বানাতে সক্ষম এই আত্মবিশ্বাস অর্জনের সাধনা তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
পরিচালক সালাহউদ্দিন রূপবান বানিয়েছিলেন ১৯৬৫ সালে। রূপবান দুইদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যাদের জন্য এই ছবি বানানো হয়েছিল তারা আগের ছবির দর্শকদের চেয়ে আলাদা। তারা সাধারণ মানুষ। বিষয়ের দিক থেকেও ভিন্ন। ছবির বিষয় ঢাকায় নতুন গড়ে ওঠা পরিশীলিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চোখে নিচু জিনিস, তথাকথিত লোক-কাহিনী। রূপবান ছবিটির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে সাধারণ মানুষ হাজির হোল। লক্ষণীয় মোড় বদল। ততোদিনে পূর্ব পাকিস্তানে ছবি বানানো সম্ভব এবং এই অঞ্চলের বাংলাভাষীরা সিনেমা তৈয়ার করতে পারে এটা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ছবি তৈয়ার করতে পারা আর সেই ছবি পয়সা দিয়ে মানুষ দেখার মধ্যে একটা ফাঁক থেকে গিয়েছিল। রূপবান সেই ফাঁকটিও পূরণ করেছে। রূপবান ছবিটির এটা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক; এই ছবি মানুষ পয়সা দিয়ে দেখেছে। পূর্ব পাকিস্তানে তৈরি ছবি ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম এই আত্মবিশ্বাস অর্জনের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক আমাদের এখন স্মৃতি থেকে হারিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠবার সময় নিজেদের হীনম্মন্যতা কাটিয়ে উঠবার ক্ষেত্রে সেই সময়ের চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাসের এই সকল অদৃশ্য ভূমিকার দিকে আমাদের নজর ও মনোযোগ নাই। এই ছবিগুলো কোনো রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করে নি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ছবি বানানো যায় এবং তা বাণিজ্যিক ভাবে সফল হয়–ষাট দশকে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করা জরুরী ছিল।
আমার ভুল হতে পারে, তবে খান আতাউর রহমানের নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭) সম্ভবত প্রথম ছবি যেখানে ঔপবেশিকতার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের চেতনার লক্ষণ প্রথম চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। এর তিন বছর পর ১৯৭০ সালে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া ছবিটি গণ আন্দোলনের উত্তুঙ্গ মুহূর্ত সরাসরি ধারণ করে। ডকুমেন্ট্রি বা দলিলী ছবি আকারে নয়, ছবির গল্পের মধ্যেই। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের জাতীয় চেতনা ততোদিনে একটা রূপ নিয়ে নিয়েছে। ছবির মধ্যে 'আমার সোনার বাংলা' গানটি সংযোজনের মধ্য দিয়ে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের চেতনার চরিত্র নির্মাণে চলচ্চিত্র সরাসরি অংশগ্রহণ করে। সবমিলিয়ে ছবিটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের অংশ হয়ে যায়। এই ঘটনাগুলো ঘটছে একাত্তরের আগে। পূর্ব পাকিস্তানে ছবি তৈরির সংকল্প, সাধনা, অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের মধ্যে জাতীয় চৈতন্য নির্মাণের কাজগুলো বিচিত্র ও অদৃশ্য পথে নানান ভাবে সম্পাদিত হয়েছে।
৫. জাতীয়তাবাদী বয়ান, ভাবাবেগ ও একরৈখিকতা
যাঁরা জাতীয়তাবাদের ঘোর সমালোচক, তাঁরাও মনে করেন জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে একটা জাতীয় বয়ানের আবির্ভাব জরুরী হয়ে পড়ে। কিন্তু এই বয়ান যদি নিজের ঐতিহাসিক ন্যায্যতাকে সার্বজনীন ন্যায্যতায় পর্যবসিত করে, মুক্তিযুদ্ধকে একাট্টা একটি জাতীয়তাবাদী বয়ানে রূপান্তর করে ফেলে তখন ইতিহাস পর্যালোচনা অন্ধ আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। জাতীয় শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ের পরের লড়াই ও নির্মাণের কাজ ও কর্তব্য অপরিচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। জাতীয়্তাবাদের মন্দ দিকের চূড়ান্ত নজির হিসাবে নাৎসি জার্মানি কিম্বা ফ্যাসিস্ট ইতালির নজির দেওয়া হয় জাতীয়তাবাদের মধ্যে এই সুপ্ত বিপদের সম্ভাবনা সম্পর্কে সাবধান রাখবার জন্য।
তারেক মাসুদ যখন ছবি করতে এসেছেন তখন বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং বাঙালি পরিচয়ের প্রধান বয়ান হয়ে উঠেছে। তারেক মাসুদ খ্যাতি লাভ করলেন যখন তাঁর মুক্তির গান ও মুক্তির কথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের সেই প্রধান বয়ানের কাজে লেগে গেল এবং তাকে আরো শক্তিশালী করতে সক্ষম হোল। তার এই কাজকে দেখা হোল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণের দলিলী কাজ হিশাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সীমান্তে গান গেয়ে, পুতুল নাচ দেখিয়ে 'বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা' মানুষকে অনুপ্রাণিত করবার যে-কাজ করছিলেন লেয়ার লেভিন সেটা সেলুলয়েডে ধরে রেখেছিলেন। তারেক ও ক্যাথারিন মাসুদের একটি বড় কাজ ছিল নিউইয়র্কে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকা সেই অব্যবহৃত ফুটেজগুলো উদ্ধার। তারপর অন্যান্য দেশে মুক্তিযুদ্ধের যেসব ফুটেজ ছিল সেইসব সংগ্রহ এবং সম্পাদনার কঠিন কাজটিও করেছিলেন তারা। তার ভিত্তিতেই মুক্তির গান ছবিটি তৈরি হয়েছে। ছবিটি রীতিমত স্বাধীনতার দলিলের মর্যাদা পেয়ে যায়।
মুক্তির গান তথ্য, বয়ান ও ইতিহাস নির্মাণের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নাই। শরণার্থী শিবিরের ঘরভাঙা ঘরহারা দেশান্তরী মানুষদের ও মুক্তিযোদ্ধাদের গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করার এই ইতিহাস জেনে আমাদের লাভ হয়েছে। জানানোর দরকার ছিল। লেয়ার লেভিনের ফুটেজ নিউইয়র্কে নষ্ট হয়ে যাবার বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটা রোমাণ্টিক ধারণা তৈরির বিপদও এতে তৈরি হোল। এই দিকগুলো তারেককে হয়তো পীড়া দিত। আমার সঙ্গে তাঁর দুয়েকবার কথা বলতে গিয়ে এই প্রসঙ্গটি এসেছে। তারেক সম্ভবত এই একাট্টা জাতীয়তাবাদী বয়ানের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত আলোচনা কোনো প্রমাণ নয়। সম্প্রতি তার একটি প্রকাশিত লেখা থেকে তাঁর অস্বস্তির কিছুটা আন্দাজ করা যায় মনে করে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
('মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে ব্যতিক্রম ও বিতর্ক', তারেক মাসুদ, দৈনিক ইত্তেফাক ২৫ মার্চ ২০১১)
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান আখ্যান নির্মাণে সিনেমা গল্প, উপন্যাস, কবিতা বা নাটকের তুলনায় চলচ্চিত্র কতোটা বেশি ভূমিকা রেখেছে তা নিয়ে তর্ক করা যায়। তবে জাতীয়তাবাদী বয়ানের 'ভাবাবেগ ও একরৈখিকতা' তারেকের অপছন্দ ছিল, তার ইঙ্গিত এই লেখায় আছে। তারেক আলমগীর কবীরের ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩) ও অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষীর মধ্যে এই ভাবাবেগ ও একরৈখিকতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও লক্ষ্য করেছেন।
জাতীয় চৈতন্য নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা আর মুক্তিযুদ্ধে 'বাস্তবে কি ঘটেছে' তা পুনর্নির্মাণ এক কথা নয়। তারেক ছবি করতে এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের পরে। মুক্তিযুদ্ধে বাস্তবে কী ঘটেছে তা এখন নির্মাণের বিষয়। এই বানানোর কাজ 'পারসেপশান বা দৃষ্টিভঙ্গী' দিয়েই ঠিক হয়। তারেক তার পারসেপশান বা দৃষ্টিভঙ্গীকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের বাইরে নিয়ে যাবার সাধনা করেন নি। সেই পারসেপশান বা দৃষ্টিভঙ্গী শুধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ দিয়ে হতে হবে এমন কথাও নাই। শ্রেণীর প্রশ্ন রয়েছে, নারীর দিক থেকে দেখবার ব্যাপার রয়েছে। উপমহাদেশের আরো অতীতে তাকিয়ে নতুন আলোকে দেখবার সুযোগও রয়েছে। এমন কি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন ভাবে ভাববারও সুযোগ আছে। এই প্রসঙ্গে গুরুদাসী মণ্ডলের জীবন নিয়ে তৈরি ইয়াসমিন কবীরের মাত্র ৩৭ মিনিটের অসাধারণ ডকুমেন্টারি স্বাধীনতা (২০০৩)-র কথা মনে পড়ছে। নির্যাতিত ও যুদ্ধে স্বজন হারানো পাগল হয়ে যাওয়া গুরুদাসী ও কপিলমুনির সাধারণ মানুষগুলো একসঙ্গে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতি ও ক্ষতকে মোকাবেলা করছে সেটা দেখি আমরা। ওর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বর্তমানের বিষয় হয়ে ওঠে।
ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বয়ান বা আখ্যানের সীমা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে তারেকের অনেক নালিশ ছিল। কিন্তু সেই নালিশ ছিল জাতীয়তাবাদী মূল বয়ানের ছককে আরো বিস্তৃত ও পরিশুদ্ধ করবার দরকারে। সেই দরকার বোধ করতেন তিনি এবং সেই বয়ানের ভেতরে থেকেই তারেক তার সৃষ্টিশীলতাকে কাজে খাটিয়েছেন। এখানেই তার বিশিষ্টতা। তার সাফল্যের জায়গাটাও এখানে।
৬. নির্দোষ শিশুর নিরাসক্ত দর্শন
…….
মাটির ময়না ছবির একটি পোস্টার
…….
'মুক্তির গান'-এ জাতীয়তাবাদী বয়ানের ভাবাবেগ ও একরৈখিকতা অতিক্রম করে যাবার সম্ভাবনা তার দলিলী বা ডকুমেন্টারি চরিত্রের কারণে ছিল না। মাটির ময়নায় সে সম্ভাবনার চর্চা আমরা দেখি। প্রথম ফিচার ফিল্মের ছবির কাহিনী তারেকের নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া। ছবির চরিত্রে যে-আনোয়ারকে আমরা দেখি, তারেকের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী সেই চরিত্র তারেক নিজে। শৈশবে তারেকের শিক্ষা জীবনের শুরু মাদ্রাসায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইসলামের যে একরৈখিক বা সাদাকালো দ্বন্দ্ব এবং সেই পারসেপশান থেকে ইসলামকে বৈচিত্রহীন একাট্টা গণ্য করবার দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠেছে। এই ছবিতে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে দ্বন্দ্বের একরৈখিকতা ও একাট্টা ইসলামের বদ্ধমূল ধারণা মোকাবেলা করার চেষ্টা আছে। ইসলাম নানা রকম। মাদ্রাসার হুজুররা সকলে নির্দয় হয় না, তাদের মধ্যেও ভাল মন্দ আছে। আনোয়ারের বাবা পাঁড় রক্ষণশীল, গ্রামের নিরীহ হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। ছেলেকে বেদাতি কাজকাম থেকে দূরে রাখতে সবসময়ই সচেষ্ট। অথচ কোনো পাকিস্তানপন্থী ইসলামি দলের সঙ্গে যুক্ত নন। অন্যদিকে আবার তিনি ষাটের শেষে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্তাল উন্মেষের মিছিল মিটিং এড়িয়ে চলেন। মাটির ময়নায় নানান ধরনের ইসলাম এবং বাংলাদেশের গ্রামের নানান ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার ও উৎসবের উপস্থিতি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছে বাংলাদেশ আসলে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ।
কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে স্যেকুলারিস্ট ও উগ্র ইসলামপন্থীদের লড়াই হিসাবে দেখবার যে-সাদাকালো বা একরৈখিক বন্দোবস্ত জারী রয়েছে সেই বিষয় তারেক কীভাবে দেখেছেন? তার দেখবার পদ্ধতি কী? তারেকের ভাষ্য অনুযায়ী এই ব্যপারগুলোকে তিনি একটা দূরত্ব থেকে দেখবার চেষ্টা করেছেন। আনোয়ার বা আনু যেমন সক্রিয় চরিত্র নয়, তেমনি তার মতো নিরাসক্ত থেকে কিছু না ছুঁয়ে শুধু এই সময়ের ঘটনাঘটন দেখে গিয়েছেন তারেক। আনোয়ার কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করছে না, জড়াচ্ছে না। বড়রা নিজ নিজ চিন্তা ও ধ্যানধারণার ভার বয়ে বেড়াচ্ছে। আর ঠিক এখানেই নিরাসক্ত আনোয়ারের আরাম ও সুবিধা হয় বলে মনে করেন তারেক। সে কোনো ভালমন্দ বিচার করে না। তারেকের ভাষায় সে কোথাও intervene করে না। যুক্ত হয় না। একেই আমি নিরাসক্তি বলছি। নিরাসক্ত চোখ দিয়ে নিজের পরিবার, সমাজ ও মাদ্রাসার বিচিত্র ঘটনাবলী দেখছে আনোয়ার, আর আনোয়ারের চোখ দিয়ে দেখছে তারেক মাসুদ। দেখছে হিন্দু মুসলমানসহ বহু ধর্মের বিশ্বাস, আচার ও উৎসব, দেখছে বহু ধরনের ইসলাম, সুফি বয়াতিদের উপস্থিতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, ইত্যাদি। তারেকের দাবি আনুর এই নিরাসক্ত চোখ দিয়ে দেখার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দর্শক কী নেবে আর কী বাদ দেবে ঠিক করবে। নিজ নিজ বিবেচনা মত প্রত্যেকে নিজের নিজের সিদ্ধান্ত নেবে। "যদি আমার ছবি কোন প্রশ্ন তোলে তাহলে শিশু আনোয়ারের নির্দোষ দেখার জগত থেকে তোলা প্রশ্ন"–তারেক বলেছেন। (Le Monde's weekly supplement Aden। 15 May 2002)
নির্দোষ শিশুর জগতে বসে শিশুর চোখ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা কোনো ইতিহাস আদৌ বিচার করা সম্ভব কিনা সেটা পাঠক বিচার করে দেখতে পারেন। এই দেখার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ন্যায্যতার প্রতি নিরাসক্তি চর্চার বিপদ যেমন তৈরি হয়, তেমনি যুদ্ধোত্তর বাঙালি জাতীয়তাবাদের সার্বজনীন বয়ান পর্যালোচনার কর্তব্যের প্রতিও নিরাসক্তি তৈরি হতে পারে। তারেক যেমন করে নিজের ছবি নিয়ে ভেবেছেন, আমরা তেমন করে ভাবলে মাটির ময়নার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলতে পারি। এই ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। আসলে ছবিটি নিরাসক্ত ছিল না।
তারেক বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ান থেকে বেরিয়ে আসেন নি, কিন্তু মাটির ময়না বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের সংকটকে সামনে নিয়ে এসেছে, এখানেই এই ছবির সার্থকতা। মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি, চিন্তা ও রাজনীতির মধ্যে ইসলাম গলার কাঁটা হয়ে হাজির রয়েছে। বের করা যায় নি, উগরিয়ে ফেলাও যায় নি। বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গিয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। মনে করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভাষা ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তা এবং ধর্মনিরপক্ষতার বিজয় ঘটিয়ে তার সমাধান হয়েছে। কিন্তু হয়েছে কি? তারেক ইসলামের একটি সাংস্কৃতিক ও লোকায়তিক ভূমিকা মানতে রাজি, কিন্তু তার রাজনৈতিক ভূমিকা মানতে রাজি না। কিন্তু নিরাসক্ত থাকবার দরকারে তাঁর ছবিতে এই প্রশ্নটিকে এড়িয়ে গিয়েছেন। বিস্ময়কর যে মাটির ময়নায় রাজনৈতিক ইসলামের কোনো উপস্থিতি নাই। বাকি যে ইসলাম রয়েছে তাকে ভাল ইসলাম ও মন্দ ইসলাম হিসাবে ভাগ করা হয়েছে। যেমন, দারুল উলুম মাদানিয়া মাদ্রাসার ইব্রাহিম হুজুর আর হালিম হুজুর; ভাল হুজুর আর খারাপ হুজুর। কিম্বা একদিকে আনোয়ারের রক্ষণশীল শরিয়তি বাবার ইসলাম, যিনি আনোয়ারকে মাদ্রাসায় পড়তে পাঠিয়েছেন, এলোপ্যাথি ওষুধ না খেতে দিয়ে নিজের মেয়ের মৃত্যু ঘটিয়েছেন, যিনি বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানি সৈন্যেরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য এসেছে, বাঙালিদের মারবার জন্য আসে নি। অন্যদিকে তার এই ইসলামের বিপরীতে আছে সংস্কারমুক্ত মারফতি ইসলাম; যে ইসলাম গান গায়, "যদি আল্লার সন্ধান চাও গো প্রেম রাখিও অন্তরের ভেতর", নারী পুরুষ উন্মুক্ত মঞ্চে গানে গানে শরিয়ত মারফত নিয়ে তর্ক করে, নবী ইব্রাহিমের নিজ সন্তান ইসমাইলকে কোরবানি দেবার পুঁথি পড়ে আপ্লুত হয়। ইত্যাদি।
মাটির ময়নায় আমরা যেভাবে মাদ্রাসাকে দেখতে পারলাম তার জন্য তারেক স্মরণীয় হয়ে থাকবে। রোকনের চরিত্র ভাবায়। মাদ্রাসায় যে গরিব ও এতিম বাচ্চাগুলো আসে রোকন তাদের প্রতীক হয়ে ওঠে। তাদের আর কোথাও যাবার জায়গা নাই, কিন্তু সমাজ থেকে ছিটকে এসে মাদ্রাসায় আটকে পড়া রোকনের ভবিষ্যৎ কী? ছবিতে আমরা দেখি রোকন পাগল হয়ে গিয়েছে। আনু ফিরে যাচ্ছে তার বাড়িতে। কারণ তার যাবার জায়গা আছে। তাহলে পাগল হয়ে যাওয়াই কি রোকনদের পরিণতি? একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। আমরা বুঝতে পারি তারেক একটা মধ্যবর্তী পথ বেছে নেবার চেষ্টা করছে।
মাটির ময়নায় যদি ইসলামের প্রশ্ন তোলাই হয়ে থাকে তাহলে জঙ্গী ইসলামের প্রশ্ন তোলা সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। মাটির ময়না যখন তৈরি হচ্ছিল তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে হামলা হয়। দুই হাজার এক সালের সেপ্টেম্বরের এগারো তারিখের সেই বিধ্বংসী ঘটনার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের শুরু। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের শত্রু রাজনৈতিক ইসলাম এবং তার বিশেষ জঙ্গী রূপ। জঙ্গী ইসলামের প্রশ্নটি তারেক তুলেছেন তাঁর রানওয়ে ছবিতে'। জঙ্গী হওয়ার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির একটা ব্যাখ্যা হাজির করবার চেষ্টা আছে এখানে। একই সঙ্গে ফিরে আসাও। যে জঙ্গী হয়েছে সে জঙ্গী থাকে নি, সে ফিরেও আসে এই স্বস্তিটুকু তারেক দিতে চেয়েছেন।
ছবি তৈরির মুনশিয়ানায় তারেক কতোটা হাত পাকিয়েছিলেন সেই দিক নিয়ে হয়তো একসময় আলোচনা হবে। কিন্তু সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিতর্কে তারেক তার ক্যামেরা নিয়ে যেভাবে অংশগ্রহণ করবার হিম্মত দেখিয়েছেন, শুধু সেই কারণেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। বাঙালি জাতীয়তাবাদী বয়ানের মধ্যে ইসলাম প্রশ্নে যে উৎকণ্ঠা ও ভীতি রয়েছে তারেক তার জায়গা থেকে সেই সবের একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টার মূল কথা ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আশ্রয় করেই বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য নতুন বয়ান খুঁজতে হবে। ইসলাম যেখানে বাইরের প্রতিপক্ষ হয়ে থাকবে না। তার চলে যাওয়ায় এই চেষ্টায় বড় একটা ছেদ ঘটবে।
কী করে তা পূরণ হবে, জানি না…।
৪ ভাদ্র ১৪১৮। ১৯ অগাস্ট ২০১১। শ্যামলী
লেখকের আর্টস প্রোফাইল: ফরহাদ মজহার
ইমেইল: [email protected]
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts