Published : 24 May 2022, 07:04 PM
চতুর্থ শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে তখন থেকে দশম শতক অবধি ইতালিতে লেখকেরা প্রবন্ধ রচনায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। রোমান আইনের অভীক্ষা, ধর্মতত্ত্ব, রোমান সাম্রাজ্যের সৌন্দর্য ও শক্তিময়তার বুদবুদ ইত্যাদি নিয়ে প্রবন্ধ লিখাটাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। কেবল মাত্র লাতিন ভাষা (প্রাচীন রোমের ভাষা যা কিনা ইন্দো-ইউরোপিয় ভাষা-পরিবারের একটি ভাষা)-তেই রচিত হচ্ছিল এসব প্রবন্ধ। এদিকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণে ইতালির অন্যান্য এলাকায় (ফ্রাান্স, স্পেইন ও পর্তুগালসহ রোমান সাম্রাজ্যের অধীন আর সব স্থানেও বটে) বাধ্যতামূলকভাবে লাতিন ভাষা-শিক্ষার প্রচলন আর রইল না। সেই সময়টিতে দাপ্তরিক কাজ এবং চার্চের কর্মকাণ্ড লাতিন ভাষাতে চললেও এভাবে ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদী এবং এক সময়ের পরাক্রমশালী রোমানদের এই ভাষা শোকেসে ঢুকে যেতে শুরু করে। তখন স্বাধীনভাবে তাদের মাতৃভাষা চর্চা করার সুযোগ পেয়ে যায় রোমভিন্ন ইতালির অন্যান্য এলাকার মানুষজনও। মানুষের মুখের ভাষাকে তো আর দমিয়ে রাখা যায় না শেষ পর্যন্ত! তাই শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে রোমান ভাষার দৌরাত্ম্যর গাঁদটুকু রয়ে গেলেও ইতালির বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষজন নিজেদের মাতৃভাষায় নিঃসঙ্কোচে কবিতা ও গান বেধেছে। লাতিন ভাষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের মাতৃভাষায় কবিতা-গান রচনা করাটা নিশ্চয় রোমের কুলিনদের বিরুদ্ধে রোমভিন্ন অন্যান্য এলাকার মানুষজনদের সুস্পষ্ট বিদ্রোহই ছিল। এভাবেই ইতালিতে সূচিত হয়েছিল গণমানুষের মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনার ধারা। আনুমানিক এগার শতকে সেই কাজটা শুরু করেছিলেন মূলত আল্পস্ পর্বতমালার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত অক্সিতান উপত্যকার গীতিকবিরা যারা মোটেই কুলিন কেউ ছিলেন না–ছিলেন সাধারণ মানুষের কাতারের অংশ। পরে উত্তর এবং মধ্য-ইতালি, স্পেইন এবং পর্তুগালের লোকজ গীতিকবিরা অক্সিতান উপত্যকার গীতিকবিদের সাহিত্যকর্মের ধারাটিকে অনুসরণ করেছিলেন। অক্সিতান ভাষায় এসব লোকজ গীতিকবিদেরকে 'ত্রোবাদুর' বলা হয়ে থাকে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে এরা নিজেদের স্থানিক ভাষায় গীতিকাব্য এবং আখ্যানগীতিকা রচনার ধারা অব্যাহত রেখেছেন, তা বেগবানও করেছেন, এবং জনতার সামনে পরিবেশন করে তাদের সাহিত্যিকর্ম ছড়িয়ে দিয়েছেন ইতালির নানান অঞ্চলে। এসব লোকজ গীতিকবিরাই ইতালির সাহিত্যে লাতিন ভাষার প্রাধান্যকে নস্যাৎ করার প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন।
উল্লেখ্য, রোমান সাম্রাজ্যের আর সব উপনিবেশের মতোই উত্তর ও মধ্য-ইতালির লোম্বারডিয়া, তোস্কানা, ভেনেতো–এসব এলাকার মানুষের মুখের ভাষা এবং লিখার ভাষার মূলে ছিল বিকৃত লাতিন। সাম্রাজ্যবাদী লাতিন ভাষার ভিত্তি এসব এলাকার ভাষার উপরেও সওয়ার হয়েছিল বটে। তবে লাতিন ভাষার ভিত্তি পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষার বিভিন্নতার কারণে মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে এসব এলাকায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল নতুন লোকজ ভাষা। এসব লোকজ ভাষাগুলো লাতিনভাষা থেকে খুব একটা দূরের না-হলেও সেগুলো মানুষের আঞ্চলিক বিভিন্নতাকে ধারণ করেছিল। এটা সত্য যে সাম্রাজ্যবাদী রোমানদের রক্তচুক্ষ উপেক্ষা করে রোমভিন্ন ইতালির এসব এলাকার মানুষজন প্রায় চারশ বছর ধরে বাধাহীনভাবে তাদের নিজেদের মনের সাহিত্যিক-প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়নি। তবুও এসব এলাকার গীতিকবিরা ঠিকই তলে তলে যতনে নিজেদের লোকজ ভাষায় কাব্য এবং গান রচনা করে গেছেন; তার নিদর্শণ রেখেও গেছেন পরবর্তি প্রজন্মের কাছে। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতেই রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে যাবার পরে, আনুমানিক বার শতক থেকে, উত্তর ও মধ্য-ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষায় রচিত গীতিকবিতা এবং গানের স্ফূরণ বেগবান হয় এবং তা ছড়িয়ে পড়ে ইতালির কোণে কোণে। উত্তর ও মধ্য-ইতালির লোম্বারডিয়া, লিগুরিয়া, তোস্কানা এবং ভেনেতো-র গীতিকবিদের স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশনার সুফল আমরা পরবর্তিতে, চতুর্দশ শতকে, বিশ^সাহিত্যে পেয়েছি: তোস্কানা অঞ্চলের ফ্লোরেন্সে ১২৬৫ সালে জন্ম নেয়া মধ্যযুগের শেষদিকের রোমান্টিক কবি দান্তে আলিঘেইরি ১৩০৮-২০ সময়কালে তাঁর বিখ্যাত রূপকাশ্রয়ী মহাকাব্য 'কমেডিয়া' লিখলেন তোস্কানা এবং সিচিলিয়ার গণমানুষের মুখের ভাষার মিশেলে। তোস্কানা অঞ্চলের মানুষের মৌখিক ভাষার সাথে কীভাবে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরের সিচিলিয়ার গণমানুষের মুখের ভাষা মিলল সে কথা আমরা পরে আলোচনা করব। তার আগে সাম্রাজ্যবাদী রোমানদের নিজস্ব লাতিন ভাষাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গণমানুষের মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনায় লোম্বারডিয়া, লিগুরিয়া, তোস্কানা, ভেনেতো ইত্যাদি অঞ্চলের কবিদের অবদান বিশদে আলোচনা করা যাক।
ছবি: দান্তের প্রতিকৃতি
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরপর, এগার শতকের দিকে, গণমানুষের মুখের ভাষায় রচিত গীতিকাব্য এবং আখ্যানগীতিকা নিয়ে পয়লাতে এগিয়ে আসেন আল্পস্ পর্বতমালার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত অক্সিতান উপত্যকার ত্রোবাদুর বা গণমাণুষের গীতিকবিরা। অক্সিতান ভাষাই ছিল তাদের মাতৃভাষা। ইতালির উত্তর-পশ্চিম এলাকার অক্সিতান উপত্যকার অংশ, মোনাকো, দক্ষিণ ফ্রান্স এবং স্পেইনের ভাল ডি'আরান এলাকা পড়েছে এই অক্সিতানিয়ায়। অক্সিতানিয়ার এসব আঞ্চলিক কবিরা একাধারে অক্সিতান ভাষায় গীতিকাব্য এবং আখ্যানগীতিকা রচনা করেছেন এবং তারা ইতালির বিভিন্ন শহরের পিয়াৎজা বা চত্বরে মানুষের সামনে তা পরিবেশন করেও বেড়িয়েছেন। অক্সিতানিয়ার অন্তর্ভুক্ত ইতালি-অংশের এসব গীতিকবিরা পরে পৃষ্ঠপোষকও পেয়ে যান। তাদেরকে মদত জোগাতে পয়লাতে এগিয়ে আসে ইতালির উত্তরের লোম্বারডিয়া-এলাকার অভিজাতশ্রেণী। মিলান-নির্ভর লোম্বারডিয়ার অভিজাতরা অবশ্য তাদের ক্ষমতা সংহত করার জন্যই গণমানুষের কাছে যেতে চেয়েছে এবং সে কারণেই তারা অক্সিতান উপত্যকার আঞ্চলিক ইতালিয় কবিদেরকে পৃষ্ঠপোষণা করেছে যথারীতি। এরপরে অক্সিতানিয়ার গীতিকবিদের গীতিকাব্য এবং আখ্যানগীতিকার প্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণেই আনুমানিক বার থেকে তের শতকে উত্তর (লোম্বারডিয়া, লিগুরিয়া, ভেনেতো ইত্যাদি এলাকা নিয়ে গঠিত) এবং মধ্য-ইতালি (যার ভেতরে রয়েছে তোস্কানা, উমব্রিয়া, লাজিও ইত্যাদি এলাকা)-র গীতিকবিরাও গীতিকাব্য এবং আখ্যানগীতিকা রচনা করতে শুরু করেন, এই অক্সিতান এলাকার লৌকিক ভাষাতেই। কালে কালে ইতালির ভেরোনা-নির্ভর লিগুরিয়া এলাকা এবং ভেনেতো এলাকার এলিটরাও ইতালির অক্সিতান উপত্যকার ত্রোবাদুর বা গণমানুষের গীতিকবিদের কাজের বিস্তারের জন্য বিনিয়োগ করেছে। তখন উত্তর এবং মধ্য-ইতালির গীতিকবিরা সেই অক্সিতান এলাকার গণমানুষের মুখের ভাষাতেই মোটা দাগে যে জনপ্রিয় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন তার বিষয়গুলোর ভেতরে রয়েছে প্রেম, রাজনীতি, গ্রিক ও ফরাসি বীরদের বীরত্ব, যুদ্ধে মৃতদের জন্য শোকসন্তাপ, যৌনতা, বিকৃত হাস্যরস, প্যারোডি ইত্যাদি। লোম্বারডিয়ার গণমানুষের কবি সোরডেল্লো অক্সিতান ভাষায় গীতিকাব্য এবং আখ্যানগীতিকা রচনা করে এ সময়ে সব চাইতে বিখ্যাত হয়েছিলেন যার কাজের প্রশংসা করেছেন দান্তে আলিঘেইরি, রবার্ট ব্রাউনিং, অস্কার ওয়াইল্ড, এজরা পাউন্ড প্রমুখ।
ইতালির ত্রোবাদুরদের সম্পর্কে এখানে আরও দুটো তথ্য সংযোজন না-করলেই নয়। প্রথমত, উত্তর এবং মধ্য-ইতালির গীতিকবিরা অক্সিতান ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে শুরু করলেও তের শতকের পয়লা দিকে তারা অক্সিতান ভাষায় সাহিত্য রচনার ঐতিহ্যকে ঝেরে ফেলে দিয়ে নিজেদের লৌকিক ভাষাতেই সাহিত্য রচনাতে মনোযোগ দেয়। ফলে এবার ত্রোবাদুরদের কাজে যুক্ত হয় মূলত উত্তর ও মধ্য-ইতালির লোম্বারডিয়া, লিগুরিয়া, তোস্কানা, ভেনেতো ইত্যাদি অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষা। গণমানুষের এসব কবিরা এবার প্রেমনির্ভর জনপ্রিয় গীতিকবিতা ও আখ্যানগীতিকায় নিয়ে এল নতুন নতুন বিষয়–এলাকানির্ভর প্রেমকাহিনী, গ্রিক ও ফরাসি বীরদের বীরত্বগাথা, অ্যারিস্টেটোলের জীবনী, মার্কো পোলোর অভিযাত্রা, আধ্যাত্মিক বিষয় ইত্যাদি। এছাড়া তারা এ সময়ে নিজেদের লৌকিক ভাষায় ফরাসি প্রেমের কাহিনীর অনুবাদ করেছে এবং তাদের নিজস্ব মুখের ভাষার সাথে ফরাসি ভাষার মিশেল ঘটিয়ে মিশ্র ভাষায় গীতি-আলেখ্যও রচনা করেছে।
দ্বিতীয়ত, ত্রোবাদুরদের এই পর্যায়ের কাজ ক্রমশ উত্তর ও মধ্য-ইতালিতে ছড়িয়ে যায় দু'টো চ্যানেলের মাধ্যমে–প্রথমত, লোম্বারডিয়া, লিগুরিয়া, তোস্কানা, ভেনেতো ইত্যাদি এলাকার মূল শহরগুলোর পিয়াৎজা বা চত্বরগুলোতে তারা আখ্যান-গীতিকার প্রদর্শনী করেছে এবং তা গণমানুষের ভেতরে সমাদৃত হয়েছে; ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত এলাকায়। এছাড়া, আমরা দেখি, এসব বড় শহরে প্রবেশের হাইওয়ের ধারে বাজীকরেরা খেলা দেখানোর সময় জনপ্রিয় আখ্যান-গীতিকাগুলোর অংশবিশেষ পরিবেশন করছে মানুষদেরকে আকর্ষণ করার জন্য। এখানে না-বললেই নয় যে পরে ইতালির উত্তর ও মধ্য অংশের বিভিন্ন অঞ্চলের এসব গীতিকবিদের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের অজানিতেই গড়ে ওঠে সাহিত্য করার জন্য একটা সর্বসাধারণ ভাষা। লোম্বারডিয়া, লিগুরিয়া, ভেনেতো ইত্যাদি অঞ্চলের মৌখিক ভাষাকে পিছে ফেলে তোস্কানা-অঞ্চলের মানুষের মৌখিক ভাষার উপাদানই তাদের কাজের প্রধান সাহিত্যিক ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। এই একটা সর্বসাধারণ ভাষা তোস্কানার কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের মৌখিক ভাষা ছিল না। অর্থাৎ এই ভাষাকে কোনও মতেই তোস্কানা-অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে অভিধা দেয়া সঠিক নয়। বরংচ তোস্কানা-অঞ্চলের সর্বসাধারণের এই মৌখিক ভাষাকে একটি স্থানিক ভাষাই বলতে হবে। তবে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছিল এই স্থানিক ভাষা? আমরা দেখতে পাই, ফ্লোরেন্স এবং সিয়েনার মতো তোস্কানা-অঞ্চলের বড় বড় শহরগুলোতে তোস্কানার বিভিন্ন এলাকার মানুষজন নানান অর্থনৈতিক কারণে বসবাস করেছে–যেমনটা হয় আর কি! এসব বিবিধ মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মুখের ভাষার সংমিশ্রণে বিবর্তনের প্রক্রিয়াতে স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছিল সর্বসাধারণের নতুন এক স্থানীক ভাষা। এমন করেই দীর্ঘ প্রক্রিয়াতে ঢাকা শহরে জন্ম নিয়েছে একটি গড় ভাষা যে ভাষাতে কেবল যে ঢাকা জেলার আঞ্চলিক ভাষার উপাদান রয়েছে এমনটা নয়–এখানে এসে মিশেছে কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষের মৌখিক ভাষা। নির্দিষ্ট একটি ভৌগলিক স্থানে গড়ে ওঠা এমন মিশেল একটি ভাষাকেই স্থানিক ভাষা বা সর্বসাধারণ ভাষা বলা হয়ে থাকে। যাহোক, তোস্কানার এই স্থানীক ভাষাই ত্রোবাদুরেরা তাদের গীতিকাব্য রচনা ও পরিবেশনায় ব্যবহার করেছিলেন।
তৃতীয়ত, তোস্কানা-অঞ্চলের স্থানীক ভাষানির্ভর উত্তর ও মধ্য-ইতালির ত্রোবাদুরদের কাজ তখন এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে তা উত্তর বা মধ্য-ইতালির সীমানা পেরিয়ে ইতালির দক্ষিণের বিভিন্ন অঞ্চলের ত্রোবাদুরদের মুখে মুখে ক্রমাগত ঘুরছিল, ঘুরতে ঘুরতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল প্রায় এক হাজার মাইল দূরের সিচিলিয়ারাজ্য পর্যন্ত। এভাবে তোস্কানা-অঞ্চলের সর্বসাধারণের লোকজ ভাষা উত্তর ও মধ্য-ইতালির ত্রোবাদুরদের মাধ্যমে সমগ্র ইতালির ত্রোবাদুরদের সাধারণ ভাষায় পরিণত হয়।
আমরা দেখি, দ্বিতীয় ফ্রেডেরিকের কল্যাণে ১২৩০ সালে সিচিলিয়ায় যে কাবিতা-স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে সমাদৃত হয়েছিল উত্তর ও মধ্য-ইতালির ত্রোবাদুরদের গীতিকাব্য ও আখ্যান-গীতিকা। দান্তে আলিঘেইরি, যিনি মধ্য-ইতালির তোস্কানারাজ্যের ফ্লোরেন্সে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই স্কুলেই ভাষাতত্ত্ব পড়তে গিয়েছিলেন; সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তোস্কানা-এলাকার সংস্কৃতি আর সেই আঞ্চলের গণমানুষের মুখের ভাষার ঘ্রাণ। সিচিলিয়ার এই কাবিতা-স্কুলের সাথে লোম্বারডিয়া, লিগুরিয়া, সিয়েনা এবং ভেনেতোর ত্রোবাদুরদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলেই জানা যায় এবং তাদের কাজের সাথে এখানেই বৃহৎ পরিসরে সম্মিলন ঘটেছিল দান্তে আলিঘেইরির। এ কারণেই তিনি আনুষ্ঠানিক সাহিত্যে লৌকিক ভাষা প্রয়োগ করার ব্যাপারে ভাবতে পেরেছিলেন; ১৩০২-০৫ সময়কালে সাহিত্যে গণমানুষের মুখের ভাষার প্রয়োগের গুরুত্বের ওপরে 'অন দ্যা ভালগার টাং' (মূল নাম–ডি ভালগারি এলোকোয়েন্তা) শীর্ষক গবেষণানির্ভর রচনা লিখতে পেরেছিলেন; এবং পরে, ১৩০৮-২০ সময়কালে, স্থানীক ভাষার ওপরে ভিত্তি করে রচনা করতে পেরেছিলেন তার কালজয়ী মহাকাব্য–'কমেডিয়া'।
'অন দ্যা ভালগার টাং'-এ দান্তে আলিঘেইরি দাবি করেছেন, ইতালির এলিটদের উচিৎ ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলের লৌকিক ভাষাকে লাতিনের সমান মর্যাদা এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করা। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, বিভিন্ন এলাকার গণমানুষের মুখের ভাষাই হলো একটি ভাষার প্রাণ কেননা গণমানুষের মুখের ভাষার নির্দিষ্ট কোনও ব্যকরণ থাকে না বলে তা বিবর্তিত হয় ক্রমাগত–প্রতিনিয়ত তাতে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন সব শব্দ, নতুন বাক্যবিন্যাস এবং শেষে পাল্টে যায় সেই ভাষাটির কাঠামো। তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা হলো: কোনও একটি আনুষ্ঠানিক ভাষা, যেমন, লাতিন, শেষ পর্যন্ত বন্দী হয়ে যায় ব্যকরণের কারাগারে এবং তখন সেই ভাষা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততাকে আর যুতমতো ধারণ করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, 'অন দ্যা ভালগার টাং'-এ দান্তে ইতালির চৌদ্দটি আঞ্চলিক ভাষার ঠিকুজি হাজির করেছেন এবং দেখিয়েছেন যে এই আঞ্চলিক ভাষাগুলো গঠনের দিক থেকে একে অপরের তুলনায় আলাদা–যেমন, আপুলিয়ার মুখের ভাষা সিচিলিয়ার মুখের ভাষা থেকে পৃথক, লাৎজিওর মুখের ভাষা আলাদা তোস্কানার মুখের ভাষার তুলনায়, আবার তোস্কানার মুখের ভাষা আলাদা ভেনেতোর মুখের ভাষা থেকে ইত্যাদি।
তৃতীয়ত, দান্তে তার গবেষণাভিত্তিক প্রবন্ধে বলছেন, ভাষার আঞ্চলিক পার্থক্য ছাড়াও একটি অঞ্চলের বিভিন্ন শহরের ভাষার ভেতরেও সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। উদাহরণত বলা যায়, তোস্কানা-অঞ্চলের সিয়েনা নামক শহরের স্থানীক ভাষার ঝোঁকের তুলনায় ঐ একই অঞ্চলের ফ্লোরেন্সের স্থানিক ভাষার ঝোঁকের ভেতরে মিল থাকলেও সুক্ষ্ণভাবে বিভিন্নতাও বিদ্যমান। একই কারণে আরেৎজোর স্থানিক ভাষা থেকে পিসার স্থানিক ভাষা আথবা চেরতালদোর স্থানিক ভাষা থেকে মনতেরিৎজিওনের স্থানিক ভাষার ভেতরে একটু হলেও চরিত্রগত বিভেদ রয়েছে। চতুর্থত, লাৎজিও অঞ্চলের রোম-শহরের ভাষাকে তিনি যথাযোগ্য একটি সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে নস্যাৎ করেছেন কেননা, তার যুক্তিতে, লাতিন ভাষাটি মোটেই সুললিত কোনও ভাষা নয়–বরংচ তা স্থূল, কর্কশ এবং ব্যকরণের দিক থেকে ক্রটিপূর্ণ। কাজেই রোমানদের অনুকরণে লাতিন ভাষা ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করাটা মোটেই যথাযথ নয়। একইভাবে তিনি ইতালির এই চৌদ্দটি অঞ্চলের ভাষায় নানা খুঁত বের করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে এই ভাষাগুলোর একটাতেও আসলে সাহিত্য রচনা কারটা যথার্থ হবে না।
এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে: তবে কোন ভাষায় সাহিত্য রচনা করবে ইতালিয়রা? এই প্রসঙ্গে দান্তে আলিঘেইরি শেষতক ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলের ত্রোবাদুররা যে একটি কমন বা সাধারণ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন সেই দিকেই আমাদের দৃৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, এমন একটি সাধারণ ভাষার নাম দেয়া যেতে পারে 'ইতালিয় ভাষা' যা কিনা দেশটির কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষা নয়। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছেন, কমপক্ষে দু'শো বছর ধরে ইতালির উত্তর ও মধ্য অংশের ত্রোবাদুরদের হাতে বিবর্তনের মাধ্যমে এমন একটি সর্বসাধারণ সাহিত্যিক ভাষা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে যে ভাষাটিকে 'ইতালিয় ভাষা' বললে অত্যুক্তি হবে না এবং তা সাহিত্যকর্ম রচনায় ব্যবহার না-করার কোনও কারণ নেই। আমরা ইতোমধ্যেই বলেছি, উত্তর ও মধ্য-ইতালির জনপ্রিয় লোকসাহিত্য চর্চার মাধ্যমে গণমানুষের কবিদের হাতে গতিশীল প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল দান্তের নামাঙ্কিত এই তথাকথিত 'ইতালিয় ভাষা' যে ভাষায় সবচাইতে বেশি প্রভাব ফেলেছিল তোস্কানার ফ্লোরেন্স, সিয়েনা ইত্যাদি বড় বড় শহরের স্থানিক ভাষা।
'অন দ্যা ভালগার টাং'-এ দান্তে ইতালির সাহিত্যে গণমানুষের ভাষা প্রয়োগের যে যুক্তি হাজির করেছিলেন তা সাম্রাজ্যবাদী লাতিন ভাষার বিরুদ্ধে কোনও লেখকের প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ হিসেবে সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। সাহিত্যে গণমানুষের ভাষার পক্ষে এই সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই দান্তে আলিঘেইরি পরবর্তীতে তার 'কমেডিয়া' নামের প্রতিকাশ্রয়ী মহাকাব্য রচনা করার সময় গণমুখী নতুন একটি সাহিত্যিক ভাষা প্রযুক্ত করেছিলেন। মূলত তোস্কানার ফ্লোরেন্স, সিয়েনা ইত্যাদি বড় বড় শহরের স্থানিক ভাষাতেই 'কমেডিয়া' রচনা করেছিলেন দান্তে, তোস্কানার লৌকিক ভাষার সাথে তিনি সার্থকভাবে সিচিলিয়ার লৌকিক ভাষার সম্মিলনও ঘটিয়েছিলেন।
অবশ্য, সাহিত্যে একটি সর্বজনগ্রাহ্য ভাষা ব্যবহারের পক্ষে তোস্কানার আরেৎজো-এলাকার আরেকজন প্রথিতযশা দার্শনিক ও মধ্যযুগের শেষদিকের রোমান্টিক কবি–ফ্রানচেস্কো পেতরারকা (১৩০৪-১৩৭৪) পৃথকভাবে যুক্তি দিয়েছিলেন। দান্তের চাইতে বয়সে কিছুটা ছোটই ছিলেন তিনি। সত্য হোক বা মিথ্যেই হোক, তিনি দাবি করেছেন যে ১৩০৮-২০ সময়কালে রচিত দান্তের 'কমেডিয়া'-র সাথে তিনি মোটেই পরিচিত ছিলেন না। তবে ধারণা করি, সাহিত্যে গণমানুষের মুখের ভাষার ব্যবহারের প্রেক্ষিতে তোস্কানানিবাসী দান্তের অভীক্ষা সম্পর্কে হয়ত তার ধারণা থেকে থাকবে। যাই হোক, তোস্কানার গীতিকবিদের হাতে গড়ে ওঠা গণমানুষের মুখের ভাষাতে 'ফ্রাগমেন্টস অফ ভারনাকুলার ম্যাটার্স' (১৩২৭-৬৮) নামে কালজয়ী চানসোনিয়ে বা গানের বই (সং বুক) রচনা করেছিলেন ফ্রানচেস্কো পেতরারকা। তার এই গানের বইয়ের ৩৬৬টি গীতিকাব্যের ভেতরে রয়েছে মোট ৩১৭টা সনেট। ইতালিয় সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষদিকের আরেকজন রোমান্টিক কবি–তোস্কানার চেরতালদো-এলাকার জিওভান্নি বোক্কাচ্চিও (১৩১৩-১৩৭৫) তোস্কানার গণমাণুষের কবিদের হাতে গড়ে ওঠা লৌকিক ভাষাতেই লিখেছিলেন অনন্যসাধারণ গীতিকবিতা–তিরজা রিমা, ইল ফিলোকোলো, ইল ফিলোসত্রাতো, ওত্তাভিও রিমা, তেসিডা ইত্যাদি। এছাড়া তিনি একই অঞ্চলের ভাষাতে লিখেছেন তার সাড়া জাগানো নোভেল্লা–'ডেকামেরন' (১৩৫৩)। তিনি অবশ্য তার কাজের ওপরে দান্তের প্রভাব মোটেই অস্বীকার করেননি। আরও উল্লেখ্য যে এই জিওভান্নি বোক্কাচ্চিওই ১৩৭৩-৭৪-এ দান্তের 'কমেডিয়া'-র সৌন্দর্য নিয়ে পাবলিক লেকচার দিয়েছিলেন। সেটা ছিল দান্তের কাজের ওপরে কারও দেয়া প্রথম পাবলিক লেকচার।
মূলত, ইতালিয় সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষদিকের এই তিনজন রোমান্টিক কবি–দান্তে আলিঘেইরি, ফ্রানচেস্কো পেতরারকা এবং জিওভান্নি বোক্কাচ্চিও-র গীতিকবিতাগুলোই কালে কালে ইতালির সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি লিখিত ভাষার জন্ম দেয়, যদিও ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষায় ভাব প্রকাশের ভিন্নতা তখন রয়েই গিয়েছিল, এখনও সে ভিন্নতা আমাদের চোখ এড়ায় না। পনের এবং ষোল শতকে ইতালির রেনেসাঁর সময় জন্ম নেয় এমন একটি সর্বজনগ্রাহ্য লিখিত ভাষা। উদাহরণত, দান্তে, পেতরারকা এবং বোক্কাচ্চিও–এই তিন প্রতিভাধর সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের ভাষার সমন্বয়ে ইতালিয়দের মনের ভাব প্রকাশের জন্য আধুনিক একটি ভাষা তৈরির প্রস্তাব করেছিলেন ভেনিসের পিয়েত্রো বেম্বো (১৪৭০-১৫৪৭)। পরে, উনিশ শতকে, ইতালিয় উপদ্বীপের বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যের ইউনিফিকেশন বা একইভূতকরণ (১৮৪৮-৭১)-এর সময় এই সর্বজনগ্রাহ্য 'ইতালিয় ভাষা' মৌখিক ও লিখিত আনুষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে গৃহিত হয়।
এতক্ষণের দীর্ঘ আলোচনার সারাংশ টানা যায় এভাবে: উত্তর ও মধ্য-ইতালির, বিশেষত, তোস্কানা অঞ্চলের ত্রোবাদুর বা গণমাণুষের কবিরা যে লৌকিক ভাষায় গীতিকাব্য এবং আখ্যানগীতিকা রচনা ও পরিবেশনা করেছিলেন সেই ভাষাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ইতালিতে, ক্রমে ক্রমে ভেঙে পড়েছিল সাম্রাজ্যবাদী রোমানদের চাপিয়ে দেয়া লাতিন ভাষার নিগঢ়। রেনেসাঁর আগ আগ দিয়ে ত্রোবাদুরদের হাতে গড়ে ওঠা লৌকিক ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেছেন রেনেসাঁপূর্ব রোমান্টিক লেখক ও চিন্তক–দান্তে, পেতরারকা এবং বোক্কাচ্চিও। এই তিন প্রথিতযশা লেখকই ইতালিতে গণমানুষের মুখের ভাষার সাহিত্যকে এগিয়ে দিয়ে গেছেন।
পরবর্তিতে ইতালির গণমানুষের মুখের যে ভাষা সাহিত্যের নতুন ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল সেই ভাষা এবং ত্রোবাদুরদের কাব্যের ফর্মেরও প্রভাব আমার দেখেছি খোদ ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলের সাহিত্যে। এছাড়া দান্তে, পেতরারকা এবং বোক্কাচ্চিও-র পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে যাওয়া লৌকিক ভাষায় সাহিত্য রচনার সংস্কৃতির ব্যপক প্রভাব পড়েছিল সুদূর ইংলান্ডে। তাদের সমসাময়িক ইংলিশ কবি এবং কথাশীল্পি জিওফ্রি চসার (১৩৪৩-১৪০০)-এর কাজই তার প্রমাণ। জিওফ্রি চসারের 'দ্য ক্যান্টারবারি টেলস্' (১৩৮৭-১৪০০)-এ আমরা জিওভান্নি বোক্কাচ্চিওর নোভেল্লা 'ডেকামেরন' (১৩৫৩)-এর সুস্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাই। এই সময়টাতেই মূলত রোমান চার্চের মাধ্যমে দান্তে, পেতরারকা এবং বোক্কাচ্চিওর কাজ ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে যায়। এ-ও ধারণা করা হয়, ১৩৭৩ সালে ইতালিতেই পেতরারকা এবং বোক্কাচ্চিওর সাথে জিওফ্রি চসারের দেখা হয়েছিল। তারা তখন একান্তে পরস্পরের কাজ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন বলেও জানা যায়। গীতিকাব্য এবং আখ্যানগীতিকা রচনায় ইতালির গণমানুষের গীতিকবিদের ভাষা এবং ফর্ম এভাবে প্রভাবিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে ইংল্যান্ডের সাহিত্যকে এবং পরবর্তিতে ভারতবর্ষসহ ইংল্যান্ডরাজের আর সব উপনিবেশে প্রবাহিত হয়েছে সেই ধারা।