Published : 03 Feb 2022, 11:31 AM
এই সেই ইতিহাসের মহানায়ক যিনি—তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা—এই ভৌগোলিক সত্যে আস্থা রাখিয়া বাঙালির স্বপ্নকে নদী এবং নক্ষত্রের স্বপ্নের সাথে সমাঙ্গ করিয়া তুলিয়াছেন, যিনি ধর্মীয় সত্যে নয়, বরং ভৌগোলিকবৃত্তে ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক সত্যে, অর্থাৎ বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান লইয়া সবাই বাঙালি— এই বিশ্বাস রাখিয়াছেন, এবং যিনি তাঁহার সকল করণ- কর্মে বাঙালির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনকে সমগ্র জীবনের ব্রত করিয়া তুলিয়াছেন । বাঙালিকে ভালবাসিতে গিয়া তিনি তাহাঁদেরকে আপনার করিয়া লইয়াছেন; এবং সেই নিমিত্তে তাহাঁদেরকে আমার ভাই, আমার বোন, আমার মা বলিয়া সম্বোধন করিয়াছেন । মানুষ যখন প্রকৃত প্রেমিক হইয়া উঠে, তখন এই জৈব- তথা অজৈব-প্রকৃতির মধ্যে নিজের অধিষ্ঠান দেখিতে প্রয়াসী হইয়া উঠেন, এবং সেই নিমিত্তে তাহাঁদেরকে তুমি কিংবা তোমরা বলিয়া ডাকিতে ভালবাসেন, পরিশেষে বাংলার নদী, পাখি, মানুষ, ইত্যাদি লইয়া তাহাঁর শরীর স্বপ্নময় হইয়া উঠে, যাহাকে আমরা কালের খেয়া বলিয়া জানিয়া লইব ।
এই সেই স্বাপ্নিক যিনি সমগ্র মানবের মুক্তির লক্ষ্যে প্রথম যৌবনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করিয়াছেন, এবং মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র নির্মাণের নিমিত্তে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে আস্থা রাখিয়াছেন, এবং অবিভক্ত ভারত হইতে পাকিস্থান নামক রাষ্ট্রের জন্মকে স্বাগত জানাইয়াছেন; ধর্মভিত্তিক অপরাজনীতির অপদেবতা যখন তাঁহার মাতৃভাষা হরণ করিতে উদ্যত হইয়াছে, তখন তাঁহার রাজনীতি নদী, ঘাস, আর ভাঁটফুলের সমাঙ্গ হইয়া উঠিয়াছে । মাতৃভাষা যখন নিতান্তই মাতৃমুখ হইয়া উঠে, তখন মা, ভাষা, এবং মাতৃভূমি এক হইয়া উঠে । যখন শরীর, মন, অনুভব, এবং প্রেরণা এক হইয়া অসীমের পানে ধাবিত হয় তখন এই শরীর স্বপ্নময় কালের খেয়া হইয়া উঠে । এই আখ্যান স্বপ্নময় শরীর হইতে জাত, এবং যে শরীর হাজার বছরের বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হইতে উদ্ভুত ।
এই সেই বিদ্রোহী সত্তা যিনি বাঙালির ভাষা আন্দোলনকে কীভাবে যে রাজনৈতিক সংগ্রামের ছয় দফার আন্দোলনে রূপান্তরিত করিয়া তুলিয়াছেন, তাহা ইতিহাসের আরাধ্য বিষয় হইয়া থাকুক ; এবং সেই সত্যে তাহাঁর রাজনীতির সংগঠনের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ হইতে আওয়ামী লীগ হইয়া উঠিয়াছে । সেই নিমিত্তে বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান লইয়া সবাই বাঙালি, এবং তাহাঁর ভালবাসায় সিক্ত বাঙালি তাহাঁকে বঙ্গবন্ধু বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন । সেই কারণে ৭ই মার্চে রেসকোর্সের ময়দানের ভাষণে তিনি উদ্দাত্ত কন্ঠে আহ্বান জানাইয়াছেন— এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকের উপর হত্যা করা হয়, তবে তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল……রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ !… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…..জয় বাংলা । এই সেই মহাপ্রাণ যিনি তাহাঁর রক্তে বাঙালি জাতির রক্তের ঋণ শোধ করিতে দ্বিধান্বিত হয়নি; সেই নিমিত্তে তিনি মানবমুক্তির পরম স্বাপ্নিক হইয়া উঠিয়াছেন। আজ তাহাঁর স্বপ্নে বাহিত হইয়া আমরা বিশাদ্গ্রস্থ হইব, এবং কালের খেয়ায় আমাদের শরীর স্বপ্নময় হইয়া উঠিবে ।
শ্রাবণের এক শান্ত রাতে বিস্মিত আকাশের নীচে আমাদের প্রাণপ্রি্য় নেতা— যাহাকে আপামর বাঙালি ভালবাসিয়া বঙ্গবন্ধু অভিধায় আখ্যায়িত করিয়াছেন এবং যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে যিনি জাতির জনক হইয়া উঠিয়াছেন— যিনি তাহাঁর প্রিয় স্ত্রী, পুত্র এবং পুত্রবধূ পরিবেষ্টিত হইয়া যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, বন্যা- কবলিত, দুর্ভিক্ষ-পীড়িত দেশের মানুষের কথা ভাবিয়া ব্যথিত হইয়াছেন, এবং সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির সাথে দেশের কুচক্রীর ষড়যন্ত্রের কথা ভাবিয়া শুধুমাত্র বাঙালি নয়, বরং সমগ্র মানবের মুক্তির কথা চিন্তা করিতে যাইয়া ক্লান্ত দেহে শুইয়া পড়িয়াছেন । সেইদিন শ্রাবনের ব্যথিত আকাশ লইয়া ঢাকা মহানগরীর রাস্তা ছিল আপাত শান্ত, কারণ সংসারী মানুষেরা তাহাদের অবিন্যস্ত, আশাহীন জীবন রাতের ঘুমের উপরে ন্যস্ত করিয়াছেন । আর আমাদের সেই স্বপ্নদ্রষ্টা, সেই অবিসংবাদিত নেতা ঘুম এবং জাগরণের মাঝে সমগ্র বাঙালির ইতিহাস পরিক্রম করিয়া চলিয়াছেন । তাহাঁর ঘুম এবং জাগরণের মাঝে যে ছায়াচিত্রের জন্ম হইল, তাহা আমাদের ব্যথিত করে, এবং আমাদের শরীরকে স্বপ্নময় খেয়াতরী করিয়া তোলে ।
এই সেই মহাপ্রাণ যিনি বাঙালি জাতির মুক্তির অগ্রদূত হইয়া ঘুম এবং জাগরণের মাঝে হাস্যোজ্জ্বল আকাশের নীচে পিতার হাত ধরিয়া মধুমতী নদীর তীরে আসিয়া তিনি নিজের শৈশবকে দেখিতে পাইলেন, যেখানে নদীতীরে তাঁহারই মত অনেক বালক কলহাস্যে নদীতে স্নানরতা মাতৃহৃদয়কে প্লাবিত করিয়া চলিয়াছে । আকাশে ভাসমান শাদা-শুভ্র মেঘ আপাত শান্ত নদীতে প্রতিফলিত হইয়া বহুদূরগামী হইয়া উঠিতেছে । নদীতীরে শান্ত জনপদ তাহাদের নিত্যকর্মে শহরকে ক্রমাগত মুখরিত করিয়া চলিয়াছে । প্রজাপতির পিছে ধাবমান তিনি প্রকৃতিরাজ্যে স্বপ্নময় হইয়া ঊঠিয়াছেন, কিন্তু অচিরেই প্রজাপতিটি তাহাঁর দৃষ্টির অগোচরে চলিয়া যাইতে দেখিলেন । তাহাঁর খেলার সঙ্গী করিবার নিমিত্তে যখন পিতাকে খুঁজিতে উন্মুখ হইলেন, তখন আকাশের শুভ্র মেঘ ক্রমশ অন্ধকার হইয়া উঠিতে লাগিল, নদীতীরে হাস্যময় শিশু, কিশোর, কিশোরীদের তিনি আর দেখিতে পাইলেন না । মধুময় বাতাস ক্রমেই অশান্ত হইল, এবং শান্ত মধুমতী নদী ক্রমশই ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ হইয়া উঠিতে লাগিল । আমাদের প্রানপ্রিয় মহানায়ক, যিনি সময়ের এইক্ষণে নিতান্তই বালক, তিনি তাহাঁর পিতাকে খুঁজিয়া পাইবার নিমিত্তে ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছেন, এবং অবশেষে মধুমতি নদীর অপর তীরে তাহাঁর পিতাকে দেখিতে পাইলেন । নদীতীরে বাঁধা ছোট্ট একটি নৌকা অস্থির, এবং দিগন্তে ভাসিয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত । সময়ের সেইক্ষণে তিনি নৌকায় চাপিয়া বসিলেন, এবং দৃঢ়হস্তে বৈঠাকে হাতে লইলেন, কিন্তু নদীতে হঠাৎ যেন তুফান উঠিল, এবং নদীর জল কৃষ্ণকায় হইতে লাগিল । অশান্ত, বেগময় তীব্র নদীতে বালক নৌকার হাল ধরিয়া রাখিতে পারিলেন না, এবং তীব্র গর্জনশীল নদী, যাহা এই মুহূর্তে অন্ধকারাচ্ছন্ন, বুদ্ধির অগম্য, তিনি অনন্তের পানে ভাসিয়া যাইবার আগে এক ক্ষণ মুহূর্তের জন্য পিতৃমুখকে দেখিতে পাইলেন। ঘুম এবং স্বপ্নের মাঝে বাঙালি জাতির প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা এবং রূপকার হঠাৎ তীব্র শব্দে ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিলেন, এবং বুঝিলেন— এই শব্দ শ্রাবণের বিস্মিত আকাশের নীচে অন্য এক উন্মদনা যাহা ক্রূর এবং ভয়াল । তিনি তাহাঁর ঘুমের ঘর হইতে বাহির হইয়া দ্বিতল বিশিষ্ট দালানের সিড়ি ভাঙ্গিয়া নীচে নামিতে লাগিলেন, এবং দেখিলেন একদল জান্তব সৈনিকরা গুলিতে তাহাঁর অসংখ্য প্রিয়জনকে হত্যা করিয়া চলিয়াছে এবং তিনি বুঝিলেন—আজ তাহাঁর শরীর হইতে প্রবাহিত রক্ত হাজার বছরের সংগ্রামী এবং আত্মত্যাগী বাঙালির সাথে শ্রাবণের বিস্মিত আকাশের নীচে একইভাবে প্রবহমান হইয়া চলিবে ।