Published : 10 May 2016, 06:03 PM
১৯ জানুয়ারি ২০২২।
পার্থিব যাপন সংবরণ করলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পঁচাশি বছর মানে পরিণত বয়সই। কিন্তু মাসুদ রানার স্রষ্টার বয়স তো রানারই সমান। চির সবুজ, চির নবীন।
মাসুদ রানা।
আরও অনেকের মতো আমার পাঠক জীবনের এক শিহরণময় স্মৃতিকাতর নাম। যৌবনেই একসময় পাঠকের মৃত্যু হয়েছিল, মাসুদ রানা পড়বার আকর্ষণ আর থাকেনি। কিন্তু যে সময়কাল ব্যেপে মাসুদ রানা পড়তে শুরু করেছিলাম, মাসুদ রানার সাথে মানস-বিহার করেছিলাম, সেই সময়ের স্মৃতি, রোমাঞ্চ, উদ্দীপনার সারাংশ আমার সত্তায় মিশে আছে। এখনও তা উদ্বেলিত করে মনের কোনো-কোনো প্রান্তকে।
সেই বাল্যবেলায় প্রথমে পড়তে শুরু করেছিলাম দস্যু বাহরাম ও দস্যু বনহুর সিরিজ। দস্যুতার পর্ব শেষ করার আগেই মাসুদ রানার সাথে পরিচয় ঘটলো। দস্যুরা ক্রমে বিদায় নিলে, অধিকার করে রাখলো এই সিক্রেট এজেন্ট। বইগুলো পড়ে উঠবার আগে নামগুলো পড়েই রোমাঞ্চিত। স্পষ্ট মনে পড়ছে, বাল্যের এক ঝিমধরা দুপুরে একটি পেপারব্যাকের পুস্তানিতে নামগুলো পড়ছি : ধ্বংস পাহাড়, ভারতনাট্যম, স্বর্ণমৃগ, দুঃসাহসিক, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, দুর্গম দুর্গ, শত্রু ভয়ঙ্কর… আর শিহরিত হয়ে উঠছি। ক্রমে বইগুলো নাগালে আসে, পড়তে থাকি মুগ্ধ আবেশে।
রোমাঞ্চোপন্যাসের নিজস্ব আকর্ষণ তো আছেই, উপরন্তু লেখকের পরিশীলিত ভাষাশৈলী এবং বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধের প্রকাশ বইগুলোকে আনন্দময় করে তুলতো। উপরন্তু, কত কিছুই না শিখেছি! কারো হয়তো অবিশ্বাস হতে পারে, কিন্তু আমি নোটবুকে লিখে রাখতাম একেক খণ্ড মাসুদ রানা পড়ে যা শিখতাম। কত যন্ত্রপাতি, অস্ত্র, ভৌগোলিক বিষয় বা স্থানের নাম, অপরাধবিজ্ঞান বা সমরবিদ্যার বিষয়, মার্শাল আর্ট কিংবা বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ধারণা, কত দেশের কথা, খাদ্য বা পানীয়ের বিবরণ….কত কত তথ্য কিংবা ধারণা শিখেছি এইসব নেহাত বিনোদনের বই থেকে। দেশপ্রেম, আদর্শবাদ, নিষ্ঠা, সাহস, ন্যায়পরায়ণতা — এমনতর ইতিবাচক বিষয়ে প্রণোদনা জাগিয়েছে এইসব 'আজেবাজে' গ্রন্থরাজি। তাছাড়া, লেখকের মুক্তভাবনার মানসও মাসুদ রানার মধ্য দিয়ে দ্যোতিত হয়ে প্রেরণা দিয়েছে।
আলোকচিত্র: কাজীদার সাথে আমার এই ছবিটা ১৯৮৭ সালে তুলেছিলেন আলোকচিত্রশিল্পী এম এ তাহের
কাজী আনোয়ার হোসেন। কী এক জাদুকরি শক্তিতে বলীয়ান লেখনীর অধিকারী মানব। তার সম্পর্কে জানতে পারি যখন বিচিত্রা তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি প্রকাশ করে। কিন্তু তার সাথে দেখা করতে যাই আরও অনেক পরে। ৮৭ সালে একদিন আলোকচিত্রী এম এ তাহেরকে নিয়ে — তাহের তখন বেগ সাহেবের কাছে সদ্য ফটোগ্রাফি কোর্স করে আলোকচিত্র নিয়ে কী করা যায় ভাবছেন — সেগুনবাগিচায় তার অফিস বা লেখার ঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকেই শুনতে পেলাম ক্যাসেট প্লেয়ারে সেতার বাজছে অনতি-উচ্চস্বরে। মুহূর্তেই মনটা অন্য এক বিশ্বে বিলগ্ন হয়ে গেল। সেই বিশ্বের সম্রাট ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন, তার স্মিত আভিজাত্যে দীপ্যমান।
আমার আবাল্য ঘনিষ্ঠ বিষয় কবিতার অনুষঙ্গও পেয়েছি মাসুদ রানায়। একটি বইয়ে (ভারতনাট্যম-এ বুঝি!) রবীন্দ্রনাথের 'কাছে এল পুজোর ছুটি/রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপা ফুলের রঙ' — এমন কবিতাংশ মনে পড়েছিল রানার। মনে পড়ছে, 'আমার কৈশোর দীর্ঘ ঘুমের ভিতরে নীল জল/পর্বতপ্রমাণ ঢেউ, সামুদ্রিক জাহাজ, মাস্তুল…' রফিক আজাদের এই কবিতাংশ প্রথম পড়ি মাসুদ রানাতেই, পরে কবিতাটা পেতে কমলাপুর স্টেশনের ক্যামেলট বুক স্টল হতে রফিক আজাদের কাব্য চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া বইটি কিনে আনি।
আমার সাম্প্রতিক কালের একটি প্রিয় বিষয় হলো ফটোগ্রাফি। ছবি তোলার টেকনিক্যাল বিষয়ের শব্দের সাথে প্রথম পরিচিত হই বাল্যকালের শিহরণ জাগানো সিরিজ গ্রন্থ 'মাসুদ রানা' পড়েই। যতদূর মনে পড়ছে, 'ভারতনাট্যম' বইটিতে রানা প্রেস ফটোগ্রাফারের ছদ্মবেশ নিয়েছিল। সেখানে ক্যামেরার নাম, অ্যাপার্চার, শাটার স্পিড, ডেপথ অব ফিল্ড, ফোকাস, ফ্লাশ — এইসব টার্ম প্রথম জানতে পেরেছিলাম। সব কিছু ভালো বুঝতে পারি নাই বলে অস্বস্তি লেগেছিল, একথা মনে পড়ছে। ছবি তুলবার সুপ্ত আগ্রহ হয়তো তখন গোপনে অঙ্কুরিত হতে শুরু করে।
সাম্প্রতিক সময়ে কমবেশি ভ্রমণ করছি সুযোগ পেলেই। ভ্রমণের এষণাও মাসুদ রানা পড়ে উদ্দীপ্ত হয়েছিল চিত্তে। দেশ ও বিদেশের কত না বিচিত্র এলাকায় মানস-ভ্রমণ করেছি মাসুদ রানার সাথে। সেইসব অনুভব মিশে আছে স্নায়ুতন্ত্রীতে এখনও।
মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলোয় একটা ট্যাগ থাকত : 'প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য'। এটা ওই সিরিজটার প্রতি বাড়তি আকর্ষণ তৈরি করত নিশ্চয়ই। আর আমরাও বাল্যকালেই যৌনাচরণের বর্ণনা পড়ে উষ্ণ হয়ে উঠতাম। আবার এই বই পড়ার কারণে কোনো-কোনো মুরব্বি ভর্ৎসনা করতেন, কেন বড়দের বই পড়ি? বখে গেছি বলেও ধরে নিতেন কেউ। আমাদের সমবয়সী বন্ধুরাও অনেকে এই নিয়ে সমালোচনা করত।
তবে আমার আব্বা এসব বই পড়া নিয়ে কখনও কিছু বলেন নাই। বরং তিনিই আমার সংগ্রহের কোনো-কোনো বই পড়তেন। তিনি ইংরেজি থ্রিলার পড়তেন : জেমস হাডলি চেইজ, আর্ল স্ট্যানলি গার্ডনার, আয়ান ফ্লেমিং, আলফ্রেড হিচকক, আগাথা ক্রিস্টি আরও কত কি। তার কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলাম যে স্বর্ণমৃগ বইটি ফ্লেমিং-এর গোল্ড ফিংগার বা নীল ছবি চেইজের দ্য হুইফ অব মানি বইয়ের ছায়া অবলম্বনে লেখা ইত্যাদি।
একসময় মাসুদ রানা সিরিজ হতে 'প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য' ট্যাগটি বাদ দেওয়া হয়, কারণ কিশোর পাঠকেরাই এই বই বেশি পড়ে। তখন থেকে সিরিজের বইগুলোয় আর যৌনাত্মক বর্ণনা দেওয়া হয় না। সম্ভবত আগের বইগুলোও কিঞ্চিৎ সেন্সর করা হয়।
মাসুদ রানা ছাড়াও অনবদ্য কিছু গল্প-কাহিনি রূপান্তর করেছেন তিনি। ছয় রোমাঞ্চ', পঞ্চ রোমাঞ্চ, ছায়া অরণ্য, তিনটি উপন্যাসিকা ইত্যাদি সংকলনে ওইসব কাহিনি আছে। গল্প হিসেবেও যেমন চমকপ্রদ ভাষাশৈলীও তেমনি মনোমুগ্ধকর। এইসব গল্প আগ্রহী পাঠকের জন্য দারুণ এক আনন্দের সমারোহ।
মোটিভেশনাল বই এখন ফুচকার চেয়েও জনপ্রিয়। এ দেশে মোটিভেশনাল বইয়ের প্রথম সফল লেখক কে? কে আবার! কাজীদা। কাজী আনোয়ার হোসেন। ওই বইগুলো তিনি বিদ্যুৎ মিত্র নামে লিখতেন। নিজেকে জানো, আত্ম উন্নয়ন, সুখ সমৃদ্ধি ইত্যাদি। কী চমৎকার ভাষাশৈলী তাঁর। আর কত-না উদ্দীপক!
এখনকার রমরমা মেডিটেশনের বইও তিনিই প্রথম লিখেছেন। সিলভা মেথড সম্পর্কে তাঁর বই থেকেই প্রথম জানি। তার আগে আত্মসম্মোহন বিষয়ে।
তাঁর আত্মসচেতনতামূলক একটি বইয়ে পড়া একটি উক্তি হঠাৎ মনে পড়ে গেল : "মানুষের ভয় মানুষকে মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখে।" ভয়ের বিপরীত হলো ভালোবাসা। ভালোবাসা ভয় দূর করে। ভালোবাসা নৈকট্য স্থাপন করে। ভালোবাসা ভরসা জাগায়। ভালোবাসার কথাই বলেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন তার বিভিন্ন বইতে।
জীবনের অন্তিম পর্বে এসে লেখক শেখ আবদুল হাকিমের সাথে কপিরাইট বিষয়ক এক অপ্রীতিকর মামলার মুখোমুখি হন। একথা তো আমরা জানতাম যে প্রথম কয়েকটি বই তার নিজের কৃত। এরপর, এই বইগুলোয় তিনি যে ভাষা-শৈলীর অবতারণা করেন সেটি বজায় রেখে, অন্য লেখক বিদেশি বই অবলম্বনে মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলো লিখতেন, কাজীদা সম্পাদনা করতেন এবং বই কাজী আনোয়ার হোসেনের নামেই প্রকাশিত হতো। ঘোস্ট রাইটারের সাথে প্রকাশনালয়ের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল সেটা। এইসব মামলার ঘটনা শেষ সময়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ণ করলেও তার সৃষ্টির মহিমা লাঘব করে না। যারা মাসুদ রানা পড়েছে, উপভোগ করেছ, পড়বে, তাদের হৃদয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন একটি উজ্জ্বল প্রদীপের মতো আলোকময় রয়ে যাবেন।
কাজী আনোয়ার হোসেন ইজ ডেড : লং লিভ, কাজীদা।