Published : 20 Jul 2021, 07:54 PM
বইয়ের নাম: ঝিনুক নীরবে সহো
(আবুল হাসান-এর জীবনীভিত্তিক ডকু-ফিকশন)
লেখক: মোশতাক আহমদ
প্রকাশক: পেন্ডুলাম প্রকাশনী
এই বইয়ের প্রথম বাক্যটিই পাঠককে ডেকে নেবে বিষণ্ণ গীতল এক জগতে, যেখান থেকে পাঠক আর বেরুতে পারবেন না সমাপ্তিতে না পৌঁছে। বিশেষ করে সেই পাঠক নিজেও যদি হন কবিতাগ্রস্ত, রোমান্টিক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত, জীবনযাপনের সাথে যিনি খুঁজে পাচ্ছেন না কবিতার সহাবস্থান, তাহলে তার জন্য এই গ্রন্থটি জাদুকরী এক সম্মোহন। সেইসাথে সেই মানুষরাও, শিল্প-সংস্কৃতির সাথে যাদের সামান্যতম সংস্রবও আছে, তারা পাবেন নিজের জীবনের গোপন দীর্ঘশ্বাসগুলোর সাথে সম্পৃক্তি। কারণ এই ডকু-ফিকশনের কেন্দ্র-চরিত্র বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার সবচাইতে স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল, সুদীর্ঘ স্বপ্নদেখা অথচ ক্ষীণায়ু জীবনের এক কবিকে নিয়ে, যার নাম আবুল হাসান।
স্বল্পায়ু অথচ সাহিত্যে সাড়াজাগানো কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা খুব কম নেই পৃথিবীতে। আমরা তো কথায় কথায় কীটস-কাফকার নাম উচ্চারণ করি। উচ্চারণ করি আমাদের ভাষার কবিকিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং কথাসাহিত্যিক সোমেন চন্দ-র কথাও। তবে আবুল হাসানকে আমাদের কবিতাপাঠকরা তাদের তালিকাতে রাখলেও কবিজীবন নিয়ে লেখালেখি খুব কমই হয়েছে বলতে হবে। অন্তত আবুল হাসানের স্বল্পায়ু জীবনটি যে শুধুমাত্র কবিতার প্রতিই নিবেদিত ছিল, এই তথ্যটি কেউ কেউ জানলেও বেশিরভাগ বাংলাভাষীর অজানা। এত অল্প সময়ে কবিতায় এতটা সিদ্ধি অর্জন, সেইসাথে সমকালীন পাঠকের নিতান্ত আপন অবশ্যপাঠ্য হয়ে ওঠা, সমকালের অগ্রজদের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক স্বীকৃতিলাভ আবুল হাসানের পরে আর কারো ভাগ্যে জোটেনি। এইসব প্রাপ্তিতে তৃপ্ত বোধ করার কথা। কিন্তু এই ডকু-ফিকশন পাঠে আমরা জানতে পারব বিশাল অতৃপ্তির হাহাকার নিয়ে অকালে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছে আবুল হাসানকে। কারণ মৃত্যুমুহূর্তেও তিনি নিজেও জানতেন বাংলাকবিতাকে তার দেবার ছিল আরো অনেক। বাংলাকবিতার সৌরবিশ্ব খুঁজে খুঁজে আনতে চেয়েছিলেন অনেক নতুন সুর। নিজেই কবিতাতে লিখেছেন সেকথা–
'আনবো অঢেল উষ্ণ মহাকাল, বসন্ত বৈকাল,
উড়ু উড়ু সমুদ্রের হাওয়া,
বৈদেশিক বাণিজ্যে টাওয়ার বাক্সে টোকা দিয়ে
আনবো আলোর নতি, নীল মুদ্রা, মৈত্রী ও বসতি।'
০২.
বরিশালের ঝনঝনিয়া গ্রাম থেকে ঢাকায় পা দিয়েছিল এক সদ্য তরুণ। সালটা ১৯৬৫। ঢাকায় আসার পোশাকি কারণ ছিল বিশ্বদ্যিালয়ে ইরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়া। ভর্তি হয়েছিলও সে। কিন্তু ডিগ্রিটা নেওয়া হয়নি। কারণ সে তো ঢাকাতে এসেছিল কবি হবার জন্য। সে ছিল কোরআনে হাফেজ। পরবর্তীতে ধর্ম-কর্ম ত্যাগ করলেও তেলাওয়াতের সুরটা কখনোই ত্যাগ করেনি তাকে। তাই যে কোনো সুরের প্রতিই তার ছিল প্রবল আকর্ষণ। সে কারণেই তার কবিতা হয়ে উঠল কি অসামান্য সুরেলা; যখন তিনি আবুল হোসেন মিয়া থেকে আবুল হাসান হয়ে উঠলেন?
প্রথম কবিতা লিখেছিলেন আবুল হোসেন নামে। শামসুর রাহমান কবিতাটি পড়তে গিয়ে দেখলেন এই কবির ভাষাকে তো মেলানো যাচ্ছে না 'নববসন্ত'-র কবি আবুল হোসেনের সাথে। সাক্ষাৎ হলে তীর্যকভাবে বলেছিলেন, পূর্বজ কবিদের সম্পর্কে কিছু না জেনে কি কবিতা লিখতে আসা ঠিক? আবুল হোসেন নামের কবি এখনো বাংলাদেশের কবিতার জগতে দাপটের সাথে লিখে যাচ্ছেন। সেখানে একই নামে লেখালেখি করা উচিত নয়।
সমাধান দিলেন রফিক আজাদ। আবুল হোসেন তার হাতে হয়ে গেলেন আবুল হাসান।
তারপর তো অজস্র অনর্গল কবিতার প্রসব। আর চারদিকে নাম ছড়িয়ে পড়া।
অল্পদিনেই কোরআনের হাফেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হয়ে উঠলেন বোহেমিয়ান, উড়নচণ্ডী, ধূমপায়ী, মদ্যপায়ী, বেশ্যাগমনকারী। কেন এই রূপান্তর? কেউ হয়তো বুঝিয়েছিল, কবি হতে হলে এমনটাই হতে হয়। জীবনের ধারাটিকে এইভাবেই প্রবাহিত করতে হয়। [যার বা যাদের প্ররোচনায় এইভাবে জীবনের খাতটিকে অপচয়ের দিকে ধাবিত করলেন, হাসানের অকাল মৃত্যুর জন্য সে বা তারাই দায়ী। কৈশোরে বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভারে আক্রান্ত হাসানের পূর্ণ চিকিৎসা হয়নি। তার হৃদযন্ত্রে, বিশেষ করে হার্টের ভাল্বগুলোতে জটিল রোগ সৃষ্টি হবার আশঙ্কা থেকেই গিয়েছিল। তার জীবনযাপন, নেশা, খাবারে অনিয়ম, ঠিকই সেই মৃত্যুবান নিক্ষেপ করেছিল হাসানের হৃদপিণ্ডে। তাতেই তার মৃত্যু ১৯৭৫ সালে। যদিও আবুল হাসান কাউকে দায়ী করে যাননি।]
কবি হবার জন্য সবকিছু করেছেন হাসান। কলেজজীবনে বরিশালের প্রেমিকা রাজিয়া সুলতানা রাজিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। একবারও দেখা করেননি। কোনো উত্তর লেখেননি রাজিয়ার চিঠির। কবিতা ছাড়া অন্য কোনো প্রেমিকা চাই না তার। নির্মলেন্দু গুণের সাথে একরাতে গিয়েছিলেন ইংলিশ রোডের শুঁড়িখানায়। সেখানে গুণ বললেন 'তোমার লাইফ পোয়েট্রি। আমার লাইফও পোয়েট্রি। কিন্তু রাজিয়ার লাইফ জিওমেট্রি। পোয়েট্রি এন্ড জিওমেট্রি নেভার লিভ টুগেদার।' হাসানেরও পূর্ণ সম্মতি– 'পোয়েট্রি এন্ড জিওমেট্রি নেভার লিভ টুগেদার। চিয়ার্স।'
পরবর্তীতে নিজেকে বা সেই প্রেমিকাকে সান্তনা দিতেই কি লেখেন?:
'এই কবিতা তোমার মতো সহজ থাকুক সুশিক্ষিতা
এর গায়ে থাক রাত্রি জাগার একটু নাহয় ক্লান্তি হলুদ,
জিভ দিয়ে জিভ ছোঁয়া চুমুর গন্ধ থাকুক এই কবিতায়।'
নির্মলেন্দু গুণ ময়মনসিংহের বারহাট্টা থেকে পাকাপাকি ঢাকায় চলে এলে শুরু হয়েছিল দুই কবির বন্ধুত্বের এক আশ্চর্য অধ্যায়। তারা একসাথে দিন কাটান। রাত কাটান কমলাপুর রেলস্টেশনে, সদরঘাটের কোনো নৌকায়, রমনা পার্কে। রাতে রাস্তায় চলতে চলতে কোনো কবি বা লেখকের ডেরা চিনতে পারলে সটান ঢুকে পড়েন সেই বাড়িতে বা মেসে– আজ আমরা রাতে এখানেই থাকব।
রাহাত খান লিখেছিলেন– 'এই তরুণ কবিদ্বয় ঢাকা শহরের কখন কোথায় থাকেন, কখন কী খান, তারা নিজেরাও তা জানেন না। তাদের জন্য ঢাকা শহরের অনেক বাসাতেই রান্না হয়। অনেক সময় ইটের বালিশে মাথা পেতে তারা পথের পাশে, রেলস্টেশনে, মসজিদে রাত কাটান। ওরা মনে করেন ইটের বালিশে ঘুমালে কবিদের মাথা শক্ত হয়।'
শুঁড়িখানাতে বসেই দু'জনে লিখলেন 'বোহেমিয়ান কবির সংবিধান'। তাতে লেখা ছিল–
"আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে পড়ব, ক্লাস করব, ঘুরব-বেড়াব, কিন্তু ডিগ্রি লাভের চেষ্টা করব না পরীক্ষা দেব না বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরী মেয়েদের সাথে প্রেম করার চেষ্টা করব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারব।
সতীর্থ হিসাবে যে বন্ধু-মহলটি গড়ে উঠবে, আমাদের অন্ন-বস্ত্র এবং বাসস্থানের অভাব পূরণ করার জন্যে তাকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় নাম লেখাতে বিনিয়োগকৃত টাকা উসুল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা ব্যবহার করব, আমাদের কবিতা রচনা, প্রকাশ ও প্রচারের জন্য। যেহেতু আমরা উপার্জনমুখী বিদ্যা আয়ত্ত করছি না, সেহেতু আমাদের জীবন হবে অনেকটাই পরনির্ভর, বন্ধু-নির্ভর, ভক্ত-নির্ভর, পৃষ্ঠপোষক-নির্ভর।"
এই সংবিধান মেনেই কি হাসান যখন যাকে সামনে পেতেন হাত পাততেন তার কাছে? সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কামাল বিন মাহতাব, রাহাত খান, আহমদ ছফার কাছে? আহমদ ছফা নিজেরই নিয়মিত উপার্জনের কোনো পথ ছিল না। তার প্রথম উপন্যাস ছাপা হবে। প্রকাশকের কাছ থেকে অগ্রিম দেড় হাজার টাকা নিয়ে এসেছেন। রাতে শশাঙ্ক পালের সাথে তার ঘরে উপস্থিত আবুল হাসান। ভার্সিটির পরীক্ষার ফি দিতে না পারায় পরীক্ষা দিতে পারবেন না। নাম কাটা গেছে পরীক্ষার্থীর তালিকা থেকে। ছফা তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিলেন সাড়ে তিনশো টাকা। বললেন যে অর্থাভাবে তারও ইউনিভার্সিটি থেকে নাম কাটা পড়েছিল বলে প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষা দিচ্ছেন। তিনি চান না হাসানকেও তার ভাগ্য বরণ করতে হোক। দুইদিন পরে আবার হাসান উপস্থিত। আরো একশো টাকা লাগবে। সেমিস্টার ফি দিতে হবে। নইলে পরীক্ষায় বসতে দেবে না। ছফা এবারও টাকা দিলেন। কিন্তু হাসান পরীক্ষা দিলেন না। লিখলেন কবিতা–
'ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেপ সমস্ত কাগজ।
আমি বাজে ছেলে, আমি লাস্ট বেঞ্চ, আমি পারবো না!
ক্ষমা করবেন বৃক্ষ, আপনার শাখায় আমি সত্য পাখি বসাতে পারবো না!'
এতকিছুর পরেও সবাই হাসানকে ভালোবাসতেন। কারণ আর কিছুই না। হাসানের কবিতার অজস্রতা আর অনন্যতা। নিউ মার্কেটের নলেজ হোমে পেঙ্গুইন সিরিজের ইংরেজি কবিতার বই দেখতে দেখতে অন্যমনস্কতার ভঙ্গি করে বই হাতে হাসান বেরিয়ে গেলে বিব্রত জাহিদুল হক গেলেন বইয়ের দাম দিতে। মালিক মজলিশ সাহেব হেসে বললেন– আপনারাও আগে আবুল হাসানের মতো কবিতা লিখুন। তারপরে অন্যমনস্কতার ভঙ্গি করে বই হাতে বেরিয়ে গেলে আপনাদেরও কিছু বলব না।
০৩.
মালিটোলার গণিকাপল্লী উচ্ছেদ করা হচ্ছে। গঠিত হয়েছে উচ্ছেদ কমিটি। তারা সভা-সমিতি করে বেড়াচ্ছে। আবুল হাসান প্রস্তাব করলেন এই উচ্ছেদের প্রতিবাদে সেখানে গিয়ে সাহিত্যসভা করার। হাসানের সাথে যোগ দিলেন শশাঙ্ক পাল, ভুঁইয়া ইকবাল, আবু বাকার, আলী ইমাম, শামসুদ্দিন আসালত, শাহযাদ ফিরদাউস, বুলবুল চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন। সেখানে কবিতাপাঠ হলো, গান হলো, গণিকাদের অধিকারের কথা উচ্চারিত হলো। তাদের সাথে যোগ দিয়ে গান গাইলেন যৌনকর্মীরাও। লেখক-কবিদের এই সংহতি এই ভালোবাসা এই মানবিকবোধ চোখে জল এনে দিয়েছে যৌনকর্মীদের। অনুষ্ঠান শেষে তারা সাধ্যমতো আপ্যায়ন করল কবিদের।
বাংলাদেশের কবিদের এমন অভিনব সাহিত্যসভা আগেও কখনো হয়নি। পরেও না।
হাসান যৌনবর্মীদের দেখতেন কবিসুলভ মমতার দৃষ্টিতেই। একটি চিঠিতে লিখেছিলেন– 'আমি বেশ্যালয়ে গমন করেছি হয়তো– তাদের স্তন স্পর্শ করেছি– চুমো খেয়েছি কিন্তু মমতায়; আমি পাপ করিনি তাদের সাথে'।
হাসান কখনো মিছিলে যাননি। ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের সময়ও না। আড্ডা দিতে দিতে নির্মলেন্দু গুণ উঠে গিয়ে মিছিলে যোগ দিতেন। রাজনীতি নিয়ে হাসানের আগ্রহ নেই। কিন্তু স্বাধীকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে তো কোনো প্রকৃত কবি নীরব থাকতে পারেন না। হাসানও সেই সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন তার মতো করেই। কবিতা তো লিখেছেনই, সেইসাথে বিভিন্ন পত্রিকায় জোরালো কলাম লিখেছেন বাঙালির ন্যায্য অধিকারের সপক্ষে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। কিন্তু ১৯৭৩-৭৪ এর মাৎসন্যায় এবং দুর্ভিক্ষ বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতে বাধ্য করেছিল তাকে। সত্য বটে, সেই সময় জাসদ, সর্বহারা পার্টি, নকশালপন্থী বিভিন্ন গ্রুপ দেশজুড়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছিল। তবে একই সাথে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, পারমিটবাজি, নেতাদের অযোগ্যতা, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার মিলে মানুষকে দুঃসহ অবস্থায় নিপতিত করেছিল। ছাত্রলীগের সমালোচনা করায় সেই সময়ের আরেক বোহেমিয়ান কবি গোলাম সাবদার সিদ্দিকীকে বিচারের সম্মুখীন করেছিল ছাত্রনেতারা। অনেকের অনুরোধে লঘু শাস্তি পেয়েছিলেন সাবদার সিদ্দিকীকে। তা হচ্ছে কবিকে শাহবাগে প্রকাশ্যে নগ্ন দাঁড় করিয়ে রাখা। দুর্ভিক্ষের সময়েও অভুক্তদের লঙ্গরখানা থেকে চালচুরির ঘটনা ঘটছিল অহরহ। সহ্য করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধা, মুজিবের অন্ধভক্ত, কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন– 'ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো'। সেজন্য তাকে বিপদে পড়তে হয়েছিল।
আবুল হাসান পরোক্ষে বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে অভিহিত করে লিখেছিলেন কবিতা–
'হে অর্জুন আমি জানতাম, আমি ঠিকই জানতাম
আমি শিশুহত্যা থামাতে পারবো না, যুবতী হত্যাও নয়
…
চালের আড়ত থেকে অভিনব চালচুরি থামাতে পারবো না
রিলিফের কাপড়ে আমি মানুষের অধঃপতন ঢাকতে পারবো না
…
ভাই পলায়নে যাবে, বোন তার বাসনা হারাবে আমি জানতাম
ফুল ফুটবে না, ফুল ফুটবে না, ফুল আর ফুটবে না, ফুল আর কখনো ফুটবে না।
বকুল বৃক্ষদের এইভাবে খুন করা হবে সব গীতিকার পাখিদের
এইভাবে গলা, ডানা, স্বরলিপি শব্দের পালকগুলি
ভেঙে দেওয়া হবে, আমি জানতাম।'
কোনোদিন রাজনীতিতে নাম না লেখানো আবুল হাসান ১৯৭৫ সালে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য সুরাইয়া খানমের প্ররোচনায়। সেই সময়টিতে সুরাইয়া খানমের কোনো কথা ফেলে দেওয়া হাসানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবুল হাসান-সুরাইয়া খানম আখ্যান ছিল সেই সময়ের আলোচিত ঘটনা।
সুরাইয়া পরমাসুন্দরী, বিদুষী, পোশাকে-আসাকে ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে এসেছেন, ঢাবা ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক, কবিতা লেখেন ইংরেজি ও বাংলায়, পছন্দের বাংলা কবিতা অনুবাদ করেন ইংরেজিতে, মেশেন শিল্পসাহিত্য জগতের সব কেউকেটার সাথে, তবে কেউ মাত্রা ছাড়ালেই অপমান করেন তাকে, এমনকী পায়ের জুতা খুলে মারেন– সবমিলিয়ে সুরাইয়া সর্বত্র আলোচিত এক নাম।
সুরাইয়া আবুল হাসানের কবিতার ভক্ত। হাসানের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটিয়ে দেন আহমদ ছফা। তাদের বন্ধুত্বকে প্রেমে রুপান্তরিত করতে ভূমিকা রাখেন নির্মলেন্দু গুণ। বার্লিনে সরকারি সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করতে গিয়েছিলেন আবুল হাসান। কিন্তু তার হার্টের অবস্থা তখন এতই খারাপ যে সেখানকার চিকিৎসকরা তার অপারেশন করতে রাজি হন না। বার্লিন থেকে দেশে ফিরে নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিলেন কবি। কিন্তু যাননি। রয়ে গেলেন ঢাকা শহরেই। কারণ কি সেই সুরাইয়া খাতুনের প্রেম?
সেই প্রেমের উপাখ্যান এই ডকু-ফিকশনের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে। পাঠক সেই আখ্যানে অবগাহন করতে পারবেন।
আর একটি প্রায় না জানা অধ্যায় আছে এই বইতে। সে হচ্ছে বার্লিনে চিকিৎসাকালীন সময়ে আবুল হাসানের দিনযাপন, সেখানকার তরুণ কবি, শিল্পী, চিত্রকরদের হৃদয় জয় করার গল্প। প্রকৃত কবিকে চিনতে ভাষার ব্যবধান চিরস্থায়ী দেয়াল তুলে রাখতে পারে না, আবুল হাসানের বার্লিন-জীবন সেই প্রমাণ রেখে গেছে। সে দেশের কবি-চিত্রকরদের হৃদয় জয় করতে হাসানের বেশি সময় লাগেনি। উপন্যাসের মতোই সুখপাঠ্য সেই অধ্যায়টি এই গ্রন্থের অমূল্য সম্পদ।
মোশতাক আহমদ এই ডকু-ফিকশন শুরু করেছেন পিজি হাসপাতালে কবির মৃত্যুদৃশ্য দিয়ে। শেষ হয়েছে জানাজা আর বনানী কবরস্থানে সমাহিত করার বিষণ্ণ, করুণ, হৃদয়স্পর্শী বর্ণনার মাধ্যমে।
০৪.
তবে এই ডকু-ফিকশনে কিন্তু কেবলমাত্র আবুল হাসান উপস্থিত নেই। উপস্থিত আছেন সেই সময়কালের সকল প্রবীণ-তরুণ কবি-সাহিত্যিক। সিকান্দার আবু জাফর, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, জাহিদুল হক, আবিদ আজাদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, শাহাদত চৌধুরীসহ সেই সময়কালের ছোট কিন্তু সমৃদ্ধ সাহিত্যজগত। আর বিপুল জীবন্ত উপস্থিতি আছে ঢাকা শহরের, যা কারো কাছে হৃদয়হীন কংক্রিটের জনপদ, কারো কাছে কবিতার তীর্থভূমি।