গণআন্দোলনের উত্তাল সময়ে প্রকাশিত গ্রন্থটি আজো প্রভাবিত করে চলেছে নতুন সহস্রাব্দের কবিদের, তারা খুঁজে চলেছেন অভাবিত সব প্রকরণ, চিন্তা ও ঘোরগ্রস্থতার অনুপ্রেরণা কিংবা উদাহরণ।
Published : 03 Aug 2023, 12:38 AM
আবির্ভাবেই চমকে দিয়েছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, কেননা তার ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’- কি বিষয়বস্তু, কি আঙ্গিকে- প্রচলিত কবিতার একেবারে বিপরীত মেরুর অভিজ্ঞতা! আনকোড়া, চমকপ্রদ ও অভিনব একগুচ্ছ কবিতা নিয়ে ক্ষীণকটির বইটি কিন্তু অনেক মোটা গ্রন্থকে পাশে ফেলে কাব্য আলোচনার সমুখে চলে এসেছিল। শুরুতেই হৈ-চৈ ফেলে দেওয়া আবদুল মান্নান সৈয়দকে কবিখ্যাতি অর্জনে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পরের গ্রন্থ ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’ তাকে ষাটের দ্বিতীয়ার্ধের কবিদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করলো বেশ জোরেশোরেই। কবি জীবনানন্দ দাশের লেখায় প্রথম পরাবাস্তবতা ফুটে ওঠে বাংলা কবিতায়। এর পরে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো অগ্রজ কবির লেখাতে পরাবাস্তবতা ঝিলিক দিলেও মান্নান সৈয়দের মতো পরাবাস্তবতার প্রতি তন্নিষ্ঠতা ও অবসেসন দেখা যায়নি অন্য কারো লেখায়। পরাবাস্তব কবিতার সঙ্গে তখনো গভীর পরিচয় ঘটেনি আমাদের বেশিরভাগ কবি এবং পাঠকবৃন্দের। পশ্চিমা বিশ্বে আলোড়ন তোলা বিংশ শতাব্দীর এই শিল্প মতবাদকে প্রথম সার্থক ও সংহতরূপে বাংলা কবিতার মাঠে ফলালেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ আসলে জন্মান্ধ নয়, তারা চোখ খুলে দিয়েছিল বাংলা কবিতার।
কেন ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ এত আলোড়ন তুলেছিল তা বোঝা যাবে উদাহরণ দিলে:
সত্তরের গোড়ার দিকে আমি তখন স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, এই বই কী করে যেন আমার হাতে চলে আসে। তখন পর্যন্ত পঠিত কোনো কবিতাগ্রন্থের সাথে মেলেনি সে কাব্য। অনেক চেষ্টা করেও সেইসব দুরূহ কবিতাসমূহের অর্থোদ্ধার করতে পারিনি, তবু টানা গদ্যে লেখা কবিতাসমূহের মাঝে কেমন যেন ঘোরলাগা এক জগতের সন্ধান পাই, রহস্যময় সে জগত আমাকে টানতে থাকে। অর্থোদ্ধারের জন্য স্কুলের বাংলার শিক্ষকের শরণাপন্ন হই, তিনি অপারগতা স্বীকার করেন এই বলে যে, ‘ওগুলো কোনো কবিতা হয়নি।’ প্রচলিত কবিতা পাঠে অভ্যস্ত যে কোনো পাঠকের প্রতিক্রিয়া ওইরূপ হওয়াটা স্বাভাবিক। তখন শরণাপন্ন হই উঁচু ক্লাসের বড়দের, যারা সাহিত্যপাঠক। তারাও কেউ এর মর্মোদ্ধার করতে পারেননি। তখন হতাশ হলেও আমি হাল ছাড়িনি, বইটি হয়ে দাঁড়ায় আমার অবসেসন। আশ্চর্য, বইটি আজো আমার কাছে এক রহস্যমণ্ডিত ঘরবাড়ি।
আমাদের সাহিত্যে যেভাবে বিভিন্ন প্রধান কবিকে একটি বিশেষ অভিধায় অভিষিক্ত করে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়, তেমনি আবদুল মান্নান সৈয়দকে চিহ্নিত করা হলো ‘পরাবাস্তব কবি’ হিসেবে। অবশ্য এই চিহ্নায়ন খুব অযৌক্তিক নয়। আবদুল মান্নান সৈয়দ আর পরাবাস্তব কবিতা প্রায় সমঅর্থী, কারণ তিনিই বাংলা কবিতায় প্রথম পরাবাস্তবতার একটি স্বতন্ত্র ও সম্পন্ন পৃথিবী গড়ে তুলতে পেরেছেন। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ ও ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’-র পরে ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’ এবং ‘মাছ সিরিজ’-এ পুনর্বার ফিরে এসেছিল পরাবাস্তবতার রহস্যমেদুরতা, কিন্তু এ দুটি কাব্যের মাঝে প্রকাশিত ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘পরাবাস্তব কবিতা’ এবং ‘পার্ক স্ট্রিটে একরাত্রি’ গ্রন্থসমূহে পরাবাস্তবতার পথে তেমন হাঁটেননি মান্নান সৈয়দ, বরং বাস্তবের আলপথ ধরে হেঁটে সহজ, কখনো তীর্যক, হয়ে এসেছিল তার কবিতা; তবু ওই অভিধার তিলক সৈয়দের কপালে এঁটেই ছিল। ‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’-এ ক্যাটালগিং জাতীয় কবিতার পাশাপাশি বিদ্রুপাত্বক কবিতার উপস্থিতি বেশি। আশ্চর্য ‘পরাবাস্তব কবিতা’য় পরাবাস্তবতা নেই। তিনি কিছুকাল কলকাতায় কাটিয়েছিলেন ‘পার্ক স্ট্রিটে একরাত্রি’ তার সেই কলকাতা অবস্থানের ছবি, যেখানে পিংকি নামের এক দেহপোজীবীনির সাথে আনন্দময় মিলনের খোলামেলা বর্ণনা উঠে এসেছে। দৈহিক মিলনের অমন দীর্ঘ বর্ণনা, বিশেষ করে এতখানি নিরাভরণ কামসূত্র বাংলা কবিতায় আর কেউ এঁকেছেন কিনা সন্দেহ! সে হিসেবে এটি সাহসী লেখা। ওই একই নামের উপন্যাসে যা ছিল গদ্য, তাই পদ্যের পংক্তিভাঙা রূপ পরিগ্রহ করেছে মাত্র। এখানে কোনো কোনো পংক্তিতে পরাবাস্তব উপাদান রয়েছে, কিন্তু তারা কেবলই বিচ্ছিন্ন আভাস, পরাবাস্তবতার পরিপূর্ণ জগৎ নয়।
পরাবাস্তবতার পৃথিবী আসলে স্বপ্নের পৃথিবী, চেতনাস্রোতে ভেসে যাওয়া পারম্পর্যহীন এক বাস্তবতার আভাস তা, বাস্তবতার চেয়ে যা ঢের দূরে। এটি আরোপিত কোনো পৃথিবী নয়। পরাবাস্তবতা মানুষের মনোজাগতিকতার অন্তর্গত, ভেতরকার জিনিষ; যার ভেতরে তা খেলা করে তার কাছে তা ধরা দেয় সহজেই, যাকে দেয় না সে কখনোই তা পায় না। আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় পরাবাস্তবতাকে কিছুটা আরোপিত বলে মনে হয়। যিনি ‘নীল শিশু হয়ে সবুজ মায়ের’ কাছে যেতে চান তিনি সচেতনভাবেই তা চান। তার মাছেরা বিভিন্ন রঙে রঙিন হয়ে উঠলেও তিনি এটাকে একটি এজেন্ডা হিসেবে নিয়েছিলেন, যে কারণে পরবর্তীতে আরো সংহত, আরো উত্তীর্ণ পরাবাস্তব কবিতার পরিবর্তে তার কবিতায় সরল বাস্তবের প্রকাশ দেখি। শেষ কাব্য ‘জনসাধারণ, অসাধারণ’ গ্রন্থে পাই একবারে ফ্ল্যাট কবিতা-যা বিবরণধর্মী। ছন্দসচেতন, আলঙ্কারিক ও আড়ালসম্পন্ন কবির এমন সাদামাটা প্রকাশ আমাদের স্বস্তি দেয় না একবিন্দু। কাব্যপ্রতিভার কার্ভটি শিখরে পৌঁছে অনিবার্যভাবেই যেন নেমে আসে ভূমিতে। এই পরিবর্তন আমরা শামসুর রাহমানের কবিতাতেও দেখেছি।
আমরা যে জাদুবাস্তবতার কথা বলি তা কিন্তু পরাবাস্তব নয়। পৌরাণিক কাহিনী, লোকগাঁথা, প্রবাদ, পুরাণের যে বাস্তবতা তা প্রতিফলিত হয় জাদুবাস্তব সাহিত্যে। মান্নান সৈয়দে অবশ্য জাদুবাস্তবতা নেই। পরবর্তীতে তার বিশ্বাসের ভিত ঘুরে গেলে তাকে অধিবিদ্যক হতে দেখি। দেখি সৃষ্টিকর্তায় অখন্ড বিশ্বাস স্থাপন করতে। তবে একে ঠিক আধ্যাত্মিকতা বলা যাবে না, বলা যায় জীবনের বাঁকবদলে বিশ্বাসের পুনঃস্থাপন। ঈশ্বরবিশ্বাসও মান্নান সৈয়দে আরোপিত, এটিও একটি প্রকল্প। কেননা তার জীবনাচরণে এর তেমন প্রতিফলন দেখা যায় না। যদিও বলা হয়েছে তিনি পরাবাস্তবের বিচিত্র পরিক্রমা শেষে স্থিত হয়েছেন প্রাজ্ঞ, নির্মোহ, অধ্যাত্মচেতন ও স্রষ্টায় সমর্পিত সত্তায়, মান্নান সৈয়দের ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ গ্রন্থটি বিশ্বাস ও বিষয়বস্তুতেই তার পূর্বাপর অবস্থান থেকে কেবল ১৮০ ডিগ্রি এ্যাবাউট টার্ণ নয়, কাব্য হিসেবেও অসফল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তার ‘নির্বাচিত কবিতা’ গ্রন্থে জড়ো করা নবীর চার সাহাবীকে নিয়ে লিখিত চারটি স্তুতিমূলক কবিতার কথা, কবিতা হিসেবে যেগুলো অত্যন্ত দুর্বল। উদ্দেশ্যমূলক লেখা যে কবিতা হয়ে ওঠে না, এর জোরালো উদাহরণ এ কবিতা চতুষ্টয়। উদাহরণ দিই।
‘হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) : দৃষ্টিতে শ্রবণে’ কবিতার শুরুটা এরূপ:
সাওর-গুহায় সঙ্গী হয়েছিলো কে রসুলুল্লাহ?
কে ছিলো সত্য গ্রহণে দ্বিধামুক্ত, নিশ্চিন্ত, নির্ভীক?
কে ছিলো নবীর সঙ্গে যেন আলো যেন অন্ধকার?
কে সর্বস্ব সঁপেছিলো?- ত্যাগী আবুবকর সিদ্দিক!
‘হজরত উমর (রা.) : গোলাপে-ইস্পাতে’ কবিতায় তিনি লিখেন!
দীর্ঘদেহী, তীক্ষ্ণচঞ্চু, হে খলিফাতুল মুসলেমীন,
রাত্রিব্যপী ঘুরে ঘুরে নগরের অলিতে-গলিতে
খুঁজেছো কোথায় আছে অনাহারী, ক্ষুধাতুর, দীন।
--তোমারই আদর্শ আজো আমাদের অবাধ্য শোণিতে।
উপরোক্ত পংক্তিসমূহে কেবলই স্তুতি ঝরেছে, উত্তীর্ণ কবিতার দেখা আমরা পাই না।
‘পার্ক স্ট্রিটে একরাত্রি’, ‘সোনালি গেলাশ’, ‘বাহুবন্ধন ঊরুবন্ধন’ প্রভৃতি কবিতা হতে পারে উপর্যুক্ত মূল্যায়নের স্বপক্ষে আরও আরও উদাহরণ। ‘কলকাতা : ১৯৮২’ নামে পনেরটি টুকরো কবিতার যে মালাটি তিনি গেঁথেছেন তা দীর্ঘায়িত হয়ে তরল হয়েছে, সতের টুকরোয় গাঁথা ‘নারী’ও একই প্রকার, সেখানে কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন পংক্তির সোনারূপা উদ্ভাসিত হলেও ঐক্যসূত্র নেই, নেই টানটান নির্মাণ ও শক্তির প্রকাশ। দীর্ঘায়িত হয়েই তারা এলায়িত হয়ে পড়েছে। একই কথা বলা যায় ‘দয়িতা কবিতা’, ‘আহত আমি অনাহত আমি’, শহীদ কাদরী-র সঙ্গে সারাদিন কাটিয়ে’, ‘সূর্যের ছেলে’, ‘পার্ক স্ট্রিটে একরাত্রি’ ‘আবহমান বসন্ত’ প্রভৃতি কবিতা সম্পর্কে। বরঞ্চ যেসব কবিতায় মান্নান সৈয়দ অতিকথনকে দূরে রাখতে পেরেছেন, কবিতাকে দিয়েছেন পরিমিত সংহতি, সেসব কবিতা কেবল নিটোল নয়, দারুণ উত্তীর্ণ! এর একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে ‘রাস্তা’ কবিতাটি:
আমি যাবো, যে রাস্তা কুমারী তার প্রতি; যে-রাস্তায়
সোনালী তারার মতো বাঁশপাতা-খচা শুক্লাভায়;
তারার শরীর থেকে নেমে-আসা তপ্ত-লাল ধুলো;
সুন্দরতম ফেরেশতা হাঁটেন যে-রাস্তায়; কুলো
হয় ক্রমশ পত্রালি; বৃষ্টি হয় সোনালি প্রভাত;
রৌদ্র, নীল হরিণের দেহ থেকে রক্তসম্প্রপাত;
বাতাস, গোলাপি দীর্ঘশ্বাস; তরু যেন ক্রীতদাস
দাঁড় টেনে চলে যায় ছিঁড়ে শস্পমৃত্তিকার পাশ :-
স্পন্দমান যে-রাস্তার শেষে স্থির, ছোটো কুঁড়েঘর :
থেমে, ঠান্ডা কুয়ো থেকে পান করবো তরল ঈশ্বর।
অনবদ্য এ কবিতা। ‘ঠান্ডা কুয়ো থেকে পান করবো তরল ঈশ্বর’ আমাদের চমকে দেয়। এমনি কবিতার উদাহরণ মান্নান সৈয়দে অঢেল বলেই তিনি ষাটের শক্তিমান কবি, সকল শৈথিল্য ও আদর্শিক পতনের পরেও কবি।
ছন্দকুশলি এ কবি ১৯৮৫ সালে, তার নিজের ভাষায়, ‘একটি ঘোরের মধ্যে’ ৪২টি সনেট লিখেছিলেন যেগুলো ‘চতুর্দশপদী’ শিরোনামে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংগ্রহে ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। চতুর্দশপদী কবিতার যে শিখরস্পর্শ আমরা পাই জীবনানন্দের অমরকাব্য ‘রূপসী বাংলা’য়, যে শিল্পিত প্রকাশ দেখি আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’-এ সেসবের ধারে-কাছে কিছু দেখি না আবদুল মান্নান সৈয়দের রচনায়। চতুর্দশপদী নিয়ে সোনা ফলিয়েছেন মাইকেলের উত্তরসুরী বাংলার অনেক শক্তিমান কবি। পঞ্চাশের দশক থেকে বিবেচনা করলে এদের মাঝে রয়েছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, পার্থপ্রতীম কাঞ্জিলাল’। সৈয়দ শামসুল হকের শ্রেষ্ঠ কাব্যখানিও (প্রাণের গহীণ ভিতর) চতুর্দশপদী। শামসুর রহমানের চতুদর্শপদী কবিতা আজো জ্বলজ্বলে। এখানেও সেই আরোপ করার বিয়য়টি সমুখে চলে আসে। ঘোর নয়, তিনি সজ্ঞানে লিখেছেন চতুর্দশপদী, কিন্তু সে চূড়ায় যেতে পারেননি, যেখানে তাকে দেখতে চান তার ভক্ত পাঠক।
পরবর্তীকালে গদ্য সাহিত্যের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে যান আবদুল মান্নান সৈয়দ, তার হাতে অসামান্য গদ্য ফুটত। প্রবন্ধ রচনায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ভাবশিষ্য বলা যায় তাকে। গড়ে তুলেছিলেন আপাত-দুরূহ গদ্যের এক নিজস্ব শৈলী। কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ‘শুদ্ধতম কবি’ লিখে পুনর্বার হৈ-চৈ ফেলে দেন। পরবর্তীতে জীবনানন্দেরই সমবয়সী কবি নজরুল ইসলামকে নিয়ে তিনি রচনা করেন গভীর গবেষণালব্ধ বিপুল গ্রন্থ ‘নজরুল ইসলাম/কবি ও কবিতা’। তার গদ্য এতোটাই রবিকরোজ্জ্বল যে আমরা ভুলে যেতে থাকি কবি আবদুল মান্নান সৈয়দকে। যিনি বংশগত উপাধিকে নামের সমুখ থেকে টেনে এনে পেছনে জুড়ে দিয়েছিলেন, তিনি যে প্রথাগত পথে হাঁটবেন না, তা বলে দেয়া গিয়েছিল তখনই। তার কবিতা, তার গদ্য আনকোড়া; প্রথাগত পথে হাঁটতে তারা অস্বীকার করেছিল। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে তিনি এমন এক শিখরে উঠে যান যা ঈর্ষণীয়, হাতেগোনা যায় এমন কতিপয় সব্যসাচী লেখকদের অন্যতম হয়ে ওঠেন। এক জীবনে লেখা, যে জীবন দীর্ঘায়িত হতে পারতো, হলে উপকৃত হতো আমাদের ভাষা ও সাহিত্য, তার রচনাসম্ভার বিস্ময় জাগায়। প্রতিভার সাথে পরিশ্রমের মিশেল ঘটলে যা দাঁড়ায়, সেই বিস্ময়ই আমাদের জন্য রেখে গেছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ।
শুরুর ঐ অভাবিত প্রকাশের পরে ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’-এর পথে তিনি আর তেমন হাঁটেননি। যদিও পরবর্তীকালে তিনি যখন ক্যাটালগিং জাতীয় পুনরাবৃত্তিমূলক কবিতা লিখে চলেছিলেন তখনো প্রায়শ তার কবিতায় ঝিলিক দিতো পরাবাস্তবতা । ‘ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ’ পরাবাস্তবতার রসে জারিত একটি উত্তীর্ণ কাব্য, এর অনেক কবিতা-- ‘ও চৈত্র ও ডানাঅলা ঘোড়া’, ‘স্বপ্নের এ্যানটেনা’, ‘শহরে, অচেনা মাছ’ মান্নান সৈয়দের ট্রেডমার্ক। ‘মাছ সিরিজ’-এও ফিরে এসেছিল পরাবাস্তবতা। তবে শুরুর সেই চকমকি পাথরটি তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিংবা অনতিব্যবহারে হারিয়ে ফেলেছিলেন দ্যুতি। গদ্যের অনতিক্রম্য ভারে তখন তার কবিসত্তা বিস্মৃতপ্রায়। বহুকাল গদ্যের ফলবান মাঠে সমর্থ চাষাবাদের পরে শেষজীবনে এসে তার মনে পড়ে যায় তিনি কবি ছিলেন, তার প্রধান পরিচয় কবি। তার উপলব্ধি ‘গদ্য তো অনেক হলো। আজ আমার কবিতার দিন।/শহরে ঢুকেছে আজ সুন্দরবনের হরিণ।’ ‘শহরে ঢুকেছে আজ সুন্দরবনের হরিণ’ আমাদের মুগ্ধ করে, যদিও এ মুগ্ধতা ওই কবিতাটিতে তিনি আর ধরে রাখতে পারেননি, অতিকথনের পথে হেঁটেছেন। ‘যখন কবিতা এসে ধরা দেয়’ কবিতায় লিখেন, ‘যখন কবিতা এসে হাসিমুখে ধরা দ্যায় নিজে/ আমি কী করতে পারি?-করি শুধু পাল্টা চুম্বন/সেই ঠোঁটে, যা একটি অপরূপ কুঁড়ির মতন;/রোদ উঠলে পাপড়ি মেলবে, এখন শিশিরে আছে ভিজে।’ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাই তিনি নিরলসভাবে লিখে গেছেন কবিতা। এমনকি পড়ন্ত বেলায় হয়ে উঠেছিলেন দুরন্ত প্রেমিক, রোমান্টিকতায় ভরপুর এক নবীন যুবক। সহধর্মিনীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন ‘আকাশ আঁধার করে নেমে আসে নৈরাশ্য যখন,/ভুবন ভাসিয়ে নেয়, সবই রন্ধ্রহীন অন্ধকার,/তখনো নিশ্চিত জানি, খোলা আছে তোমার দুয়ার।/ তুমিই বর্ষায়-ফোটা থোকা থোকা আরক্ত রঙন।’ (সায়রা-কে)। আশির প্রথম দিককার তুমুল কামসিক্ত দিনগুলোর তুলনায় নিজের পরিবর্তন সম্পর্কে স্বীকারোক্তি, ‘প্রেমে আজ আমূল বদলেছে/বস্তুবদ্ধ বদমাশ কামুক/ভিজছে তার শরীর, হৃদয়।/ভিজুক-না! ভিজুক। ভিজুক।’ (আষাঢ়ষ্য প্রথম দিবসে) গদ্যের বহিরাঙ্গের আপাত-কাঠ্যিনের মাঝে কবিতার ওই নরোম সত্তাটি তিনি আগাগোড়াই বহন করেছিলেন।
ষাটের শেষলগ্নে আর সত্তরের গোড়ায় যখন এক অভাবনীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের দেশ ও জনগোষ্ঠী, তখন কবিরাও ছিলেন হতবিহ্বল। জনতার সমুখে এসে নেতৃত্ব না দিয়ে তারা অনেকেই চলে গেলেন আত্মগোপনে, উপমা-উৎপ্রেক্ষার কুহক-ডাকা জগতে, তারা পালালেন আত্মবিবরে; বাস্তবতা নয়, তাদের প্রিয় হয়ে উঠল পরাবাস্তবতা। যে বাস্তবতা স্বস্তি দেয় না, কেড়ে নেয় ঘুম, সেই বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ ও তার সঙ্গী অনেক কবি। সময় অন্ধ নয়, সময় বরং মহাকাব্যিক আলো ফেলছিল আমাদের জনগোষ্ঠীর চোখে, দুঃখজনক আমাদের অনেক কবি তা দেখতে পাননি, আবদুল মান্নান সৈয়দ তাদের অন্যতম। কাব্যিক উৎকর্ষতা আর অভিনবত্ব সত্ত্বেও ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের’ এই পটভূমি আমাদের মনে রাখতে হবে। তখন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকা ঘিরে যে নবীন অথচ প্রতিভাবান কবিকুল জড়ো হয়েছিলেন তাদের রাজনীতি ও সমাজবিমুখতা কালের নিরিখে আজ প্রবলভাবে সমালোচিত। পরবর্তীকালে সৈয়দের রাজনৈতিক পরিচয় বা ভূমিকাও তাকে সমালোচনার আবর্তে ফেলে, অনেকেই তার কাব্যে, আল মাহমুদের মতো, মৌলবাদী চেতনা, অন্ধবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছেন। ফলে আত্মপরিচয়ের এক গূঢ় সংকটের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলেন প্রতিভাবান মানুষটি। যিনি শুরু করেছিলেন আধুনিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে, তিনি যখন কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসে হারিয়ে যান। ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ গ্রন্থ সৈয়দের যুক্তিমনস্ক আধুনিক পাঠকদের হতাশ করে। মনে হয় সমুখেই রয়েছেন আল মাহমুদ আর তিনি সে পথেই বিশ্বাসের অশ্বে সওয়ার। যিনি নিজেকে অতিক্রম করে যেতে পারেন না তার কাব্যপ্রতিভাও পড়ে যায় সংশয়ের মাঝে আর তিনি নিজে পিছিয়ে পড়েন সভ্যতার অগ্রযাত্রা থেকে। তবু বলব, ডামাডোল থেমে গেলে কালের যে প্রবাহ তাতে তিনি যে ক্রমঃউজ্জ্বলিত হয়ে উঠবেন, সন্দেহ নেই; কেননা তখন কবিকৃতিই মুখ্য হয়ে ওঠে, কবির সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা নয়।
আব্দুল মান্নান সৈয়দ ছন্দসচেতন কবি। ভুলে গেলে চলবে না বাংলা সাহিত্যের এই অধ্যাপক ছন্দ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই (ছন্দ) লিখেছেন। তার কবিতার প্রধান অলঙ্কার চিত্রকল্প। পরাবাস্তবতা চিত্রকল্প দাবী করে। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ চিত্রকল্পে ঠাসা; ‘জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসা’ও তাই। দ্বিতীয় কাব্যে পরাবাস্তবতা র জগতে বিচরণ করলেও টানা গদ্যের প্রকাশ থেকে তিনি সরে আসেন কবিতার অভ্যস্ত ফর্মে। আর রয়েছে উপমার সার্থক ব্যবহার। এসবই তাকে ষাটের শক্তিমান কবিদের সারিতে ঠাঁই দিয়েছে। বস্তুতঃ তাকে বাদ দিয়ে ষাটের কবিতার আলোচনা পূর্ণাঙ্গ নয়। সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে টিঁকে থাকবে তার পরাবাস্তব কবিতাসমূহ।
তাঁর কিছু কিছু কবিতার হীরকদ্যুতি পংক্তি আমার ঠোঁটে থাকে। যেমন, ‘আমি অচেনা মাছ/ তোমাদের এই বিশাল শহরে/শাহরিক জলে/ঐ কঞ্চির উপর মাছরাঙার ছদ্মবেশ পরে বসে আছে সুন্দর/ঝলমলে সর্বনাশ আমার।’ কিংবা ‘আমি যাবো যে রাস্তা কুমারীর প্রতি, তার খঁচা শুক্লাভায়’। মনে আছে এক অপরাহ্নে আজিজ মার্কেটে তাকে এই কবিতাচরণ মুখস্থ শুনিয়ে মুগ্ধ করেছিলাম। বলা হয়ে থাকে কোনো কবি যদি একটিও স্মরণযোগ্য পংক্তি লিখে রেখে যেতে পারেন যা কালের ভাটি পেরিয়ে অনাদিকালের পাঠক হৃদয়ে গেঁথে থাকবে, তারা স্বগত আওড়াবে সে পংক্তি, তবে সে কবি সার্থক। আবদুল মান্নান সৈয়দ এমনি অসংখ্য স্মরণযোগ্য পংক্তি বা পদ রচনা করেছেন। কবি হিসেবে তার সার্থকতা তাই প্রশ্নাতীত।
কাব্য হিসেবে ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ আজো নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বলে। গণআন্দোলনের উত্তাল সময়ে প্রকাশিত গ্রন্থটি আজো প্রভাবিত করে চলেছে নতুন সহস্রাব্দের কবিদের, তারা খুঁজে চলেছেন অভাবিত সব প্রকরণ, চিন্তা ও ঘোরগ্রস্থতার অনুপ্রেরণা কিংবা উদাহরণ। প্রথম কাব্যজীবনে, প্রথাগত পথে হাঁটেননি বলে, আব্দুল মান্নান সৈয়দ তরুণ কবিদের মাঝে প্রিয় এক নাম। তরুণ কবিদের মাঝে প্রিয় যে আঙ্গিক সেই টানাগদ্যের সমৃদ্ধ স্বর্ণখনি তরুণরা তা খুঁজে পেয়েছেন এই গ্রন্থে। অন্য স্বর্ণখনিটি ষাটের সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’। ষাটের এই দুই কবির কাছে নতুন কবিদের ঋণ অনেক। কেননা ঘোরলাগা কবিতা লিখতে তরুণ কবিরা পছন্দ করেন, পরাবাস্তবতা তাদেরও প্রিয়। মান্নান সৈয়দের টানা কবিতায় যে পারম্পর্য ছিল তা কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক তরুণের কবিতায়, অনেকের লেখাই প্রলাপীয়। এসকল তরুণ কবিদের উপলব্ধির মাঝে আবার জেগে উঠছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ, তার ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ নিয়ে, মুখ্য হয়ে উঠছে তার কবি পরিচয়, বহুমাত্রিকতার গুণসম্পন্ন, গদ্যের অসামান্য কারিগর হওয়ার পরেও যে পরিচয়ে তিনি গৌরব বোধ করতেন।