আমরা কি বলতে পারি আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতি রাষ্ট্র থেকে পেয়েছেন?
Published : 03 Aug 2023, 02:14 PM
আবদুল মান্নান সৈয়দের কাব্যগ্রন্থ ‘পরাবাস্তব কবিতা’ কিনেছিলাম ১৯৮৩ সালে, নিউ মার্কেটের কোন এক দোকান থেকে। কবিতা পড়ার নেশা তখন তুঙ্গে, জীবনানন্দ দাশে কবিতার যে নতুন টান পেয়ে কবিতায় ডুব দিয়েছি, ‘পরাবাস্তব কবিতা’ সেই ডুবে হাতে রত্ন তুলে দিয়েছিলো। কবিতা নিয়ে আমার চিন্তা-চেতনায়, কবিতার শরীর, টেকনিক, ভাষা সর্বত্র এই কাব্যগ্রন্থ প্রভাব ফেলেছিলো। এরপর পড়েছি তাঁর ‘মাছ সিরিজ’, `কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড'। ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ থেকে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ আমাদের কবিতার ধারায় হাঁটতে চাইলেন না, হাঁটলেন স্বেচ্ছাচারী এক শিল্প নির্মাণের দিকে, এবং শেষাবধি তাঁর সাহিত্যকর্মে মৌলিক লেখার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য কাজ করে তিনি যে রাস্তাটা শেষ করে গেলেন, এতোটা দীর্ঘ আমাদের বাংলাদেশে আর ক’জন পেরেছেন!
তাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮৭ সালে, একটি একুশে সংকলন সম্পাদনা করতে গিয়ে তাঁর কবিতা চেয়েছিলাম, এবং দিয়েওছিলেন। তখন তিনি জীবনানন্দ দাশের কাজ নিয়ে গবেষণা করছেন, বিভিন্ন কাগজে তাঁর লেখা জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে লেখা পড়ছি, নজরুল ইসলামের উপরে তাঁর গবেষণাধর্মী লেখা পড়ছি এবং এখনও ভাবলে অবাক হই, একই সাথে তিনি শহীদ কাদরীর কবিতা নিয়েও লিখে যাচ্ছেন। আমি এই সময়ে বেশ কিছু সাহিত্যের কাগজ বের করেছি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো ‘আরব্ধ’। মান্নান ভাই জীবনানন্দকে নিয়ে সম্পূর্ণ একটি নতুন লেখা আমাকে দিয়েছিলেন। ‘আরব্ধ’ বের হলে প্রথম দিনই তাঁর গ্রীনরোডের অফিসে গিয়ে হাজির হই। ‘আরব্ধ’ দেখে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন, তাঁর কাছে থেকে সেদিন যে প্রশংসা পেয়েছিলাম তা আমি একদমই আশা করিনি।
‘আরব্ধ’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৮-এর ডিসেম্বরে, তখন সেই বয়সে পত্রিকা প্রকাশের আনন্দকে তুমুল করে দিয়েছিলো একটি খবর, একদিন ফেব্রুয়ারির বইমেলায় কবি আহমদ আজিজ জানালেন, আবদুল মান্নান সৈয়দ বইমেলায় পঠিত বাংলা সাহিত্য পত্রিকা নিয়ে তাঁর প্রবন্ধে ‘আরব্ধ’-র নাম উল্লেখ করেছেন!
তিনি ছিলেন আদ্যপ্রান্ত একজন স্মার্ট সাহিত্যিক, আমার শিল্প-সাহিত্যে বিলীন হওয়ার শুরুর দিকে তাঁকে সাহিত্যের বনাঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু বৃক্ষের একটি ভাবতাম! তার মেধা এবং সৃষ্টিশীল চিন্তার স্রোতে আমি যে ভেসেছি সেই আনন্দ আমি এখনও উপভোগ করি।তাঁর মতো কবিতা লিখতে চাইতাম, গত ৩৪ বছর ধরে ছবি আঁকি, আমার ছবি কবিতায় নির্মিত না হলে তাকে শেষ করতে পারি না, এবং এই যে কবিতা নিয়ে ছবির জার্নি, যেখানে মূলত আমিই হাঁটি, এইসব পথে তাঁর সাথে আমার এখনও কথা হয়!
যে কোন কবিকে, যে কোন শিল্পীকে রাজনীতি এবং সমাজ বাস্তবতা অতিক্রম করে বাঁচতে হয়, তার সকল যুদ্ধ শেষ করেই তাকে কবি হতে হয়, শিল্পী হতে হয়।
‘সৃষ্টিশীলতার প্রতি’ কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখেছিলেন —
‘’শুধু তোমাকে সালাম-- আর কাউক্কে তোয়াক্কা করি না,
আর-সব-পায়ে-দলা মুথাঘাস-- শুধু তুমি ঘাসে রত্নফুল,”
আবদুল মান্নান সৈয়দ একজন কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক এবং গবেষক ছিলেন। তাঁর যে কোন লেখা পড়ে একজন সব্যসাচী লেখক হয়ে ওঠার যে সীমাবদ্ধতা, সেই ঋণাত্মক স্পর্শ পাওয়া দুরূহ! আমাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে তাঁর যে কাজ, এবং তার যে গবেষণামান, তা এখনও অনন্য। আজকাল বাংলা সাহিত্য, বাংলা কবিতা কাদের করকমলে? আমরা কবিতার ফ্রেমে যা পাচ্ছি এবং পড়ছি তা কি কবিতা!
আমাদের কবিতার সৈয়দ লিখেছিলেন —
‘কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’ কবিতায়
শিল্পীকে শিল্পে বিচার করতে হবে, কবিকে কবিতায় আর সাহিত্যিককে সাহিত্য বিচারে মূল্যায়ন করতেই হবে! রাজনীতি, সমাজ এবং সমসাময়িক চিন্তা অতিক্রম করে কেউ কেউ আগে জন্ম নেয়! রাষ্ট্রকে, সমাজকে বুঝতে হয়। না হলে বাংলা ভাষা মুখ থুবড়ে পড়ে, মেধার জন্ম স্থবির হয়! আমরা কি বলতে পারি আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতি রাষ্ট্র থেকে পেয়েছেন? আলোকে অবজ্ঞা করলে অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ে, তোষামোদী চিন্তায় কিছুই বাড়ে না, বামন হতে থাকে জীবনের বনসাঁই!
আমাদের নতুন জেনারেশনের যারা সাহিত্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করছেন এবং যারা সাহিত্য উপভোগ করতে চান, উভয়েরই আবদুল মান্নান সৈয়দ পাঠ জরুরী। শিল্প-সাহিত্যে নান্দনিক গভীরতার কোন পরিমাপ থাকে না, আমরা একটি দিয়ে আর একটিকে বুঝতে পারি, অতীত দিয়ে বর্তমানকে বুঝতে পারি, কিন্তু কোন কোন পরিমাপ মানদণ্ড হয়ে ওঠে; আবদুল মান্নান সৈয়দ তেমনই একজন, আমাদের সাহিত্যের মানদণ্ড।