মুক্তি এবং যুদ্ধ

দিলরুবা আহমেদদিলরুবা আহমেদ
Published : 21 Nov 2022, 03:50 PM
Updated : 21 Nov 2022, 03:50 PM

টগর যতই ভাবছে এটা নাম হলো কোনো, ততই কিন্তু দেখছে মোনাজাতউদ্দিন খুবই উত্তরোত্তর আনন্দে আছে তার নিজের আবিষ্কার করা নাম নিয়ে। নিজে নিজেই মোহিত। বলছেও, কি যেন এক আনন্দধারা বইছে ভুবনে। তার নাকি এই রকমই মনে হচ্ছে। মোনাজাতউদ্দিন আপন মনে গাইছেও মাঝে মধ্যে গুনগুনিয়ে একটা কিছু। গানটা কার তা যেমন সে বুঝতে পারছে না তেমনি কঠিন কঠিন কথাও না। সে নিজে যে ভালোই বাংরেজ সেটা অতটা আগে বোঝেনি যতটা বুঝেছে গেল এক মাসে ওই লোকের সাথে সংসার করতে গিয়ে।

ঐদিকে " উনি এতো বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন!"- এই বলে বলে নন্দিনী ভাবি আর নিহা আপু প্রায়ই চোখ তোলেন কপালে। মোনাজাতউদ্দিনকে তাই সে অনুরোধও করেছিল ভাষার মাত্রা প্রয়োগ আর ব্যবহারটা একটু বদলাতে। কে আর শোনে কার কথা। উল্টে বলেছেন, 'আকাশের পানে চেয়ে আছেন তারা'- এরকমই নাকি হাবভাব তার দুই বান্ধবী কাম বোনতুল্য নিহা আর নন্দিনীর। ওই অবাক হওয়ার কারণে, সারাক্ষণ চোখ কপালে, নামছেই না। এটা বেশ অভিনব একটি দৃশ্য দেখার মতনই, এবং এই সবটাই বলে যাচ্ছেন মোনাজাতউদ্দিন। নন্দিনী ভাবি তাই শুনে বলেছেন, এতো অসাধারণ বর হয়েছে তোর যে ভুলে যাওয়া সব বাংলা এখন দরজার সামনে এসে কড়া নাড়ছে।

টগর শুনতে থাকে শুধু, বলে না সে মুখে কিছু, বোঝে সে সবই, বুড়া বয়সে ওই যে সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে তাই তাকে খুশি করতে ওই সব বলে ওনারা, সবই বোঝে, বলে না কিছু শুধু। সে বুড়া বয়স বললেও তেড়ে আসেন মায়ের সাথে সাথে ওনারাও। বলেন ৩৩/৩৪ হল নাকি একটা বয়স! তবে হয়েছে বলেই তার ধারণা। সে এই আমেরিকায় বড় হওয়া একটা মেয়ে, সেই বাচ্চাকালে এসে ঢুকেছে এই দেশে, তার সাথে অনেক মত ভাবনা চিন্তা মিলে না নন্দিনী ভাবির সাথে বা নিহা আপুর সাথে। ওনারা এক কথায় মেইড ইন বাংলাদেশ। সারাক্ষণ বাংলাদেশ বাংলাদেশ করেন। প্রথমজন বিয়ে করে ঢুকেছেন, দ্বিতীয়জন পড়তে এসে তা শেষ করে এখন চাকরি করছেন। দু’ জনাই বয়সে বড় হওয়াতে অনেক উপদেশ দেন তাকে। ওনারা মোনাজাতউদ্দিনের নাম দুটোই খুবই আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছেন। এত বুদ্ধি এত বুদ্ধি এরকমও বলেছেন নন্দিনী ভাবি কয়েকবার। কিন্তু সে এতে হতবাক। এতো বুদ্ধি করে মোনাজাতউদ্দিন যা বের করেছেন  টগরের মাথাতেই তা ঢুকছে না। যাইহোক, এ নিয়ে সে ভাবতেও চায় না। গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। মা-কে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলেই বলবে এত মোটা বুদ্ধি নিয়ে তুই ঘুমাস কেমন করে!

আজকাল সে ঘুমায় না। জেগে থাকে। জেগে থাকতে তার ভালো লাগে। বাসাটা নেয়ার পর থেকে আরো বেশি করে জেগে থাকে। তিনদিন হয় উঠেছে , বলতে গেলে তিন রাতই জেগে ছিল প্রায় তিনটা চারটা পর্যন্ত। কাউকে বলেনি, বললেই বলবে, বুঝেছি বুঝেছি, নতুন বিয়ে, ঘুমাবে কেন। সে জেগে থাকে কারণ সে ঘুমিয়ে সময় পার করতে চায় না। ঘর গোছায়, এখান থেকে ওখানে জিনিস বদলায়, কিছু তুলে রাখে কিছু বের করে, কিছু মোছে কিছু ঘষে। চেয়ে চেয়ে দেখে, নিজের সংসার। ধারণা ছিল মা আর ছোট ছোট দুটো ভাইকে নিয়েই জীবন তার, বোঝেনি এরপরও কিছু রয়েছে জীবনে। প্রথম বর-টা পুরা পাঁচটা বছর তাদের বাসাতেই থেকে গেলো, পাসপোর্ট পেয়ে চম্পট দেওয়ার আগে পর্যন্ত ওই দুই রুমের এ্যাপার্টমেন্টেই জীবন পার করে দিলো। এখন এই নতুন বাড়িতে তার বেশ আনন্দ আনন্দ লাগছে। মনে হচ্ছে পেখম মেলছে সে। প্রজাপতি হচ্ছে। ময়ূর হচ্ছে যেন সে। তার আঙ্গিনায় বহু কলতানে এখন যেন মুখরিত। মুহুর্মুহু ওই মোনাজাতউদ্দিন তাকে ডাকছে এটা ওটা বলতে, করতে, দেখাতে বা তাকে দেখতে। বিলক্ষণ অনুক্ষণ সে অনুরণিত হচ্ছে ধ্বনিতে,ধমনীতে, এই ধরণীতে।

 তাদের আগের এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে বের হলেই তাদের এই বাড়িটা। হেঁটেই মা চলে আসতে পারবেন। ওই ভেবেই নিয়েছে এই বাড়িটা ভাড়া মোনাজাতউদ্দিন। মোনাজাত খুব মন দিয়ে তার অনুভূতিগুলোর যত্ন করছে দেখে তার যেন কেমন কেমন ঘোর লাগতে শুরু করেছে এই এক মাসের দেখা বরটিকে ঘিরে। খুব বেশি কি কিছু লাগে এক জীবনে কাউকে খুশি করতে। একটু মনোযোগ একটু মমতা এই তো শুধু চেয়েছিল সে, এটুকুই, তারপরও কতটাই না দুর্লভ এটুকু! মা গাড়ি চালাতে পারেন না, এই ডালাসে ট্রাম বাস ধরে কোথাও যাওয়াটা যেমন তেমন ব্যাপার নয়, সে পাশে থাকলে সব সময় চোখে চোখে রাখা যাবে ওদের, দরকারে প্রয়োজনে এক দৌড়ে তার বাসাতে পৌঁছে যাবে ওরা তিনজন, এই তো অনেক পাওয়া।

সবই ঠিক আছে কিন্তু এ কেমন নাম বের করেছে সে বাচ্চাদের জন্য!

কিছু বলেনি সে। তবে যাচ্ছে যখন বলে, যাক বলে যাক, যখন হবে সাথে সাথে নাকচ করে দেবে। পারবে এই দেশে কেউ উচ্চারণ করতে ওই নাম। মুক্তি নামটা আসল থেকে গড়িয়ে "মুটি মুটি" হয়ে যাবে, সে থেকে "মুতি মুতি"তে গিয়ে থামবে। আমেরিকানরা ঐটুকু বাচ্চাটিকে দেখলেই ডাকতে থাকবে ডিয়ার মুটি, দেশীরা মুতি মুতি সোনা। নিহা আপু বলেছেন মুতি মুতি মানে হচ্ছে বাংলায় 'পিসি করা"। আরো বলেছেন শেষে গিয়ে থামবে মূর্তি মূর্তি-তে। হে খোদা এবার কি করা। ছেলের নাম তো আরো কঠিন--যু যুদ, টুদ্ধ , টুইট, কি যেন বলেছে । শেষে যীশু-ই না সবাই এই দেশে তাকে ডাকতে শুরু করে! তবে টগর ভেবে নিয়েছে এই নাম নিয়ে সে আর ভাববে না। যখনের কথা তখন ভাববে।

এখন শুধু ভেবে এইটুকুই বুঝে নিয়েছে যে, নতুন নতুন বিয়ে করলে মানুষ মনে মনে কত কি ভাবনা চিন্তা করে ফেলে, যার আগাও নেই মাথাও নেই।

এদিকে জামেনি খালা অবশেষে লাস ভেগাস থেকে ফিরেছেন, ফিরেই এক ছুটে উপরে আসতে গিয়ে সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে পড়েছেন, পরেই ওরে আল্লাহ রে মরে গেলুম রে বলে দিলেন একটা হাক ছেড়ে ডাক। সিঁড়ির আশেপাশে থাকা দুই বা একটা বা যে-কয়টা শালিক টিয়া ছিল সব সাথে সাথে উড়ে পালিয়েছে। আম্মা বীরদর্পে ওনাকে উদ্ধার করতে ছুটে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে নামতে গিয়ে কয়েকটা ডিগবাজি খেয়ে ওনাকে টপকে একেবারে নিচে। নিহা আপু বলেছেন আম্মার মেক্সির নিচে পেটিকোট বা পেন্টি কিছুই নাকি ছিল না। নিহা আপু ওই দূরের এ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন আর নাকি হাসছিলেন, ভাবা যায়, পিএইচডি করা নিহা আপু এরকম করতে পারে? কিন্তু করেছেন, কেউ পরে গেলেই নাকি ওনার হাসি পায়। উনি নিজে অবশ্য ছুটে আসেননি, বাসা থেকে অফিস করছেন আজকাল, কোভিডের কারণে, ফোন তুলে তাকে খবর দিয়েছিলো, দিতে গিয়ে এত বৃত্তান্তের সমাগম। বাকি যে কয়টি কাঠবিড়ালি ছিল তার আঙ্গিনায় সেগুলোকে ভয় পাইয়ে দিয়ে সেও দিলো ছুট সাথে সাথে মায়ের এ্যাপার্টমেন্টের দিকে। ওই মুহূর্তে সে আবারো অনুভব করেছিল ঠিক এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের সামনে বাসাটা নিয়ে মোনাজাতউদ্দিন কি ভালো কাজটাই না করেছেন।

সেটা ছিল দুই দিন আগের ঘটনা। এই দুইদিনে যে যার বাসায় লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছেন। একতলায় আন্টি গ্রেট, ঠিক মাথার উপরে আম্মাজান দি সিঁড়ি বিশারদ। ওনারা শুয়ে শুয়েই পরস্পরকে দোষারোপ করে গেছেন এবং যাচ্ছেন।

আম্মা বলছেন ওনার কি দরকার ছিল এতো ঝাপাঝাপি করবার, নিজের বয়সের কথা একবারও  ভাববেন না! ৭৫ বছরের বুড়ি অথচ ভাব করবেন ২৫ বছরের বাছুর! দেশ থেকে এসেই তো একবার গেলেন লাস ভেগাস, আবার যখন ফিরলেন শান্তশিষ্ট হয়ে থাকলেই তো হয়, এটা কি ওনার কলেজের মাঠ নাকি যে এতো ,দৌড়ঝাপ দেবে। প্রফেসর যামিনীও কি কম! শত গুণে হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিলেন। তোমার মায়ের বয়সও কিছুদিনের মধ্যেই সত্তুর হয়ে যাবে। তিনটা লাঠি নিয়ে হাঁটবে।

তারপরই বলেছেন তোমার মাকে কাল-ই মল থেকে পেন্টি কিনে দেবে। সে তখন বুঝতে পেরেছিল নিহা আপু চোখে ভালোই দেখে। আম্মা এনাকে এরপর থেকে একেবারেই আর সইতে পারছেন না, বরং সে অনেক কাছের মানুষ যামিনী খালার। কখনো ডাকে খালা কখনো আন্টি ডিয়ার। ওনারা একজন উচ্চ শিক্ষিত আরেকজন স্বল্প শিক্ষিত মানুষ, কিন্তু ঝগড়াঝাটিতে সমান পারঙ্গম। মোনাজাতউদ্দিন শুনেই বলে দিলেন, ওটাতে রমণী হওয়ার সুবাদে দুজনই সমানভাবে অংশীদারিত্ব দাবি করতে পারে। সে ভেবেছিলো এবার তার রাগ দেখানো দরকার কিন্তু তার আগেই মোনাজাতউদ্দিন ঘোষণা দিলেন, তার বৌ বলে সমগ্র বিশ্বের তাবৎ রমণীকুল থেকে আলাদা এই টগর, টেগোর মিউজিকের মতন আনপেরালাল, কোনো তুলনা নেই। প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে না কার! সেও আনন্দিত হয় তবে কেন যেন আটখানা হয় না, এক খানাই থাকে, বহু দেখার বহিঃপ্রকাশ এটা। বাবা মারা যাবার পর থেকে মা আর দুই ভাইকে নিয়েই তো তার সেই ১৬/১৭ বছর বয়স থেকে একা একা পথ চলা।

জমেনি খালার ছেলেও ফিরেছে মা-র সাথে সাথে। মা-ছেলে আছে একসাথে নিচের এ্যাপার্টমেন্টে। বিদেশি বৌটি এখনো লা-পাত্তা। ফেরেনি। বৌটি কোথায় তা সে জানতে চাইবার আগেই যামিনী খালা জানতে চাইলেন, আমাদের ব্লু বনেটের মা কি এসেছিলো ফিরে কখনো! তাহলে তো বুঝেই গেলো, সবাই পরস্পরের অজান্তে আছে এক জায়গাতেই সমবেত, যাতে এক তথ্য-উপাত্তহীন উপায়হীন অবস্থার খবর পাওয়া যাচ্ছে, কেউ জানে না কোথায় সেই বৌ এখনো। মনে মনে টগর আওড়ায়, কর কর আরো করো বিয়ে, আরো করো সাদী মোবারক বিদেশি মেয়ের সাথে। আনমনে ভেঙ্গায়ও, আবার জিগায়, এসেছিলো কি? যে গেছে গেছেই গা ফরএভার, এভাবে ভাবতে শিখুন, এভাবে বলতে চেয়েও পারলো না। আপকামিং নাতনির আবার বাহাদুরি করে নাম জপছেন বিকাল সকাল ১৩ বেলা, ১০০ ঘণ্টা, হোয়ের ইজ ওউয়ার ব্লু বনেট, এই বলে হাপ্ করে দীর্ঘ একটা বাতাস ছাড়েন নাক দিয়ে, কখনো মুখ দিয়ে ছাড়েন। নিহা আপু বলেন, এটা হচ্ছে নাতিদীর্ঘ শ্বাস নাতির জন্য। সে ভেবে পায় না এত শত কত রকমের শ্বাস আছে মানুষের! উফ রে। নিহা আপু আরো বলেন, নাতনির বিদেশি নামটা রাখছে ওই বিদেশি বৌ অথচ কোনো মাতাবলা নেই ওই প্রফেসরের, খুশি মনে মা-ছেলে তাই মেনে নিয়েছে যেন, খুবই অবাক কাণ্ড।

 অন্যের বাচ্চা নিয়ে এত কি ভাববার আছে-- এ নিয়ে বিরক্ত হয়েই আবিষ্কার করলো সে, তার ওই অল্প কদিন মাত্র হওয়া স্বামীটিও নাম জপছেন সন্তানের। নাম হচ্ছে মুক্তি যুদ্ধ। মা আবার এসে তাতে যোগ করলেন, ছেলে হলে যোদ্ধা হলে বেশি ভালো হবে। পিছনের এক এ্যাপার্টমেন্টে থাকা এক বাঙালি আন্টি-ও কীভাবে যেন শুনে গেলেন বিষয়টা, বললেন, যুধিষ্টির হলে আরো ভালো হবে। মোনাজাতউদ্দিন স্বরে বিরক্ত লুকিয়ে বললেন, নেভার, ওটা হবে না। এবার আরো বিরক্ত টগর বললো, বাংলাদেশের থেকে অনেকেই তো এই দেশে এসেই নাম বদলে জ্যাম, হিপহপ, কেলি, জারিন কত কি রাখছে। আকিকা করেও স্যাম ক্লিউদ্দিন রাখছে, তাহলে হিন্দু বা বৌদ্ধ নামে কি অসুবিধা!

 নিহাপু বললেন, ওতে কোনো লাভ হবে না তাই ওই নামের জন্য কোনো LOVE নেই, ক্রিস্টিয়ান নামই ভালো। দেখলেই তো বুঝা যাবে তোমরা হোয়াইট নও, তারপরও ওদের মতন হতে চাইতে যাও বা চাও কেন তাই বুঝি না।

কিন্তু মোনাজাতউদ্দিন তার যে সন্তানেরা আসেনি তাদের নাম বাঁচাতেই ব্যস্ত, খুব বিরক্ত হয়েই আবারো বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলো, ওদের নাম হবে মুক্তি এবং যুদ্ধ। এবং এই নাম আবিষ্কারের আনন্দে খুবই মাতোয়ারা থাকতে চাইলো।

দুই টিফিন বক্সে খাবার নিয়ে টগর গেলো প্রথমে  মায়ের বাসায়, তারপরে যামিনী খালার বাসায়। সে রান্না করেনি। নন্দিনী ভাবি রেঁধেছেন। সে প্রথমে ভাবির বাসায় গেছে, খাবার তুলেছে তারপরে ফিরেছে এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। নিহা আপু যেহেতু ওখানেই ছিলেন তাই টিফিন বক্স তিনটা হয়নি, নাহলে নন্দিনী ভাবি ধরিয়ে দিতেন আরেকটা বক্স , বাল্য-বান্ধবীর জন্য। নিহা আপু বললেন, জানোই তো, আমি অতো  রাঁধি না, একদিন দুই আন্টি, তুমি আমি আর নন্দিনীসহ কোথাও খেয়ে আসবো। এই প্রবাসে অসময়ে এমন করে ঘরে রান্না যে করে দিতে পারে সেই আসল বন্ধু, কী বল? পা ঠিক হয়ে গেলে তো ওনারাই করে খেতে পারবেন, তাই না? নিহা আপু কি আর এমনি এমনি পিএইচডি করেছেন। সবই জানে। সবদিকে জানালা খোলা। সে আর কি বলে! এদিকে যামিনী খালা খেতে বসার আগেই বললেন, জানালা সব খুলে দাও, দেশি খাবারের গন্ধে ঘর ভরে গেলে ছেলে রাগ করবে। এ কেমন কথা! আগে বিদেশি বৌটা থাকার সময়ে এতো সাবধানতা নিতো, এখন তো সে ভেগেছে, তারপরও কত কি ভং চং। ডালাসের এই গরমে এসি ছাড়া বসা যাবে ঘরে!

ধুপধাপ করে উঠে দিলো খুলে জানালা, এসিও দিলো বন্ধ করে। বাহ্ কি হাওয়া খেলছে চারদিকে। কি আরাম আরাম একটা বাতাস! নাহ, আসলেই বোঝা দায় এই ডালাসে আবহওয়ার মতিগতি। পা ভেঙেছে মুখ তো আর নাহ, যামিনী আন্টি বলেই গেলেন তার যত কথা। লাস ভেগাসে কি হয়েছে না হয়েছে সব বলা চাই। টগর বুঝতে পারছে , তার কেন যেন শুনতে ইচ্ছে করছে না। আজকাল কেন যেন ভালো লাগে শুধু নিজের কথা ভাবতে, তার সংসার, আগামী, নিজের জীবন। বিয়ে হলে কি মানুষ নিজের ভেতরই আরেক পৃথিবীর জন্ম দেয়? নিজের পৃথিবী, নিজস্ব জগৎ।

যামিনী আন্টি বলেই যাচ্ছেন ওনার কথা, বললেন, জানো, একদম একা একা কেটেছে লাস ভেগাসে  ক্যাকটাস আর যশোহা বৃক্ষ দেখে দেখে। সবাই বলে কি জমজমাট, কোথায় কি, সঙ্গী সাথী ছাড়া সবাই নিঃস্ব। ছেলে কাজে চলে যেত, আমি যশোহা বৃক্ষের চেহারা দেখে দেখে সারাটা দিন পার করতাম। শেষে ওই লিখতে বসে গেলাম, বাংলাদেশে তো এখন আবার সবাই লেখক, আমি-ই বা বাকি থাকি কেন? বলে হাসতে থাকলেন।

টগর জানতে চাইলো,

কি নিয়ে লিখলেন?

আন্টি বললেন, মুক্তিযুদ্ধ!

টগর হা হয়ে যায়। এত দূর, আন্টি পর্যন্ত জেনে গেছেন, ওই লোক কি মাইক নিয়ে ঘুরছে?

থামাতে হবে, এখখুনি এই লোককে থামাতে হবে, ডবল ফুলস্টপ দিয়ে বসাতে হবে তাকে।

দ্রুত বের হয়ে চলে আসছে দেখে আন্টি পিছনে ডাক দিলেন, চোখ বড় বড়  করে বললেন, তোমার মা-কে আবার বলতে যেওনা যেন আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখবো, শুনলেই রেগে যাবেন। টগর অবাক হয়ে বললো, বলো কি আন্টি, সে কি, কেন! মায়ের তো মুক্তিযুদ্ধ -কে ভালোবাসার কথা।

যামিনী খালা যেন পরম আশ্চর্যের কিছু শুনলেন, বললেনও ভূতের মুখে রাম নাম মানায়! টগর তখন আরো অবাক হয়ে, বলো কি এসব! এক রকম মুখ ভঙ্গি করে চেয়ে রইলো, নানীরা কি আজকাল ভূত  হয়ে যাচ্ছে! কিচ্ছু তার মাথায় ঢুকলো না। তাই দেখে যেন মায়া করেই এবার যামিনী খালা বললেন , শোনো, তুমি বোধহয় জানো না যে তোমার বাবা ছিলেন পাক সেনাদের দোসর, রাজাকার, মীরজাফর। আলবদর আলশামস বাহিনীর একজন।

হা হয়ে যায় টগর। কি বলছো খালা? এতো বছর পর এটা কি কথা? খালাও ভাঙা পা নিয়ে কেকাতে কেকাতে বললেন,

এবার দেশে যখন গেলাম তখন ঘনিষ্ঠজনের থেকে শুনে ভালো মতন খবর সব জেনে এসেছি।

 টগর কিছু বলে না, চেয়ে থাকে স্তম্ভিত হয়ে, একসময় উঠে আসে উপরে, মা-কে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করতে পারে না। কিন্তু মা-ই নিজের মনেই গজগজ করে বলতে থাকেন, দোড়ায়ে গিয়ে ওই গরবিনীকে ধরাই অনুচিত কাজ হয়েছে। থাকতো পরে বস্তার মতন কয়েক দিন সিঁড়ির নিচে, তারপরে বুঝতো মজা। খেত পোকা মাকড়ের কামড়, তখন খবর হতো। আরও কটকট করে বললেন, এত যে প্রফেসর মানুষ বলে দেমাগ দেখান কি লাভ হলো, নাতনির নাম তো হয়েছে ব্লু-বনেট , টেক্সাসের জাতীয় ফুলের নাম, শাপলা তো আর রাখতে পারেনি। আমার নাতনি আর নাতির নাম হবে মুক্তিযুদ্ধ-- শুনে এমনভাবে তাকিয়ে থাকলেন যেন গিলে খাবেন। টগর আনমনে জানতে চায়, তুমি পেলে কোথায় ওনাকে এতো কথা বলার জন্য। উনি তো এসেই পা ভেঙে ঘরে বন্দী, তুমিও তাই!

ফোন করেছিলেন উনি।

তাহলে দেখলে কিভাবে গিলে খাওয়ার চোখ।

আম্মা সাথে সাথে বললেন, সে আমি না দেখেও বলে দিতে পারি। কেন, আমার কথা বুঝি বিশ্বাস হচ্ছে না?

হচ্ছে।

হচ্ছে?

হ্যাঁ হচ্ছে।

কেন হচ্ছে?        

আমি আজ ওনার চোখে অনেক হিংসা হতাশা ধাক্কা পরাজয় যেন দেখলাম।

কি বলিস! উনি তো তোকে অনেক ভালো বাসেন! আমার সাথে বনে না কিন্তু তোকে তো সব সময় পাশে চান, গল্প করেন, বন্ধুর মতন।

টগর একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো, ঠিক বলছি। বাসতেন। বাসেনও। কিন্তু মানুষের যখন তার  নিজের অহংয়ে আত্মমর্যাদায় একটু করেও আঘাত লাগে তখন সে রূপ বদলায়। বিশেষ করে যে ভাবছে নিজেকে সব সময় উপরে তোমার আমার থেকে,  তাকে যদি তুমি দেখিয়ে দাও তার আগামী বিলীন হচ্ছে কেবলমাত্র একটি নামের চক্করে সে কি আর ছাড়তে চাইবে তোমাকে!

কি বলছিস এসব?

আচ্ছা মা, বাবা কি রাজাকার ছিলেন?

টগর  পরিষ্কার দেখলো মা প্রচন্ড চমকে উঠলেন, এটাকেই কি বলে আঁতকে ওঠা! আটকে গেছে যেন তার প্রাণ এই প্রশ্নে। উল্টো প্রশ্ন করলেন, হঠাৎ, আজকে? এই প্রশ্ন? আমরা তো বাংলাদেশে থাকিও না!

টগর উত্তর না দিয়ে চুপ করে চেয়ে থাকে। ভাবে একবার বলে, অতীতের পথ ধরেই আমরা বর্তমানে পৌঁছাই। কিন্তু বলে না। মায়ের এমন থতমত খাওয়া মুখ দেখে সেই যেন থমকে গেছে।

মা বিড়বিড় করে বললেন, তোর বাবার সাথে আমার বিয়েই তো হয়েছে যুদ্ধের অনেক পরে। তোর বাবার দেশ আর আমার বাবার দেশ, বাংলাদেশের দুই প্রান্তে। ওদের দেশ গ্রামের খবর জানি না তেমন। যুদ্ধকালীন খবরও না। আমেরিকা থেকে ছেলে এসেছে দেখে খুশি মনে তোর নানাও বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। তোকে নিয়ে এই দেশে আসবার আগে পর্যন্ত তো তোর নানার বাড়িতেই ছিলাম।

টগর প্রশ্ন করলে, আরো কথা এগিয়ে নিলে কোথায় গিয়ে থামতো কথা, জানে না সে। কেন যেন অতীত ঘেটে দেখতে চাইলো না। সাহসই যেন পেলো না।

ধরো আমার যমজ বাচ্চা হয়েছে, কোলে নিয়ে মুক্তি যুদ্ধকে আমি যখন আসবো এখানে, আমার মনে হচ্ছে আমার সেদিন খুব খুব আনন্দ হবে!

মা বললেন, আমারও। আমিও মুক্তি যুদ্ধের নানী হতে চাই।

টগর মায়ের গলার স্বরে বুঝতে পারছে, মা কাঁদছেন।

 ভাবছে সে, মোনাজাতকে বলবে, বড় সুন্দর নাম পছন্দ করেছো গো তুমি আমাদের জন্য।