Published : 04 Sep 2020, 11:21 AM
ঠুমরি
ধ্রুপদকে কেটেছেঁটে তৈরি হয়েছিলো খেয়াল। খেয়াল-গায়ক এর ফলে অনেকটা স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। তারপর খেয়ালকে আরও তরল করে তৈরি হলো ঠুমরি। খেয়ালকে যদি তুলনা করি এক যৌবনোত্তীর্ণ নারীর সঙ্গে, তা হলে ঠুমরির তুলনা করতে হয় এক নৃত্যরত তন্বীদেহ তরুণীর সঙ্গে। ঠুমরি কথাটা নাকি এসেছে হিন্দী শব্দ 'ঠমক' থেকে। ঠমক মানে নাচার ভঙ্গিতে হাঁটা। (বাংলায় ঠমক মানে হাঁটার ভঙ্গি।)
ঠুমরির জন্ম হয়ে থাকতে পারে আরও আগে, কিন্তু আলোকিত মঞ্চে এর আত্মপ্রকাশ উনিশ শতকে। এর লালন এবং শ্রীবৃদ্ধি লাখনৌর নবাবের দরবারে। বিশেষ করে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দরবারে। তিনি নিজে কত্থক নাচ শিখেছিলেন এবং এই নাচের তাল আর ঘুঙুরের শব্দ দিয়ে সাজিয়ে ঠুমরি গানকে সেয়ানা আর সুন্দরী করে তুলেছিলেন। নবাবের আদর্শ ছিলেন কৃষ্ণ। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী নিয়ে তিনি উর্দুতে একটি নাটক লিখেছিলেন। সে নাটক অভিনীত হয়েছিলো বহুবার। নিজেকে তিনি সম্ভবত রমণীমোহন কৃষ্ণ বলে কল্পনা করতেই ভালোবাসতেন। ঠুমরিকে তিনি পরিণত করে তুলেছিলেন তাঁর নর্তকীদের মাধ্যমে। ঠুমরির সঙ্গে কত্থক নাচের যোগাযোগ তাই নিবিড়।
ঠুমরির আগাগোড়া রোম্যান্টিকতা, আপাদমস্তক প্রণয়রস। এর তাল হলো নাচের তাল। এর সুর খাম্বাজ, পিলু, ভৈরবীর মতো হাল্কা রাগিণীর। এমন লঘু এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যে, এর সঙ্গে অন্য রাগরাগিণী মেশাল দেওয়া যায় অনায়াসে। এর এই চটুল স্বভাবের জন্যেই হয়তো খেয়ালীরা সবাই ঠুমরি জানা সত্ত্বেও কিছুতেই কেবল ঠুমরি-গায়ক হিসেবে পরিচিত হতে চান না। অথচ তাঁরা আসর শেষ করেন সাধারণত খেয়ালের পর ঠুমরি গেয়ে।
খেয়ালের মতো ঠুমরিরও থাকে দুটি স্তবক—স্থায়ী আর অন্তরা। খেয়ালের মতোই এতেও তান থাকে, নানা রকমের অলংকার থাকে। কেবল এর কথা আলাদা—কথা প্রধানত সৌন্দর্যর, ভালোবাসার, মান-অভিমানের। আর আলাদা ঠুমরির তাল। খেয়ালে বিলম্বিত একতালের মতো গুরুভার তাল হরহামেশা ব্যবহৃত হয়, কিন্তু ঠুমরিতে কখনোই নয়। ঠুমরির তাল চঞ্চল হরিণীর মতো। অবশ্য বারাণসী ঘরানার ঠুমরি অনেকটাই মন্থর গতির।
বঙ্গদেশে ঠুমরি নিয়ে এসেছিলেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ—১৮৫৬ সালের মে মাসে, তিনি যেদিন নবাবী হারিয়ে কলকাতায় আসেন, বলতে গেলে, দীনবেশে। কিন্তু নবাবী গেলেও তাঁর নবাবী চাল যায়নি। তাই তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর বেগমরা, উপবেগমরা, নর্তকীরা ও অন্য রমণীরা (কারও কারও মতে প্রায় পৌনে চারশো সুন্দরী)। নাম-করা গায়ক-গায়িকা আর যন্ত্রশিল্পীরাও এসেছিলেন। মেটিয়াবুরুজকে নবাব সাজিয়েছিলেন লাখনৌয়ের মতো। এমন কি, ইমামবরা তৈরি করিয়েছিলেন হুবহু লাখনৌয়ের ইমামবরার মতো। তিনি এমন বিলাসী ছিলেন যে, কলকাতার সরকারী চিড়িয়াখানা স্থাপিত হবার তেরো বছর আগে—১৮৬৩ সালে—মেটিয়াবুরুজে একটি চিড়িয়াখানা নির্মাণ করেন। সেখানে কেবল কয়েকটি হরিণ আর পাখি ছিলো না, নানা রকমের ন হাজার জীবজন্তু ছিলো, এমন কি, সাপও ছিলো।
লাখনৌ, বারাণসী আর পাঞ্জাব—তিন জায়গায় তিন ধরনের ঠুমরি প্রচলিত হয়েছিলো। লাখনৌ ঘরানার ঠুমরিকে বলে পূর্বী ঠুমরি। সেই পূর্বী ঠুমরির সুঘ্রাণ অচিরেই ছড়িয়ে পড়েছিলো কলকাতার সর্বত্র। এবং তারই সুবাসে আমোদিত কলকাতার সঙ্গীতরসিকরা ছুটে যেতেন ছোটো-লাখনৌ নামে পরিচিত মেটিয়াবুরুজে। কলকাতার অন্য গায়ক বাদকদের মতো সংগীতাচার্য মহারাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরও সেখানে যেতেন সংগীত-সুধার লোভে, বিশেষ করে, ঠুমরির লোভে। এভাবে কলকাতার সংগীত-শিল্পীদের সঙ্গে হিন্দুস্তানী ওস্তাদদের পারস্পরিক আদানপ্রদানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লাখনৌয়ের বহু ওস্তাদ কলকাতা এবং কলকাতার বাইরে বড়ো জমিদারদের দরবারে চাকরি নেন।
পরবর্তী সময়ে কলকাতায় যাঁরা ঠুমরির পরিচর্যা করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বারাণসীর মৌজুদ্দীন আর গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী। মৌজুদ্দীন পরিচিত ছিলেন বিলম্বিত চালের লচাও ঠুমরির যুবরাজ হিসেবে। বাঙালিদের মধ্যে ঠুমরিতে সবচেয়ে খ্যাতি লাভ করেছিলেন গিরিজাশঙ্কর। কলকাতায় বাস করতেন বড়ে গোলাম আলি খাঁ। তিনি পাঞ্জাব থেকে নিয়ে এসেছিলেন টপ্পা-প্রভাবিত পাঞ্জাবী ঠুমরি।
তবে আমার মনে হয়, বাংলার মাটিতে সত্যিকার অর্থে ঠুমরি শেকড় গাড়তে পারেনি। আমার এ মন্তব্যের কারণ বাংলায় ঠুমরি গান লেখা হয়েছে সামান্যই। সবচেয়ে বেশি গান যিনি লিখেছিলেন, সেই নজরুল ইসলামও ঠুমরি লিখেছেন খুব কম। রবীন্দ্রনাথ নানা ধরনের গান লিখেছিলেন, কিন্তু তিনিও না। 'কেন বাজাও কাঁকণ কন কন কত ছল-ভরে' কি ঠুমরি হলো? দ্বিজেন্দ্রলালও না। একমাত্র অতুলপ্রসাদ ব্যতিক্রম। তিনি জীবনের একটা বড়ো সময় কাটিয়েছিলেন লাখনৌতে। সেখানে ঠুমরির প্রেমে পড়েছিলেন। তিনি ঠুমরি লিখেছিলেন, খেয়াল গানে ঠুমরির রঙ চড়িয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো যে, গানের আরও কয়েকটা ধারা আছে, যেমন দাদরা, কাজরী, হোরী, চৈতী ইত্যাদি—যেগুলোকে আসলে ঠুমরিরই উপধারা বলা যেতে পারে। নজরুলের 'সখি বাঁধোলো বাঁধোলো ঝুলনিয়া' কাজরীর চমৎকার দৃষ্টান্ত। আর হোরির দৃষ্টান্ত হলো নজরুলেই 'ব্রজগোপী খেলে হোরী'।
গজল
বাংলায় গজল গান এসেছিলো লাখনৌ-প্রবাসী অতুলপ্রসাদের গলা ধরে। কিন্তু তাকে ব্যতিক্রম বলাই শ্রেয়। সত্যিকারভাবে বাংলা গজল নজরুলেরই সৃষ্টি, নজরুলের হাতেই তার পুষ্টি লাভ এবং চূড়ান্ত পরিণতি। তবে নজরুলের গজলও এক অর্থে ব্যতিক্রম। কারণ তিনি যখন গজল গান রচনা করেন, তখন গজল জনপ্রিয়তা তো দূরের কথা, পরিচিতিও লাভ করেনি। ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে নির্বাচনে গো-হারা হেরে এবং অসুস্থ দেহে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে ফিরে এসেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর প্রথম গজল—'বাগিচার বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল।' সেই সঙ্গে শুরু হয়েছিলো বাংলা গানের ইতিহাসে একটা নতুন অধ্যায়। এ গান আধুনিক গান নয়, এ হলো লঘু উচ্চাঙ্গ সংগীত।
আধুনিক কালে বাংলায় গজল গান আসার পর এখন পর্যন্ত এক শো বছরও হয়নি। কিন্তু গোড়াতে গজল ছিলো কবিতা, গান ছিলো না। এর জন্ম হয়েছিলো আরব দেশে, সপ্তম শতাব্দীতে। তারপর পারস্য হয়ে ভারতবর্ষে গজলের আগমন তেরো শতকে, হয়তো আমীর খসরুর সঙ্গে।
সেই সুদূর অতীতে বঙ্গদেশেও গজল এসেছিলো পারস্য অর্থাৎ ইরান থেকে। গিয়াস উদ্দীন আজম শাহ পিতাকে হত্যা করে বঙ্গের সিংহাসনে বসেন ১৩৮৯ সালে। পিতাকে হত্যা করলেও আজম শাহ রসিক মানুষ ছিলেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিলো, এমন কি, নিজে ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতেন। সিংহাসনে বসেই তিনি ইরানের বিখ্যাত কবি হাফিজকে বঙ্গদেশ সফর করার জন্যে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন নিজের লেখা একটি অসমাপ্ত কবিতা। তিনি হাফিজকে অনুরোধ করেছিলেন কবিতাটাকে শেষ করার জন্যে। হাফিজ সে অনুরোধ রক্ষা করে কবিতাটি ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনা ঘটেছিলো আজম শাহ সিংহাসনে বসার কয়েক মাসের মধ্যে, কারণ কবি হাফেজ পরের বছরই মারা যান।
ঠিক কবে যে কবিতার বদলে গজল পরিণত হলো গানে, তা জানা যায় না। গজলের মধ্যে পাঁচ থেকে পনেরোটি শ্লোক থাকে। শ্লোককে বলা হয় 'শের'। প্রতিটি শেরে দুটি করে পংক্তি থাকে। তার অর্থ গজল হতে হলে সে কবিতায় দশ থেকে তিরিশটি পংক্তি থাকতে হবে। দৈর্ঘ্যটা সনেটের মতো নির্দিষ্ট। গানের ভাষায় বললে প্রথম শ্লোকটিকে বলা হয় স্থায়ী। পরবর্তী শ্লোকগুলোকে বলে অন্তরা। প্রতিটি অন্তরা একই সুরে গাওয়া হয়।
বিষয়বস্তুর বিচারে গজলকে বলা যেতে পারে প্রণয়-সংগীত। ঠুমরির মতো। প্রিয়ার সৌন্দর্য, পূর্বরাগ, মান-অভিমান, অভিসার, প্রথম মিলন, বিরহ, বিচ্ছেদ—প্রেমের প্রতিটি স্তর, প্রতিটি অনুভূতি গজলের বিষয়ব্স্তু। অবশ্য গজলের অন্য একটা ধারা আছে। এক কথায় তাকে বলা যায় 'ইসলামী গজল'। সে গজলের বিষয়বস্তু হলো হাম্দ আর নাতের মতো।
চলবে