মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে একটি শব্দও খুঁজে পাবেন না যেখানে ইরাকে আগ্রাসনকে অপরাধ বলে আখ্যায়িত করা হয়--যদিও এটি ছিল ২০ শতকের জঘন্যতম অপরাধ।
Published : 01 Dec 2023, 06:59 PM
নোম চমস্কি। বিশ্ববরেণ্য ভাষাবিদ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক। এক দশক আগে Truthount পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখায় (The Assault on Gaza) শুরুতেই ফিলিস্তিনি এক বৃদ্ধের প্লাকার্ডে লেখা উদ্ধৃত করেছিলেন। তাতে লেখা ছিল:
“তুমি আমার জল নিয়ে যাও, আমার জলপাই গাছ পুড়িয়ে দাও, আমার বাড়ি ধ্বংস কর, আমার চাকরি নিয়ে যাও, আমার জমি চুরি কর, আমার বাবাকে বন্দী কর, আমার মাকে হত্যা কর, আমার দেশে বোমাবর্ষণ কর, আমাদের সকলকে ক্ষুধার্ত রাখ, আমাদের সবাইকে অপমান কর তারপরও আমাকে দায়ী করে বলছ, আমি রকেট ছুড়ে মারি।”
এক দশক পরও গাজার অবস্থার কোনো পরিবর্তন তো হয়ইনি, বরং আরও খারাপ হয়েছে। গত কয়েকদিনের ইসরাইলি সেনা অভিযানে ও অবিরাম গোলা বর্ষণে গাজা প্রায় পুরোপুরি বিধ্বস্ত। নতুন করে গাজা-সংকটের শুরুতে চমস্কি চলতি বছর এপ্রিল মাসে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সম্পর্ক ও সংঘাত নিয়ে কথা বলেছিলেন আল জাজিরা টেলিভিশনের সাংবাদিকের সাথে। সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও অধ্যাপক মোস্তাক শরীফের তর্জমায় এখানে উপস্থাপিত হলো।
আল জাজিরা: আমোস, যাঁকে নিজের প্রিয় পয়গম্বর বলে অভিহিত করেছেন আপনি, তিনটি পাপের কথা বলে গেছেন তিনি, যেগুলো তিনি ক্ষমা করবেন। তবে চতুর্থ পাপটি ক্ষমা করবেন না। আমাদের সমাজে কোন পাপগুলোর ক্রমশ বেড়ে যাওয়া লক্ষ করছেন আপনি?
চমস্কি: সবগুলো নিয়ে সবিস্তারে বলার সময় নেই। যেটি সবচেয়ে সহজে চোখে পড়ে সেটি দিয়েই শুরু করি। আণবিক বিজ্ঞানীদের ইশতেহারে বলা প্রলয়দিনের ঘড়ির কথা শুনে থাকবেন। সময়টিকে এগিয়ে এখন মধ্যরাতের নব্বই সেকেন্ডের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। পৃথিবীতে মানব-অভিজ্ঞতার সমাপ্তির ক্ষণ মধ্যরাত, যা ক্রমশ এগিয়ে চলেছে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকির দিকে। জলবায়ু বিপর্যয়ের হুমকিও ক্রমশ বেড়ে চলেছে, যার প্রধান শিকারগুলোর একটি হবে ইসরায়েল। আমাদের নেতাদের প্রধানতম পাপ হচ্ছে, বিপর্যয়ের দিকে ছুটে চলা। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিশতম বার্ষিকী পালন করতে চলেছি আমরা, যেটি এ শতাব্দীর ভয়াবহতম পাপ। মার্কিন নৌবাহিনী তাদের সাম্প্রতিকতম আগ্রাসী যানটি তৈরি করেছে এবং এর নাম দিয়েছে ইউএসএস ফালুজা, মার্কিন আগ্রাসনের জঘন্যতম এক নমুনার স্মৃতিচারণের জন্য। সুন্দর একটি শহর ছিল ফালুজা, মার্কিন নৌবাহিনী সেটিকে আক্রমণ ও ধ্বংস করেছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। সেখানে যেসব ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়ায় ইরাকিরা এখনও মরছে। এটি কেবল জঘন্যই নয়, প্রতীকীও। শেষ বিশ বছরের দিকে তাকান। মূলধারার কোনো গণমাধ্যমে একটি শব্দও খুঁজে পাবেন না যেখানে ইরাকে আগ্রাসনকে অপরাধ বলে আখ্যায়িত করা হয়--যদিও এটি ছিল ২০ শতকের জঘন্যতম অপরাধ। সবচেয়ে কড়া সমালোচনায়ও বলা হয় এটি ছিল একটি ‘ভুল’। এমনকি উদারপন্থী বিশ্লেষকরাও এটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেন অশুভ এক একনায়কের হাত থেকে ইরাকের মানুষকে রক্ষার ব্যর্থ এক চেষ্টা ছিল এটি। অথচ যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে এর দূরতম সম্পর্কও ছিল না। ‘ছোট্ট’ যে বিষয়টি এটি বেমালুম চেপে যায় তা হচ্ছে, নিজের দেশের এবং ইরানের জনগণের ওপর ভয়ঙ্করতম অত্যাচার চালানোর সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম হোসেনকে সোৎসাহে মদদ দিয়ে গেছে। এখন ইতিহাসকে পুনঃনির্মাণ করা হচ্ছে, যার বয়ান হচ্ছে, যে লোকটাকে আমরা সবচেয়ে শক্তভাবে সমর্থন করেছিলাম তার হাত থেকেই ইরাকীদের ‘রক্ষা’ করার চেষ্টা করেছি। বুদ্ধিজীবীরা এভাবেই রাষ্ট্রীয় অপরাধকে পুনঃনির্মাণ করেছেন। অল্প কিছু লোক এর প্রতিবাদ করে। তাদের কথা আপনি শুনবেন না, কারণ তাদেরকে প্রান্তিক করে রাখা হয়েছে। ইউএসএস ফালুজা সম্বন্ধে জানতে চান? যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকায় এটি সম্বন্ধে জানতে পারবেন না। আমার মতো অল্প ক’জন লোকের লেখা পড়ে জানতে পারবেন। মার্কিন পত্রিকায় এ নিয়ে তথ্য পাবেন না, আল জাজিরায় পাবেন।
আল জাজিরা: ১৯৯৬ সালে নেতানিয়াহু নির্বাচিত হওয়ার পর আপনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, লেবার থেকে লিকুদে ক্ষমতার হাতবদলের মাধ্যমে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনবে না। আমেরিকার ছাঁচে গড়ে ওঠা নেতানিয়াহু এমন একটি স্টাইল বেছে নেবেন যেটি মার্কিনীদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। নেতানিয়াহুর আমলের কথা বিবেচনা করে এই ভবিষ্যদ্বাণীকে সংশোধন করবেন কি?
চমস্কি: প্রথম কয়েক বছর। তবে ২০০০-এর পর থেকে ইসরায়েলি রাজনীতি বদলে গেছে। নেতানিয়াহু অনেক বেশি ডানে সরে গেছেন। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে তার পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে কোন কৌশলে কথা বলতে হবে তা এখনও জানেন তিনি। মনে রাখতে হবে, ইসরায়েলের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনমতও বদলে গেছে। উদারপন্থী মার্কিন ইহুদিদের প্রাণের সখা ছিল ইসরায়েল, সেটা বদলাতে শুরু করেছে। এখন ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হচ্ছে চরম ডানপন্থী গোঁড়া খ্রিস্টানরা। গত ২০-৩০ বছরে ইসরায়েলের কঠিন সমর্থকে পরিণত হয়েছে এরা। অন্যদিকে উদার গণতন্ত্রপন্থীরা ইসরায়েল সমর্থন থেকে সরে গেছে। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে ইহুদিদের তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে ভালোভাবেই বোঝেন নেতানিয়াহু, এ কারণে ডান ও চরম ডানপন্থীদের কাছেই নিজের বার্তা পৌঁছে দিতে চাইছেন তিনি। নিঃসন্দেহে দক্ষ রাজনীতিক তিনি, এ কারণে নিজের কৌশল বদলে ফেলেছেন।
আল জাজিরা: আপনি বলেছেন, মার্কিন সমর্থনের কারণেই ইসরায়েল তার অবৈধ কর্মকাণ্ড চালাতে পারছে। অথচ ২০১৫ সালে কংগ্রেসে বক্তৃতা এবং ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নিবাচনে সমর্থন দিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে জনসমক্ষে বিব্রত করেছেন তিনি। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কথার লড়াইয়েও মেতেছেন। তাহলে কি আমেরিকার বৈশ্বিক প্রভাব হ্রাসের ব্যাপারে নেতানিয়াহু এমন কিছু জানেন যা আমরা জানি না? নাকি নিজের আচরণ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের উভয় প্রধান দলের কাছ থেকে অব্যাহত সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে একটা জুয়া খেলছেন তিনি?
আল জাজিরা: যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, ইসরায়েলও। ইসরায়েলি নেতৃত্ব এই প্রথম খোলাখুলিভাবে মার্কিন নেতৃত্বের বিরোধিতা করল। এটি নতুন ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে পছন্দ না করলেও যখনই তারা কিছু চেয়েছে, ইসরায়েল সেটি করেছে। ওবামার আগ পর্যন্ত প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রেই এটি সত্যি। ইসরায়েলি সহিংসতা, নির্যাতন আর ক্ষমতার অনুরাগী ট্রাম্প অবশ্য ইসরায়েল যা চেয়েছে সবই দিয়েছেন। গোলান উপত্যকা ইসরায়েলের অধিভুক্ত করাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, জেরুজালেমের অধিভুক্তিকরণকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, কেবল আন্তর্জাতিক আইনই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকে সমর্থন করেছেন। মরক্কোর ক্ষেত্রেও একই কাজ করেছেন তিনি। মরক্কোর সরকার কর্তৃক পশ্চিম সাহারা দখলকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেখানকার পরিস্থিতি অনেকটাই প্যালেস্টাইনের মতোই। তবে ইসরায়েলের নতুন নেতৃত্ব, যাতে বেন গাভির আর বেজালেল স্মট্রিচের মতো লোকেরা নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা আমেরিকাকে সরাসরি বলছে, গোল্লায় যাও। নেতানিয়াহুও বেশ কঠিন কথাবার্তা বলছেন, যেমন ‘আমরা সার্বভৌম দেশ, যা করার করব।’ এই প্রথম সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে উপেক্ষা করছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা স্পষ্ট নয়। বছর দুই আগে বেটি ম্যাককলাম নামে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের এক সদস্য ইসরায়েলে মার্কিন সহায়তা পুনর্বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। খুব একটা কাজ হয়নি তাতে। সম্প্রতি বার্নি স্যান্ডার্সও একইরকম একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। মানবাধিকার লংঘনকারী কোনো দেশে সামরিক সমর্থন না দেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এটি ঘটলে ইসরায়েলে মার্কিন সাহায্য প্রেরণের আইনী বৈধতা নিয়ে বিতর্ক হবে। আমার ধারণা এ সবকিছুই ভবিষ্যতে বড় পরিবর্তনের সূচনা করবে। জনমতে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে তার প্রেক্ষিতেই একথা বলছি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এর আগে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন ইস্যুতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বক্তৃতা দেওয়ার পর ইসরায়েলের সমর্থকদের সহিংস প্রতিক্রিয়ার কারণে পুলিশী সুরক্ষার দরকার হতো আমার। বক্তৃতা শেষে পুলিশ আমাকে পাহারা দিয়ে গাড়িতে তুলে দিত। এমনকি আমার নিজের ক্যাম্পাসেও। এটি পুরোপুরি বদলে গেছে। এর কারণ হচ্ছে অপারেশন কাস্ট লিড (২০০৮-০৯ সালে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান)। এটি এতই সহিংস ছিল যে তরুণ প্রজন্ম আর সহ্য করতে পারেনি। তাদের মনোভাবের এই পরিবর্তন ভবিষ্যতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এখনও নীতিমালার ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়েনি, কিন্তু অচিরেই অন্তত এর সূচনাটা দেখতে পাবেন।
আল জাজিরা: ইসরায়েলের নাগরিকদের নয়, বরং ইহুদিদের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে বিবেচনা করার কারণে ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করেছেন আপনি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালত প্যালেস্টাইনিদের স্বার্থ সুরক্ষার চেষ্টা করেছে বলেও মন্তব্য করেছেন। ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্ট সম্বন্ধে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ন কী?
চমস্কি: ইসরায়েলের ইহুদি নাগরিকদের ব্যাপারে এই আদালতের কর্মকাণ্ড মোটের ওপর ভালো। তবে ইসরায়েলে বসবাসকারী প্যালেস্টাইনিদের ক্ষেত্রে ততটা নয়। ২০০০ সালে প্রথমবারের মতো আদালত রায় দিল যে, ইসরায়েলি নাগরিকদের মধ্যে যারা প্যালেস্টাইনি, তাদেরকে কোনো বসতি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমন একটি রায় পেতে ২০০০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, যা দুর্ভাগ্যজনক। এই রায় যাতে বাস্তবায়ন করতে না হয় সেজন্য নানা ফন্দিফিকিরও করা হয়েছে। যে প্যালেস্টাইনি দম্পতির আবেদনের প্রেক্ষিতে এ রায় দেওয়া হয়েছিল তারা বছরছয়েক নিজেদের বাড়িতে ফিরতে পারেনি। ইসরায়েলের অভ্যন্তরে সুপ্রিম কোর্টের রেকর্ড মোটামুটি ভালো হলেও অধিকৃত এলাকায় রীতিমতো ভয়াবহ। এটিই পৃথিবীর একমাত্র বিচারিক সংস্থা যেটি ইসরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইনের ভূমি দখলের বিষয়টিকে স্বীকার করে না। অধিকৃত ভূমিকে তারা বলে প্রশাসিত ভূখণ্ড। বিশ্ব আদালত, যুক্তরাষ্ট্রসহ আমার জানামতে সব সরকার, রেড ক্রস সবাই কিন্তু স্বীকার করে। কিন্তু ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্ট নিয়মিতভাবে অবৈধ বসতিসহ প্যালেস্টাইনিদের ওপর নির্মম সব বিধিনিষেধ ও সহিংসতাকে বৈধতা দেয়।
আল জাজিরা: ইসরায়েল প্যালেস্টাইন দ্বন্দ্বে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে সবসময় মতপ্রকাশ করেছেন আপনি। এখনও কি এটিকেই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সমাধান বলে মনে করেন?
চমস্কি: দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঐকমত্য বনাম এক-রাষ্ট্রভিত্তিক একটি বিকল্পের মধ্যে বড় ধরনের বিতর্ক চলছে এ মুহূর্তে। তবে এ বিতর্কের মধ্যে একটা গলদ আছে। তৃতীয় আরেকটি বিকল্পকে অগ্রাহ্য করছে এটি, যেটি ১৯৬৯ থেকে পদ্ধতিগতভাবে বাস্তবায়ন করে আসছে ইসরায়েল, যা হচ্ছে একটি বৃহত্তর ইসরায়েল সৃষ্টি। এটি হচ্ছে, ইসরায়েল যেসব এলাকাকে মূল্যবান বলে বিবেচনা করে তার সবগুলো দখল করে নেওয়া, অধিকসংখ্যক প্যালেস্টাইনি যেসব এলাকায় বাস করছে সেগুলো ছাড়া। যেমন ধরুন, তারা বৃহত্তর ইসরায়েলের মধ্যে নাবলুসকে অন্তর্ভুক্ত করবে না, যেহেতু তাদেরকে বর্ণবাদী ও ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ, ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এজন্য জর্ডান উপত্যকাকে দখল করতে হবে এবং বাসিন্দাদের ওখান থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। কোনো না কোনো অজুহাতে এটিকে ইহুদি বসতিতে রূপান্তরিত করতে হবে। মালে আদুমিম-এর মতো পশ্চিম তীরের গভীরে অবস্থিত শহরও দখল করে নেবে তারা। ফলে মালে আদুমিম-এর মতো জায়গায় সরকারি ভর্তুকিতে বানানো বাড়ি থেকে তেল আবিবে চাকরি করতে যাবেন, কোথাও যে কোনো প্যালেস্টাইনি আছে বুঝতেই পারবেন না। বর্তমানে এ অঞ্চলে যেসব প্যালেস্টাইনি আছে তারা আছে ১৬০টির মতো ছোট ছোট ছিটমহলে। তাদেরকে ঘিরে আছে ইসরায়েলি সেনারা। প্যালেস্টাইনিদের নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ করতে, পশু চরাতে, নিজেদের জলপাই চাষ করতে দিতে পারে তারা, না-ও দিতে পারে। বলতে পারেন বন্দি অবস্থায় থাকবে প্যালেস্টাইনিরা। পরিকল্পনাটা হচ্ছে, চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা। সম্প্রতি চরম ডানপন্থী ইসরায়েলি সরকার পশ্চিম তীরের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ইসরায়েলিদের বসতিস্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। ইসরায়েল এটাকে বলে পশ্চিম সামারিয়া। জেরুজালেমের ঐতিহাসিক আয়তন যা ছিল, আশেপাশের সব ভূমি দখলের মাধ্যমে এখন তার চেয়েও পাঁচ গুণ বেড়েছে। উদ্দেশ্য ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করা। কাজটা করা হচ্ছে ধাপে ধাপে, সুকৌশলে। যদি দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের কথা বলতে চান তাহলে এক রাষ্ট্র বা দুই রাষ্ট্রের কথা বললে চলবে না। বৃহত্তর ইসরায়েল নামে যা ঘটে চলেছে তার কথাও বলতে হবে। এক রাষ্ট্রের সমর্থকদের যুক্তিগুলো বুঝতে পারি আমি, কিন্তু নিজেদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে পালেস্টাইনদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু ইহুদি জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বরণে ইসরায়েল কখনও রাজি হবে না। এক-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কোনো আন্তর্জাতিক সমর্থনও নেই। কাজেই আমার মনে হয় বৃহত্তর ইসরায়েল অথবা কোনো এক ধরনের দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দিকেই এগিয়ে যেতে হবে। প্রায়ই দাবি করা হয়, বিশাল সব ইহুদি বসতি স্থাপনের কারণে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখন আর সম্ভব নয়। হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। কিন্তু আমার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র যদি কথার কথা হিসেবে না বলে সত্যি সত্যি দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ব্যাপারে বাকি বিশ্বের সঙ্গে গলা মেলায় তাহলে ইসরায়েলকেও এ ব্যাপারে কঠিন একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গত ৫০ বছরে এ ব্যাপারে ইসরায়েলের নীতিটি আপনাকে দেখতে হবে। ৭০-এর দশকে ফিরে যান, মৌলিক সিদ্ধান্তগুলো যখন নেওয়া হয়েছিল। সে সময় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দুই রাষ্ট্র স্থাপনের ব্যাপারে একটি প্রস্তাবের ওপর বিতর্ক চলছিল। এমন একটি উদ্যোগ, যেটি বাস্তবায়িত হলে দুটি রাষ্ট্র পাশাপাশি শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বাস করতে পারবে। ইসরায়েল এর বিপক্ষে ছিল, ঐ অধিবেশনে অংশ নিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তারা। প্রস্তাবের পক্ষে ছিল মিশর, জর্ডান, সিরিয়া। সাধারণ পরিষদে একই ধরনের প্রস্তাবের পক্ষে ১৫০-৩ ব্যবধানে ভোট পড়েছিল। কেবল ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। ইসরায়েল সে সময়ই নিরাপত্তার বদলে নিজেদের সীমানা বাড়ানোকে বেছে নেয়। অর্থাৎ সুরক্ষা ও সমর্থনের জন্য একটিমাত্র শক্তিশালী দেশের ওপর নির্ভরশীলতাকে বেছে নেয় তারা। তার মানে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি তার নীতিতে পরিবর্তন আনে তাহলে ইসরায়েলকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আল জাজিরা: খুব কম বুদ্ধিজীবীই আপনার মতো বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। অতীতে যেসব অবস্থান বেছে নিয়েছেন তার কোনোটির ব্যাপারে কি আফসোস আছে আপনার?
চমস্কি: অবস্থান বেছে না নেওয়ার জন্য আফসোস আছে। যেগুলো বেছে নিয়েছি সেগুলো থেকে সরে আসব না। কিন্তু নেওয়া উচিত ছিল, এমন অনেক অবস্থানও নিইনি। যুক্তরাষ্ট্রের মান ধরেও যদি বিচার করেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের একেবারে শুরুর দিকে বিরোধীদের একজন ছিলাম আমি। ১৯৬০-এর দশকের শুরুতেই এ যুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিই। তা-ও বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল। দশ বছর আগে, নিজেদের সাবেক উপনিবেশ পুনরুদ্ধারে ফরাসীদের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর যখন যুক্তরাষ্ট্র সেই দায়িত্ব নিল, দক্ষিণে অনুগত একটা রাষ্ট্র স্থাপন করল এবং জেনেভা চুক্তি ভঙ্গ করে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ মেরে ফেলল, তখনই প্রতিবাদ শুরু হওয়া উচিত ছিল। ষাটের দশকের শেষার্ধের আগ পর্যন্ত তেমন কোনো সংগঠিত প্রতিবাদ ছিল না। ইসরায়েলের কথাই ধরুন। শৈশব থেকেই আমার জীবনের অন্যতম প্রধান প্রসঙ্গ এটি। ১৯৬৯ থেকেই ইসরায়েলের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে জনসমক্ষে কথা বলতে শুরু করি, এটিও করা উচিত ছিল আরও আগে। ১৯৫৩ সালেই ইসরায়েলে মাসদুয়েকের জন্য অবস্থানের সময় ইসরায়েলিদের হাতে প্যালেস্টাইনিদের নিপীড়ন নিজের চোখে দেখেছিলাম আমি। আশ্কেনাজি নয়, এমন মরোক্কান ইহুদিদের ওপর চালানো নির্যাতনও দেখেছিলাম। এসব বিষয় নিয়েই আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। ১৯৬৭-র যুদ্ধ এবং বসতিস্থাপনের ইসরায়েলি উদ্যোগ শুরু হওয়ার আগে সেভাবে সম্পৃক্ত হইনি আমি। বলতে পারেন, ততটা জোরদার সমালোচনা করিনি, শুরুও করেছিলাম দেরিতে।
আল জাজিরা: আব্রাহাম জোশুয়া হ্যাশেল, যিনি নিজেও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁর দৃষ্টিতে ‘নাভি’ (পয়গম্বর) হচ্ছেন এক বেদনার্ত মানুষ যাঁর জীবন ও আত্মা তাঁর মুখের কথার ওপর নির্ভরশীল, তারপরও মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার নীরব দীর্ঘশ্বাস তিনি অনুধাবন করতে পারেন। আপনার কর্মজীবনের দিকে তাকালে আপনাকেও কি এমন কেউ একজন বলা যাবে?
চমস্কি: নাভি কী? অনিশ্চিত উৎস থেকে উদ্ভুত অস্পষ্ট একটি শব্দ এটি। সঠিকভাবে কেউ জানে না, হয়তো আক্কাদীয় সংস্কৃতি থেকে এসেছে। মানুষ যাদের ‘নাভিয়েন’ বলে জানত তাঁদের সঙ্গে আজকের ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের মিল আছে। তাঁরা ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণের নিন্দা করতেন, ইহুদিদের সতর্ক করে দিয়ে বলতেন, দুষ্ট রাজারা তাদের সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, রাজাদের নৃশংসতা ও অত্যাচারের নিন্দা করতেন এবং বিধবা ও এতিমদের জন্য করুণাভিক্ষা করতেন। ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে আজ যেমন আচরণ করা হয় তাঁদের সঙ্গেও তা-ই করা হতো। মরুভূমিতে তাড়িয়ে দেওয়া হতো, বন্দি করে রাখা হতো। অত্যাচারী রাজার কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন বলে এলিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে তিনি ইসরায়েলকে ঘৃণা করেন। গোটা ইতিহাস জুড়েই এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমরা। আড়াই হাজার বছর আগের দুনিয়া আর এখনকার দুনিয়া এক নয়, তবে বৈশিষ্ট্যগত অনেক মিল আছে।
আল জাজিরা: ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনে বিভিন্ন সময় ভ্রমণ করেছেন আপনি। সেখান থেকে কি কোনো স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে এসেছেন? আনলে তার তাৎপর্য কী?
চমস্কি: এনেছি। প্রথম ইন্তিফাদার সময় কালান্দিয়া উদ্বাস্তু শিবির থেকে নিয়ে এসেছি। তখন কারফিউ চলছিল। ইসরায়েলি ও প্যালেস্টাইনি দুই বন্ধুর সঙ্গে শিবিরে ঢুকতে পেরেছিলাম। ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আগে কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়েছিলাম, কথা বলেছিলাম সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে। তখনই একটি ক্যানেস্তারা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। ইসরায়েলি বাহিনীর ছোড়া কাঁদুনে গ্যাসের ক্যানেস্তারা।
আল জাজিরা: কিসের প্রতিনিধিত্ব করে এটি?
চমস্কি: এটি গত ৫০ বছর ধরে অধিকৃত এলাকায় নির্মম, পাশবিক নির্যাতনের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে চলছে এই নির্যাতন, নিপীড়ন, সহিংসতা। ইসরায়েলি সেনারা চুপচাপ দেখে, কখনও অংশগ্রহণও করে এতে। হেব্রন বা এরকম কোনো এলাকায় যান, স্তম্ভিত হয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ, গাজা। ওখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ। ইসরায়েলি আক্রমণের আগে-পরে আমি গাজায় গিয়েছি। ভয়ংকর অপরাধ চলছে ওখানে। বিশ লাখ মানুষকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ, পানি, পয়ঃনিষ্কাশন--সবই ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। বর্জ্যে ভরা দুই-এক কিলোমিটার এলাকার বাইরে সাগরে যাওয়ার উপায় নেই জেলেদের। ইসরায়েলি গানবোট যেতে দেবে না তাদের। এ সময়ের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধগুলোর একটি চলছে ওখানে। এবং গোলান উপত্যকা। এর সম্বন্ধে এখন আর কেউ কথাও বলে না। নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্রেফ গায়ের জোরে নিয়ে নেওয়া হয়েছে ওটি, ট্রাম্পের সহায়তায়। এসব এলাকাই এখন ইসরায়েলের অভ্যন্তরে।