ন্যাপের মার্কা হলো কুঁড়েঘর, আর তার ছিল সাদামাটা জীবনযাপন- কুঁড়েঘরের বাসিন্দাদের মতোই।
Published : 25 Aug 2022, 10:38 PM
বাংলাদেশে ‘অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ’ নামে দুজন ব্যক্তি ছিলেন। একজন মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কোপন্থী) সভাপতি মোজাফফর আহমদ (১৯২২-২০১৯)। আরেকজন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমিরেটাস মোজাফফর আহমদ (১৯৩৬-২০১২)। আবার স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী।
আমি বহুদিন প্রথম দুজনের পরিচয় গুলিয়ে ফেলতাম। পত্রিকায় একজনের কথা পড়ে আরেকজনের কথা ভাবতাম। আমার সেই দ্বন্দ্ব যিনি কাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আসলে ‘কুঁড়েঘরের মোজাফফর’। এ নামেই নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন তিনি, তার দলের প্রতীক ছিল কুঁড়েঘর। তিনি ছড়া কেটে বলতেন, ‘আমি মোজাফফর আহমদ নূরী, পথে পথে ঘুরি। আমার নাম প্রফেসর মোজাফফর, মার্কা হইল কুঁড়েঘর।’ সেই ‘কুঁড়েঘরের মোজাফফর’-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। তখন তিনি থাকতেন সেগুনবাগিচায় একটা লাল ইটের বাড়িতে, তার একমাত্র মেয়ের বাসা ছিল ওটা।
প্রথম যেদিন তার সঙ্গে দেখা করতে যাই অর্থনীতির ছাত্র শুনে তিনি প্রথমেই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘গরীবের দশ টাকা আর ধনীর দশ টাকা কি সমান?’ আমি কিছু একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম বটে, তবে আমার কথা শেষ না হতেই তিনি যেন খাল-বিল-নদী পেরিয়ে বিশাল সমুদ্রে এনে একটা ফুসে উঠা ঢেউয়ের চূড়ায় আমাকে বসিয়ে দিয়েছিলেন। খুব তীক্ষ্ণ মানুষ ছিলেন, আর ছিল রসবোধ। ছোট ছোট কাহিনি আকারে কথা বলতেন, যা-ই বলতেন তার সঙ্গে ইতিহাসের কোনো না কোনো অনুষঙ্গ বা বাঁক স্বাভাবিকভাবেই যুক্ত হয়ে যেতো। শিক্ষকের ছেলে ও পরবর্তীতে নিজেও শিক্ষকতা করেছেন বলে হয়তো তার মধ্যে শিক্ষকসুলভ আচরণ ছিল, ছিল সাদামাটা জীবনযাপন- কুঁড়েঘরের বাসিন্দারের মতোই।
২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনগুলোতে শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চনাটক দেখতে যেতাম আমি, সেখান থেকে বের হয়ে রাস্তার উল্টোপাশে তার বাসায় ঢু দিতাম। কখনও তিনি ঘুমোতেন, মাঝে মাঝে পেয়ে যেতাম। দু’একজন করে সাংবাদিক, লেখক বা পার্টির লোকজন আসতেন তার বাসায়। আগে থেকে ফোন না দিলে যাওয়া যেতো না, আমি তার কথামতো গেইটে ‘স্যারের ছাত্র’ পরিচয় দিয়ে ঢুকে যেতাম।
কৈশোরে এডমন্ড বার্কের প্রেমে পড়েন মোজাফফর আহমদ। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বার্কের বক্তৃতা তাকে নাড়া দেয়। বার্কের ওই কথাটা তার মুখে আরও গভীর শোনাচ্ছিল- ‘মহৎ মানুষের অন্তর সবসময় দগ্ধ হতে থাকে’।
পরিপাটি লুঙ্গি আর ফিনফিনে ফতুয়ায় তিনি যখন একটা পায়ের ওপর আরেকটা পা তুলে বসতেন আমি তাকিয়ে থাকতাম, যেন বসে আছি বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে। তার বয়স তখন ৮০ পেরিয়েছে আর আমার উনিশ। একদিন শিল্পকলায় শেকসপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ দেখে বের হয়েছি। তখন সন্ধ্যা হয়, ঘোর ঘোর লাগছিল। স্যারের বাসায় গিয়ে দেখি আরও কয়েকজন দর্শনার্থী এসেছেন। সেদিন তিনি তার কৈশোরের গল্প করছিলেন। তখন ব্রিটিশ শাসনামল, কুমিল্লায় (ওই সময়ের ত্রিপুরা) মহাত্মা গান্ধী আসছেন। গান্ধীকে একনজর দেখতে দলে দলে লোকজন ছুটছে। কিশোর মোজাফফরও ছুটে গেলেন সেইদিকে। এতো কষ্ট করে গিয়ে কিনা দেখলেন একজন গা খালি মানুষ! পরনে এক টুকরো গামছা, পায়ে খড়ম আর হাতে লাঠি।
সেদিন ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্য দিয়েছিলেন গান্ধী, ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই হো, দাঙ্গাবাজি ছোড় দো’। আমি তখনও ম্যাকবেথের ঘোরে আছি। ম্যাকবেথ ঘুমের মধ্যে হাঁটছেন আর নিজের হাতের রক্তের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন। ততক্ষণে টোস্ট বিস্কুট আর চা দেওয়া হয়েছে। স্টোটে কামড় দেওয়ামাত্র আমার নীরবতা যেন ভাঙল, বিস্কুটের কিছু গুড়া কোলে পড়লো, শব্দ হবে ভেবে দ্বিতীয়বার কামড় দেইনি। গরম চা দিয়ে ভিজিয়ে কিছুটা নরম করে নিয়ে খাচ্ছি, আর ক্ষণে ক্ষণে স্যারের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছি। স্কুলে পড়ার সময় বিতর্ক করে বেড়াতেন মোজাফফর আহমদ, সেই সূত্রে লেখক ও বাগ্মী এডমন্ড বার্কের প্রেমে পড়েন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বার্কের বক্তৃতা তাকে নাড়া দেয়। বার্কের ওই কথাটা তার মুখে আরও গভীর শোনাচ্ছিল- ‘মহৎ মানুষের অন্তর সবসময় দগ্ধ হতে থাকে’।
মোজাফফর আহমদের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা গত শতকের ত্রিশের দশকে। ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশবিরোধী ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষে সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। তারপর শুরু হলো ভাষা আন্দোলন যা তার মনে বড় প্রভাব ফেলে। তখন তিনি থাকতেন আজিমপুর কলোনিতে, সরকারি কর্মচারীদের একটি ফ্ল্যাটে। তার কথায় ওই বাসাটিই হয়ে উঠেছিল ভাষা আন্দোলনের ‘সদর দপ্তর’। সেখান থেকেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন কমরেড মণি সিংহ, অনিল মুখার্জী ও খোকা রায়সহ আরও কয়েকজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করলেও দুই বছরের মাথায় ছেড়ে দেন, পুরোপুরি যুক্ত হন রাজনীতির সঙ্গে।
একবার তিনি এক জনসভায় গিয়েছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে। প্রচুর লোকের জমায়েত মঞ্চের সামনে। অন্য নেতারা তাদের বক্তব্য শোনালেন, এবার এলেন শেরেবাংলা, সভা-সমাবেশেও তিনি বরিশালের ভাষা ব্যবহার করতেন। বক্তৃতার শুরুতেই জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমরা কওছেন আমার নামডা কী?’ সামনে থেকে একজন উত্তর দিলো, ‘শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক’। তিনি বললেন, ‘না, আমি হইলাম তোমরার ফজলুল হইক্ক্যা’।
একজন বামপন্থী হিসেবে কমরেড মোজাফফর আহমদ ব্যর্থ নন। কারণ প্রতিকূলতার কাছে আত্মসমর্পণ তিনি কখনও করেননি, সারা জীবন কেবল বামপন্থায়ই আস্থা রেখেছিলেন।
মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মোজাফফর আহমদ একবার গিয়েছিলেন যশোরে, কোন এক নির্বাচনী জনসভায়। বক্তৃতার শুরুতেই ভাসানী পাকিস্তানের একসময়ের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ওইরে নুইর্যা, আমার লুঙ্গিডা তুই খুইল্যা লইয়া যা’। বক্তৃতা শেষে মোজাফফর আহমদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এসব আপনি কী বললেন?’ ভাসানী উত্তর দিলেন, ‘আমি ভাষণ দেই মেহনতি দরিদ্র মানুষদের জন্য, টাই-স্যুটপরা ভদ্রলোকদের জন্য না’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মোজাফফর আহমদের চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলেন। তাদের আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু কতো বড় মনের মানুষ ছিলেন সেটা বোঝাতে একবার তিনি একটা কাহিনি শুনিয়েছিলেন। তখন ন্যাপ ও তার ছাত্রসংগঠন ‘ছাত্র সমিতির’ অফিস ছিল সেগুনবাগিচায়। কোন একটা ঘটনায় ছাত্রলীগের ছেলেরা ছাত্র সমিতির অফিস ভাংচুর করে। মোজাফফর আহমদ এ ঘটনা জানালেন শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিব বললেন, ‘বেছে বেছে সব ভালো ছাত্র তো তোমার সংগঠনেই নিয়া নিলা, আমার জন্য রাখলা এদের। এরা অফিস ভাঙবে না তো কী করবে?’ শেখ মুজিবুর রহমান একবার তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি কর্মী রিক্রুট করো আদর্শ দিয়া আর আমি কর্মী ধইরা রাখি পারমিট দিয়া। একবার পারমিট শেষ হয়ে গেলে আরেকটার জন্য আসে।’
ছাত্রাবস্থায় ন্যাপেরও রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব আমি পেয়েছিলাম তাদের নেতাদের কাছ থেকে, কিন্তু ততদিনে আমি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। যদিও বামপন্থাকে কোন দল হিসেবে না ভেবে একটা চিন্তাপ্রক্রিয়া মনে করি আমি। ন্যাপের ওই রাজনৈতিক স্লোগানটাও আমার ভালো লাগতো না, ‘ধর্ম কর্ম সমাজতন্ত্র’। এটি বেশ আলোচিত একটি স্লোগান। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের যেমন ধারণা- ‘বামপন্থা মানেই নাস্তিকতা’ কিংবা ‘বামপন্থী মানে ধর্মহীন’, সে জায়গায় এমন স্লোগান চমকপ্রদ। তবে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে রাজনীতি না করে মোজাফফর আহমদ যেন সরাসরি তার রাজনৈতিক অবস্থান জানিয়েছিলেন। তিনি ধর্মের কথা বলেছেন, কিন্তু কোন ধর্ম তা বলেননি। অনেক ডান-বাম দল কিংবা তার নেতারাও তো ধর্মকে ব্যবহার করেন ভোটের রাজনীতিতে।
২০১৫ সালে সরকার তাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। পত্রিকাগুলোতে তার প্রতিক্রিয়া ছাপা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা। পদ বা পদবীর জন্য কখনও রাজনীতি করিনি। শেখ মুজিব আমাকে অনেককিছু বানানোর চেষ্টা করেছিলেন, আমি হইনি। আমি মহাত্মা গান্ধী, মওলানা ভাসানীর অনুসারী।’ তিনি বলেছিলেন, ‘পদক দিলে বা নিলেই সম্মানিত হয়, এ দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই। দেশপ্রেম ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছি, কোনো পদক বা পদবি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি। সত্যিকার অর্থে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা কেউই কোনো প্রাপ্তির আশায় করেনি।’ মোজাফফর আহমদের এ সিদ্ধান্ত তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রীয় পদক-পদবী পেতে মানুষ যে দেশে হুড়োহুড়ি করে সেখানে তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সক্রেটিসকে উদ্ধৃতি করে তিনি বলতেন, ‘মরতে যখন হবেই তখন অপরাধ না করেই মরা ভালো’।
স্বাধীনতার পর যারা ধনী হয়েছে মোজাফফর আহমদের মতে তারা একসময় গরিব ছিল। খালের পাড়ে জীর্ণ বেড়ার ঘরে বাস করতো, মাটির শানকিতে ভাত খেতো। কিন্তু তারা আজ তাদেরই অতীতের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে, যত ক্ষোভ দারিদ্র্যের ওপর। আগে তাদের স্ত্রীরা ‘আবুর মা’ হিসেবে পরিচিত ছিল, হঠাৎ হয়ে গেলো বেগম সাহেবা। বেগম সাহেবা থেকে হয়েছে মেম সাহেব। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট থাকা এ মানুষটির পক্ষেই এমন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ সম্ভব।
একসময় সেগুনবাগিচার লাল ইটের বাড়িটা ছেড়ে বারিধারায় চলে যান মোজাফফর আহমদ। তারপর আর দেখা হয়নি তার সঙ্গে। তবে তার কথাগুলো এখনও মনের ভেতর ছোট্ট পাখির ঝরে পড়া কোমল পালকের মতো উড়ে উড়ে ভাসে। এখনও যদি সেগুনবাগিচার দিকে যাওয়া হয়, বাসাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। একজন বামপন্থী হিসেবে কমরেড মোজাফফর আহমদ ব্যর্থ নন। কারণ প্রতিকূলতার কাছে আত্মসমর্পণ তিনি কখনও করেননি, সারা জীবন কেবল বামপন্থায়ই আস্থা রেখেছেন।
তার ‘কিছু কথা’ (১৯৯১) বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “প্রবল বৃষ্টি-বাদলে কামলারা মাছ ধরে। ছাতি মাথায় খলুই হাতে আমি। শূন্য খলুই মাছে ভরলো। দুপুরে খেতে বসলাম সবাই। আমাদের পাতে বড় বড় কৈ। কামলাদের পাতে কুচি চিংড়ি। ক্ষুব্ধ হলাম। উঠে পড়লাম বাসন ঠেলে। মাছ ধরলো ওরা। কষ্ট করলো ওরা, অথচ পাবে না ভোগের অধিকার? এই ক্ষুব্ধতা আজও মনে ধারণ করে আছি।”