Published : 11 Jul 2018, 04:41 PM
শেখ সাহেব বাজার লেনের সাতটি বাড়ির ১৯-এ হাফিজা ভিলার চারতলার ভাড়াটিয়া আব্দুল মজিদ বিচার চাইতে গেছে এলাকার বড়ভাইয়ের কছে। বড়ভাই, সমস্যা কী জানতে চাইলে আব্দুল মজিদ বললো– আমার বউরে। বড় ভাই জিজ্ঞাসা করলেন– তুমার বউরে কী? কিভাবে বলবে তা বুঝতে না পেরে আবদুল মজিদ তোতলাতে শুরু করলো। বড়ভাই আবারো জিজ্ঞাসা করলেন– আরে কউ না ক্যালা তুমার বউরে কী? আব্দুল মজিদ আবারো বললো– আমার বউরে। বড়ভাই রেগে বললো– আরে হালায় জাবর কাটতাচ ক্যালা, কইতাচ না ক্যালা, তুমার বউরে কী? এবার আব্দুল মজিদ একটানে বলে ফেলে– আমার বউরে বটি নিয়া মারবার আইচিল লিটন মিয়া। বড়ভাই এবার কৌতূহলী হয়ে মজিদের মুখের কাছে মুখ এনে বলে– কুন লিটন মিয়া? এবার আব্দুল মজিদ একটানে বলে– আমগো নিচতলার লিটন মিয়া। লিটন মিয়াগো আসল বাড়ি অইতাছে কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুর থানা। লিটন মিয়ারা দুই ভাই এক বুন– লিটন, মিলটন আর লিমা।
অলংকরণ: ফাহমিদা জামান ফ্লোরার জলরং চিত্রকর্ম
হেগোর বাপ হাকিম মিয়া একটা ভাদাইম্যা, টাউট। কয় ঠিকাদারির ব্যাবসা করে, আসলে হালায় কিচুই করে না, মহল্লার সব দুকান থিক্যা বাকি খায়া রাখচে পয়সা দেয় না, অহন সবার থিক্যা পলায়া বেড়ায়, কারুর সামনে পরে না। ভোরবেলা ঘুম থিক্যা উঠ্যাই বাইরয়া যায়, আর দুকান সব বন্দ অইবার পর বাড়ি আহে। এসব ফিরিস্তি শুনে ধমক দিয়ে মজিদকে থামিয়ে বড়ভাই বললে, আরে মিয়া, লিটন মিয়ার চৌদ্দগুষ্টির ঠিকুজি হুনবার চাইচিনি তুমার কাচে। আছল কতা কউ, লিটন মিয়া তুমার বউরে মারবার আইচিল ক্যালা? বড় ভাইয়ের রাগ দেখে মজিদ খুকখুক করে কাশতে কাশতে বলে, ক্যাঠায় নাকি লিটন মিয়ার মায়রে কইচে যে আমার বউ নাকি হেরে গাইল পারচে। লিটন মিয়া ইস্কুল থিক্যা আইতেই হের মায় কাইন্দা বিচার দিয়া কইচে, আমারে গাইল পারে? আমারে গাইল পারে ওই খানকি মাগি, আইজ যদি অর বিচার না করচচ তয় আমারে মা কইয়া ডাকবি না। আর হেই কতা হুইন্যা আমি দোকানে থাকারসুম লিটন মিয়া বটি লয়া আইয়া আমার বউরে কাইট্যা হালাইব কইরা ধমক পাইরা গেচে। শুনে বড়ভাই তার ভুড়ি নাচিয়ে হাসতে হাসতে বলে, লিটন মিয়া ইস্কুলে পড়ে! ইস্কুলে পড়ে এক ছ্যামরায় তুমার বউরে বটি লয়া ধমকায়া গেচে আর তুমি আইচ আমার কাচে বিচার দিবার! তুমি হালায় মাইগ্যা নিহি? যাও, গিয়া আবার নিজের পেগাম্বরি করাও!
বড়ভাই মজিদকে আবার নিজের খৎনা করাতে বলেছেন। কথাটা শেখসাহেব বাজার লেনের একেবারে শেষ মাথার ছাপড়া মসজিদের সামনের সালাম ট্রেডার্স পর্যন্ত চাউর হয়ে যায়। আর ওই লেনের সবাই হাসির গুল্লোড় তুললে কথা গড়িয়ে যেতে থাকে বিভিন্ন দিকে– হুনচি আব্দুল মজিদের বউটা নিহি পরির লাহান ছুন্দর। একজনের কথার মাঝখানে আরেকজন ফোড়ন কেটে বলে, আব্দুল মজিদের বউটা ছুন্দরী বইল্যাই হের অত জ্বালা অইচে। হুনচি মজিদের দেখভাল নিহি ঠিক মতন করে না। দেমাগ দেখায়া সারাদিন বইয়া থাকে। অন্যজন আবার তা উড়িয়ে দিয়ে বলে, আরে না না, মজিদ সিক্ষিত মাইয়া সাদি করচে, বউ নাকি সারাদিন বইয়ের দিক চায়া থাকে। হের লিগ্যাই নিজে অসিক্ষিত অয়া সিক্ষিত মাইয়া সাদি করতে নাই। আরেকজন নিজের মত দিয়ে বলে, বউ অইতাচেগা ঘরের লক্ষ্মী, হের অত বই পড়নের কাম কি? মগর মজিদের বউ লিটন মিয়ার মায়েরে গাইল পারছে ক্যালা?
ক্যালা গাইল পারচে। কেউ ঠিক মতো বলতে পারে না। শুধু নতুন করে খৎনা করানো নিয়ে রস লাগাতে থাকে–সকালের তন্দুর রুটি আর বিকালের তেলেভাজার সাথে। আবদুল মজিদের বউ সুন্দরী হলেও বই না পড়লে এলাকার মানুষ তাকে চিনতই না। আর লিটনের মাও তা নিয়ে মাথা ঘামাতো না। আব্দুল মজিদ বিয়ে করার পর বেগম বাজারের তিনটি শোবার ঘর, রান্না ঘর, বাথরুম আর একফালি উঠানে একটা কামিনী গাছসহ ইটের দেয়লের উপরে টিনের চাল দেয়া পৈত্রিক বাড়ি রেখে ভাড়াটিয়া হয়ে কবুতরের খোপের মতো আড়াই কামরার পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাটের হাফিজা ভিলার নিচতলায় লিটনদের পাশের ফ্লাটটিতেই এসে প্রথমে উঠেছিল। বাপমায়ের মৃত্যুর পর বড় বোন মনোয়ারা ও তার স্বামী তিন ছেলেসহ বাড়িতে নিজেদের দখল পাকাপোক্ত করে নিলে মজিদ বিরক্ত হয়ে ওঠে। দুলাভাইয়ের অযাচিত শাসন, সবকিছুতে নিজের ইচ্ছার প্রধান্য, বাড়ি মেরামত করতে তার কত টাকা খরচ হয়েছে– প্রতিদিন এইসব ফিরিস্তি শুনতে ভালো লাগেনি তার। তাছাড়া বউ নিয়ে ওই বাড়িতে ওঠার পর বউয়ের ওপরে বড় বোনের অনবরত খবরদারিতে টিকতেও পারেনি। তাই সে বেগমবাজার থেকে বেশ একটু দূরে শেখসাহেব বাজরে এসে বাসা ভাড়া করেছে। এখানে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই লিটনের মা তার ছেলের বয়সের কাছাকাছি বিষয়বুদ্ধিহীন নতুন বউটির কাছ থেকে প্রতিদিন পেঁয়াজ-রসুন-আদা-কাঁচা মরিচ থেকে শুরু করে মেহমান এলে ফ্রিজের মাছ-মাংস পর্যন্ত ফেরত দেবে বলে ধার নিয়ে কখনো ফেরত দিত না। এর এক বছর পর হাফিজা ভিলা চারতলা হয়ে গেলে আব্দুল মজিদ বউকে নিয়ে চারতলার বাঁদিকের ফ্ল্যাটটিতে উঠে যায়। যদিও এর ভাড়া নিচতলার চেয়ে দুশো টাকা বেশি পড়ে। বউয়ের আকাশ দেখার শখ আছে। বেগম বাজারের লজেন্স-বিস্কুট-চানাচুর আর আচারের পাইকারি ব্যবসায়ী মজিদের পার্টিদের বেশির ভাগই মনোহরদি থানার কাঁচিকাটা. চন্দনবাড়ি, চালাকচর, লেবুতলা, খিদিরপুর, চরমান্দালীয়া এলাকার। এক পার্টি জুলমত আলীর মাধ্যমে মজিদ বিয়ে করেছে চরমান্দালীয়ার সাবান আলীর ছোট মেয়েকে। যখন পরিবার পরিকল্পনার অফিস বসলো মনোহরদি থানা শহরে– দূর-দূর দেশ থেকে চাকরি করতে আসা কুচি দিয়ে পরা শাড়ি আর কাঁধে ব্যাগ নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অফিসের মহিলা-পুরুষেরা গ্রামে-গ্রামে ঘুরে ভেসেকটমি ও লাইগেশন করাতে শুরু করলো তখন একদিন সাবান আলীর স্ত্রী আফিয়া বেগম নিজের লাইগেশন করাবে বলে জানালো। ছেলে না থাকায় তা নিয়ে সাবান আলী চেঁচামেচি শুরু করলে আফিয়াও মেজাজ তিরিক্ষি করে বললো আমি কি তুমার বাচ্চা জর্ম দেওনের মিশিং নি? একথা শুনে সাবান আলী তেড়ে গেলে সে বলেছিল পোলা না অওয়া বেডা মাইনষের দুষ, বেডি মাইনষের না। ফরিবার ফরিকল্পনার ওফিসে আমারে ফডু দেখাইয়া ছাইন্সের যত কতা আছে, আফারা সবকিছু বুজায়া দিছে। এটা যে পরিবার পরিকল্পনার বেটিরার যাদুটোনা– তা বুঝতে বাকি থাকে না সাবান আলীর। এ নিয়ে সে ইউনিয়নের চেয়ারম্যনের কাছে গিয়েও কোনো ফল পায় নি। চেয়ারম্যান পরিবার পরিকল্পনার বেটিরার পক্ষেই কথা বলেছে। চরমান্দালীয়ার প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার গ্রামে-গ্রামে ঘুরে কৃষকদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগলে সাবান আলী তার মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়েছিলো। কয়েকমাস পর বড় তিন মেয়ের মাথায় শুধু গোবর বলে ঘোষণা দিয়ে– হেডমাস্টার সাহেব বড় তিন মেয়ের আর স্কুলে আসার দরকার নেই বলে জানিয়ে দিলো। তাছাড়া গরীবের ঝিয়ের আবার লেখাপড়া কী? তবে স্কুলে টিকে গেছে ছোট মেয়েটি। আফিয়া বেগম লাইগেশন করে একটি শাড়ি আর কিছু নগদ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে এলে ছেলে হবার আর কোন সম্ভাবনা নেই জেনে সাবান আলীর মন-মেজাজ ভালো না থাকলেও কিছুটা ডাগর হলেই বড় তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। বউয়ের ভয়ে ছেলে হবার আশায় আরেকটি বিয়ে করার চিন্তুা বাদ দিয়ে অগত্যা ছোট মেয়েকে অনেক দূরের হাই ইস্কুল পর্যন্ত পড়ানোর জেদ ধরে সাবান আলী। ক্লাস ফাইভের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে হেড মাস্টার ঘোষণা দিলেন– সাবান আলীর ছোট মেয়ের হাইস্কুলের লেখাপড়ার দায়িত্ব তার নিজের। কিন্তু মেয়ে ক্লাস এইট পাশ করে নাইনে ওঠার পরই মাত্র তিন দিনের ডায়রিয়ায় সাবান আলীর স্ত্রী আফিয়া বেগমের মৃত্যু হলে ছোট মেয়েকেও বিয়ে দিতে হলো। মেয়ে যদিও লেখাপড়া করবে বলে খুব কান্নাকাটি শুরু করে বললো। আর দুই বছর পড়লেই সে মেট্টিক পাশ করবে বলে বাপকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললো, আব্বা, অমি অহন বিয়া বইতাম না। কিন্তু ঘরে মা ছাড়া সোমত্থ মেয়েকে রাখতে আর সাহস করলো না সাবান আলী। জুলমত আলীর কথামতো ডাহা শহরের বড় ব্যাবসায়ী আব্দুল মজিদের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করলো। তবে আব্দুল মজিদ বউকে ডাহা শহরের সবচেয়ে বড় ইস্কুল যেখানে খান্দানি পরিবারের মেয়েরা লেখাপড়া করে সেই আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল থেকে বউকে মেট্রিক পাশ করাবে বলে কথা দিল। তখন খুশিমনেই মেয়ে বিয়েতে রাজি হলো। বড় সুটকেস ভরে মজিদের আনা চার পদের সোনার গহনা-কাতান শাড়ি-সায়া-ব্লাাউজ-ব্রেসিয়ার-জুতা সহ সাজগোজের বি¯তর জিনিস দেখে গ্রামের মানুষ মেয়েটির রাজকপাল বলে ধন্য-ধন্য করতে লাগলো। বিয়ের পর নাইনের বইয়ের সাথে ঢাকা থেকে বদলি হয়ে আসা ইস্কুলের নতুন স্যারের দেয়া দুই তিনটি মাসুদ রানা সিরিজের বই নিয়ে স্বামী আবদুল মজিদের সাথে ঢাকার পথে রওয়ানা হলো। কিন্তু আজিমপুর গার্লস হাই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস বললো, আগের ইস্কুলের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ছাড়া স্কুলে ভর্তি করা যাবেনা। এরপর বউ নিয়ে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনতে মজিদ চরমান্দালীয়া গেলেও একদিনে তা আনা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ততদিনে শ্বশুর সাবান আলী তার চাচাত শালীকে বিয়ে করে আবার সংসারে মন দেওয়ায় টিসির পেছনে দৌড়াদৌড়ি করে সময় নষ্ট করার সময় তার নেই। বাপের এমন হাল দেখে মজিদের বউ আর বাপের বাড়ির নাম নেয়নি। নাইনের বই আর মাসুদ রানা সিরিজের কয়েকটা বই পড়তে পড়তে নদী আর আকাশ দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে সে। কিন্তু ঢাকা শহরে মজিদ নদী পাবে কোথায়? দুয়েকবার বুড়িগঙ্গায় বেড়াতে নিয়ে গেলেও বউ বুড়িগঙ্গা পছন্দ করেনি। নাক কুঁচকে বলেছে, উহ্ পানিত কিমুন গন্দ আর নদীর পাড়ে খালি দালান। কুনু ফসলের খেত নাই কাশফুল নাই এই নদী দিয়া আমি করুম কী? তাই হাফিজা ভিলা চারতলা হয়ে যাওয়ার পর আকাশ দেখার জন্য বউয়ের ছাদে উঠা কষ্ট বলে চারতালায় উঠে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মজিদ।
মজিদকে নতুন করে খৎনা করানোর যে পরামর্শ বড়ভাই দিয়েছিল তা নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে নানা রকমের খোশগল্প চলতেই থাকে। শুক্রবার সকালে না¯তার পর দুপুরে পোলাউ রান্নার কথা বললে বউ জানায় ঘরে ঘি নাই। বাঘাবাড়ির ঘি আনলে পোলাউয়ের ঘ্রাণ ভালো হয়। সাথে খাসির মাংস খেতে চাইলে যেন এক কেজি খাসির মাংস আনে, না হলে ফ্রিজে মুরগি আছে। খাসির মাংশ নিয়ে ঘি কিনতে ছাপড়া মসজিদের সামনের সালাম ট্রেডার্সে গেলে দোকানের মালিক আব্দুসসালাম মজিদকে বলে বড় ভাই ইঠা কিমুন বিচার করল মাজিদ ভাই? লিটনের বাপরে ডাইকা লিটনরে দুইটা থাবর না দিয়া আপনেরে আরেকবার পেগাম্বরি করনের পরামর্শ দিল। নাহ, কামডা বড়ভাই ঠিক করে নাইক্যা। যার ঘরে ইমুন সোন্দর বউ, হের পেগাম্বরির বাকি আচেনিহি? বলে আবদুসসালাম হিহিহি করে হাসে। তা দেখে মজিদের মেজাজ খিচড়ে যায়। সে ঘি নিয়ে এসেই বউয়ের ওপর চড়াও হয়, অই মাগি তুই লিটনের মায়েরে গাইল পারচচ ক্যালা? স্বামীর এমন রূপ দেখে মজিদের বউ তো অবাক। মজিদ কখনো তাকে তুই করেই বলে না। আজ একেবারে মাগি! তবে তার অবাক চেহারা বেশিক্ষণ থাকে না। বউয়ের মুখে কোনো উত্তর না পেয়ে মজিদ যখন আরো রেগে গিয়ে তার চুলের মুঠি ধরে চেচিয়ে বললো, খানকি মাগি কতা কইতাচচ না ক্যালা? রূপের দেমাগ বেসি অইচে? তুই যে পাসের গল্লির মেছবাড়ির খালেদের লগে ফস্টিনস্টি করবার লাগচচ, হে কতা হুনি নাই মনে করচচ?
লিটন পড়ে ওয়েস্টএন্ড স্কুলে। নিচতলার বাসায় থাকতেই লিটনও যে মাসুদ রানা সিরিজের বই পড়ে– এই খবর মজিদের বউ কদিনের মধ্যেই জেনে গিয়েছিল। এরপর লিটনের কাছ থেকে মাসুদ রানার বই ছাড়াও ওয়েস্টএন্ড স্কুলের লাইব্রেরির অন্যান্য বইও আনিয়ে পড়তে শুরু করে। তবে অন্য বই মাসুদ রানার মতো এতো ভালো লাগে না তার। লিটনের মা সেই সময় থেকেই মজিদের বউয়ের কাছ থেকে পেঁয়াজ-রসুন-আদা-কাঁচা-মরিচ নেয়ার বাড়বাড়ন্ত শুরু করেছিল। এরপর আস্তে আস্তে মাছ-মাংশের দিকেও যখন হাত বাড়ানো শুরু করেছে তখনই তারা চারতলায় উঠে এসেছে। তাতেও কোনো সমস্যা ছিল না, চারতলায় উঠতে লিটনের মায়ের কষ্ট হয় না। সমস্যা অন্য জায়গায়। যখন রাতের বেলা বাসায় ফেরার সময় আবদুল মজিদ আগে নিচতলায় ঢোকে– লিটনের মায়ের হাতে চা খেয়ে তার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে চারতলায় নিজের বাসায় আসে। এই খবর নিচতলায় লিটনদের পাশের বাসায় আসা নতুন ভাড়াটিয়া সজলের মা ছাদে কাপড় নাড়তে এসে মজিদের বউয়ের কাছে বলার পর থেকেই লিটনের মাকে ঘরের জিনিস ধার দিতে অস্বীকার করা শুরু করলো সে। যখন চেয়েই আর জিনিসপত্র পায় না তখন লিটনের মা নিজে না এসে–লিটন যখন মজিদের বউকে বই দিতে আসে–তখন লিটনকে সে ডেকে বলে, লিটন তর কাকিরে কইছ ফ্রিজে মুরগি থাকলে একটা মুরগি দিতে। শুক্কুরবারে তর আব্বায় মুরগি আনলে ফিরত দিমুনে। লিটনের হাত থেকে বই নিয়েও মজিদের বউ লিটনকে বারবার বলতে থাকলো, লিটন, এই সাপ্তা না তুমার কাকা বাজার করে নাই। ভাবীরে গিয়া কইয়ো ঘরে কিছু নাই। শুনে লিটনের মা থম মেরে থাকে। কিন্তু লিটনের কাছ থেকে মজিদের বউয়ের বই নেওয়া বন্ধ হয় না। লিটন বয়সে মজিদের বউ থেকে বছর তিন ছোট হবে। মজিদকে লিটনের মা মজিদ ভাই বলে ডাকে। তাই লিটনরা মাজিদকে কাকা বলে ডাকে আর তার বউকে কাকি। বই নেওয়ার সাময় কাকি লিটনের হাতে মাঝেমধ্যে দশ-বিশ টাকা গুঁজে দেয়। সেও চুপ করে পকেটে ঢোকায়। সেদিন লিটনের মা তার পকেটে টাকা দেখে প্রশ্ন করে জানতে পারে যে এই টাকা কাকি তাকে দিয়েছে। আবার সে থম মেরে থাকে কয়দিন।
এরপর এক দুপুরে সাজলের মা বিছানার চাদর নাড়তে ছাদে এসে ফেরার পথে মজিদের বাসায় কলিং বেল টেপে। দরজা খুলে সজলের মাকে দেখে মজিদের বউ ঘরে এনে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করে চা খাবে কি না। সজলের মা বলে, না গো ভাবি অবেলায় চা খামু না। আমি খালি দুই বেলা চা খাই, সকালে আর বিকালে। আজ বুয়া আসে নাই, সব কাজ একলা করতে লাগতাছে। চা খাওনের সময় নাইক্কা। আফনে লিটনের মায়ের লাইগ্যা সুন্দুর একটা শাড়ি কিন্যা অনছেন দেইখ্যা খুব ভালা লাগল, এই কথাটাই কইতে আইছি। সজলের মায়ের কথা শুনে মজিদের বউ অবাক হয়ে বলে, আমি লিটনের মায়ের লাইগ্যা শাড়ি কিন্যা আনছি? বউয়ের কথা শুনে সজলের মা বলে, উম্মা, আফনে আনুইন নাই! কিন্তু কাইল রাইতে মজিদ ভাই লিটনের মায়েরে শাড়িডা দিয়া না কি বলছে, আফনে নিজে পছন্দ কইরা আনছেন। শাড়ি দেখায়া লিটনের মা আমারে বলছে, বুঝলা সজলের মা, আসলে এই শাড়ি হইল গিয়া আমারে ঘুষ দেওয়া। ঐ খানকিমাগি যে পাশের গল্লির মেছবাড়ির পুলা খালেদের লগে ফস্টিনস্টি করে– এ কথা যেন কাউরে না কই, হের লাইগ্যা এই ঘুষ। আমি শুইন্যা ত একেবারে আসমান থিক্যা পরছি। আফনে ইমুন একটা ভালা মানুষ, কারোর সাথেও নাই পাছেও নাই, সারাদিন বইয়ের মইদ্যে মুখ গুইজা থাকেন। কারুর ঘরে গিয়া একবার গল্ফগুজবও করেন না। লিটনের মা আফনেরে লইয়া ইমুন একটা কথা কইল? আল্লায় হের বিচার করব। একথা শুনে মজিদের বউ সজলের মাকে বলেছে, নিজেই খানকি, আমার জামাইর মাথা চাবাইয়া খাইবার চায়। হের লাইগ্যা রোজ রোজ আমার জামাই দুকান থিকা ফিরনের সময়, নিজের ঘরে টাইন্যা লইয়া যায়। একথা শুনে সজলের মা দৌড়ে নিচতলায় গিয়ে লিটনের মায়ের সামনে মুখ কালো করে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললে, আফা, আফাগো, আফনে নাকি একটা খানকি। আফনেরে নিয়া মজিদ ভাইয়ের বউ ইমুন কথাটা কেমনে কইল! আফনে যে মজিদ ভাইরে ছোট ভায়ের মতন দেখেন, সেইটা কি আমি বুঝি না? আর আফনে নাকি মজিদ ভাইয়ের মাথা চাবায়া খাইতাছেন! রোজ রোজ মজিদ ভাই দুকান থিকা ফিরনের পথে আফনে নাকি তারে ঘরে ডাইক্যা আইন্যা দরজা লাগাইন। ছি ছি ছি, আফনে পুলাপানের মা, আফনেরে নিয়া ইমুন কথা? আল্লায় হের বিচার করব।
লিটনের মা একথা শুনে কেঁদেকেটে মেছাকার করে। লিটন স্কুল থেকে আসার পর তাকে বলেছে, তুই আমার অত্ত বড় একটা পোলা থাকতে মানুষ তর মায়েরে খানকি কয়া গাইল দেয়। আইজ এর বিচার না করলে আমি গলাত দরি দিয়া মরুম। তুই আর আমারে মা কইয়া ডাকবার পাবি না। নিজের মাকে খানকি বলে গাল দিয়েছে! এই কথা শোনার পর লিটনের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলে সে রান্না ঘর থেকে বটি নিয়ে দৌড়ে চারতলায় গিয়ে মজিদের বউকে বলে, আমার মাকে খানকি বলে গাল দেন, আপনের এত সাহস! আর কোনোদিন যদি শুনি, তবে এক কোপে আপনের গলা নামায়ে দেব। বলার পর কাকিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে লিটন দৌড়ে নিচে নেমে এসেছে।
মজিদ তার বউকে চুলের মুঠি ধরে মেছবাড়ির খালেদের সাথে ফস্টিনস্টি করার অপরাধে বিছানায় ফেলে ঠেসে ধরার পর শেখসাহেব বাজার লেনের সবার কাছে খালেদের কথা চাউর হয়ে যায়। সেই গলির পুরুষেরা আবার খালেদকে নিয়ে পড়ে। আইচ্যা, মেছবাড়ির খালেদ পুলাটা কিমুন? খুব ছুন্দর নিহি? না কি খুব ধনী? মজিদের চায়া বেসি ধনী? খালেদ ইনভারছিডিত পড়ে নিহি? মেছবাড়ির পোলাগুলান ত সব ইনভারছিডিত পড়ে। হের মাঝে খালেদ পুলাটা কুনটা? কিন্তু শোনা গেল খালেদ ইউনিভারসিটিতে না গিয়ে সারাদিন মাসুদ রানার বই পড়ে। আর রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। এটা নিয়ে ছাপড়া মসজিদের সামেনের সালাম ট্রেডার্সের বেঞ্চে বসে থাকা মানুষদের পর্যন্ত বিষ্ময়ের সীমা রইল না। রা¯তায় ঘুইরা বেড়ায়া খালি মাসুদ রানার বই পড়ে! হালায় মাসুদ রানাও দেখচি বহুৎ আজব ঠেকবার লাগচে। হে কিরুম বই লেখে যে পুলাপানে পইড়া ইমুন লাফাঙ্গা অয়া যায় গা। মজিদ যদি মাসুদ রানার বই পরুইন্যা মাইয়া সাদি না করত তয় হের অত জ্বালা অইত নিহি? বউ থাকব বউয়ের লাহান সংসার লয়া, হের অত বই পড়নের কাম কী? দিনকাল বালা ঠ্যাকতাচে না। হালায় মজিদের কপালটাই খারাপ। ইমুন ছুন্দর বউ ঘরে থাকলে বেগানা পুরুষরা ত চোখ দিবই। হের লিগ্যাই অতি সুন্দরী সাদি করন নাই।
আর বাড়িতে বসে পুরুষদের মতো একই সুরে নারীরা আফসোস করতে করতে বলতে লাগলো, মজিদের বউ ছেমরিটার মনে লয় মাথার ঠিক নাই। আবদুল মজিদ ফেলাটটারে কিমুন ছুন্দর কইরা সাজাইছে। নতুন ছুপা-ফিরিজ-ডাইনিং টেবিল-খাট আরো কত কী…। ইমুন বেহেস্তখানার লাহান সংসার ফালায়া মাসুদ রানার বই পড়–ইন্যা মেছবাড়ির লাফাঙ্গা পুলার দিকে নজর দেয়? আরে ছেমরি, বই কি পিন্দুন যায় না খাওন যায় যে তুই খালি বই লইয়া আল্লাদ করচ? সোয়ামির দিক চায়া দেহচ না। বই দিয়া সংসার অইব নিহি? আসলে ছেমরির চরিত্রই খারাপ। খালেদ রাইতের বেলা ছাদে আহে আর মজিদের বউ ছাদে উইঠ্যা গিয়া খালেদের লগে ফস্টিনস্টি করে। আসলে চাইরতলা বাসাত উঠাই মজিদের ঠিক অয়নাইক্কা। ছেমরির চরিত্র খারাপ, এই কথায় কেউ কেউ অমত করে বলে, না, ছেমরির চরিত্র মনে লয় খারাপ না। ছেমরির মাথাই খারাপ। ঐ মাসুদ রানাই অর মাথাটা খারাপ করছে। ঐ মাসুদ রানা ছ্যামড়াটারে ধইরা প্যাদানি দিলে সব ঠিক অয়া যাইব।
মাসুদ রানাকে প্যাদানি না দিয়ে একটা পোলাপান হলে বউটার মতিগতি ঠিক হয়ে যাবে বলে আরেকজন মত দেয়। সজলের মাও তা সমর্থন করে। এরপর মজিদ দোকানে যাওয়ার সময় সজলের মা মজিদকে ডেকে বলে, মজিদ ভাই, মাইনষের কথায় কান দিয়া বউরে খামাখা মাইরধইর কইরেন না। একটা পুলাপান হইলে বউয়ের মতিগতি ঠিক হয়া যাইব। চেষ্টা কইরা দেখেন, একটা পুলাপান হয় কি না। এই কথায় মজিদ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। পোলাপান হওয়ানোর জন্য শরীরের সম¯ত শক্তি লিঙ্গে এনে বউয়ের সাথে প্রতিদিন সঙ্গম করতে থাকে। আর পৌরুষ বাড়নোর জন্য ছাপড়া মসজিদের সামনে শরবতওয়ালার কাছ থেকে রোজ দুই গ্লাস ঘৃতকুমারীর শরবত খাওয়া শুরু করে। সেই কথাও গলির দোকনে দোকানে চাউর হয়ে যায়। শুক্রবার সকালে মজিদ আবার ঘি কিনতে সালাম ট্রেডার্সে গেলে, মালিক আবদুস সালাম মুখের হাসি কান পর্যন্ত টেনে নিয়ে মজিদকে বলে, ভাই অতদিনে লাইনে অইচেন। সুধু ঘৃতকুমারীর সরবত খাইলে অইব না, অখন সইল্যের সক্তি বেসি খরচ অইব। হের লিগ্যা বেসি বেসি কইরা হাঁসের ডিম আর দুধ খাওন লাগব। রোজ তিনটা কইরা হাঁসের ডিম আর দুধ খাইলে আপনের সক্তি অইব ষাঁড়ের লাহান। এই বলে সে মজিদকে ঘিয়ের সাথে এক ডজন হাঁসের ডিম আর একটা মিল্ক ভিটা দুধের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। মজিদ এরপর থেকে সালাম ট্রেডার্স থেকে নিয়মিত হাঁসের ডিম আর মিল্ক ভিটা দুধ কিনতে থাকে। কিন্তু তিন মাস পরেও যখন বাচ্চা হওয়ার কোনো খবর হলো না, তখন শোনা গেল বউ মায়াবড়ি খায়। এটা শুনে মজিদের মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে আবার বউয়ের চুলের মুঠি ধরে বিছানায় ঠেসে ধরে বলে, মাগি, আমি তিন মাস ধইরা এত কষ্ট করতাচি আর তুই মায়াবড়ি খাচ? আইজ তর একদিন কি আমার একদিন। বলে বউকে কিল-চড়-লাথি মারতে মারতে বলে, অই তুই ক্যালা মায়াবড়ি খাচ? পুলাপন না অওয়াইয়া খালি খালেদের লগে লাগানির লাইগ্যা? মায়াবড়ি তরে ক্যাঠা আইন্যা দেয়? ঐ খালেদ চুতমারানির পুলায় ? ক, ক, কইতাচি, আছল কতা ক আমারে। না কইলে তরে অইজ গলা চিপ্যা মাইরা হালামু। বলে গলা চিপে ধরলে বউয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। তখন বউটি হ্যাঁ হ্যাঁ বলার মতো করে মাথা ঝাকাতে শুরু করে। আর মজিদ বিজয়ীর মতো বউয়ের গলা ছেড়ে দিয়ে বলে, অত দিনে স্বীকার পাইলি মাগি। তর খালেদ নাঙ্গেরে এইবার ঠ্যাং ভাইঙ্গা আতে ধরায়া দিমু।
অলংকরণ: ফাহমিদা জামান ফ্লোরার জলরং
সেদিন থেকেই দোকনের কাজ শেষ করে বাসায় আসার আগে খালেদকে ধরার জন্য মজিদ প্রতিদিন পাশের গলির মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে তার অনেক রাত হয়ে যায়। বাসায় এসে দেখে বই বুকে নিয়ে বউ ঘুমিয়ে পড়েছে। বউয়ের বুক থেকে বই নিয়ে সে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু পাশের গলিতে ঘোরাঘুরিতে তার ক্ষান্তি নেই। রাতের বেলা গলি দিয়ে যত ছেলে যায় সবার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় মজিদ কিন্তু কোনটা আসলে খালেদ তা বুঝতে পারে না। কোনো কোনো ছেলেকে দেখে জিজ্ঞাসা করে, ভাই, ঐ মেছবাড়ির খালেদরে চিনেননি? ছেলেগুলো না-বোধক মাথা নেড়ে চলে যায়। তবু মজিদ রোজ রাতে দোকান থেকে ফেরার পথে পাশের গলিতে ঢুকে পড়ে। এক মাথা থেকে আরেক মাথা হাঁটতে হাঁটতে নানান কথা ভাবে। আইচ্চা, খালেদ মুটা না চিকুন? ওর কি মোচ আচে? খালেদ কাইল্যা, সামলা, না ফরসা? কিচুইত জানি না। হুনচি ইনর্ভাছিডির সব পুলায় চসমা পরে। খালেদও কি চসমা পরে নিহি? হালায় খালেদ চুতমারানির পুতের কিচুই ত বুজা পারতাচি না। বুঝার জন্য চারতলা মেসবাড়িটির জনালাগুলোর দিকে তাকায়, একতলা থেকে চারতলা পর্যন্ত ষোলটি জানালা, কোনোটিতে আলো জ্বলছে কোনোটি অন্ধকার তবে বেশির ভাগ জানালাই খোলা। উপরে তাকিয়ে কোন জানালাটা খালেদের তা ঠাহর করার চেষ্টা করে। গলি দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে এমন ভাব করে যেন সে এই বাড়িতেই থাকে, নিচে নেমেছে একটি সিগারেট খাওয়ার জন্য। তখন সে একটি সিগারেট জ্বলায়। এমনিতে সিগারেট খায় না মজিদ। মাঝে মাধ্যে তার পার্টিরা সিগারেট সাধলেও খায় না। কিন্তু সেদিন গলির মাথার পান সিগারেটের টং দেকানটির সামনে দাড়িয়ে থাকলে দোকানি তাকে জিজ্ঞেস করে কি সিগারেট দিবে সে কিছু না ভেবেই বলেছে ফাইভ ফাইভ। দোকনি মজিদের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটু ভেবে এক প্যাকেট ভাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের সাথে একটি লাইটারও দিয়েছে। চারতলা মেসবাড়িটির উল্টোদিকে একটি পুরনো দোতলা বাড়ি। বাড়িটির পেছনদিক এই গলিতে–সামনের অংশটি পরের গলিতে–তাই এই বাড়ির পেছনের ভেঙে পড়া নিচু দেয়ালে হেলান দিয়েও দাঁড়ানো যায়, আবার চাইলে উঠেও বসা যায়। ভাঙা দেয়ালের কছে দাঁড়িয়েই সে তাকিয়ে ছিলো মেসবাড়ির জানালাগুলোর দিকে। দোতলা বাড়িটির নিচতলায় আলোহীন আধখোলা জানালার ভেতর থেকে দুজন নারী পুরুষের রাতের রহস্যময় হাসি-ঠাট্টার শব্দ ভেসে আসে। মজিদের বুক ধক্ করে ওঠে, সে আস্তে আস্তে গিয়ে জানালা ঘেষে কান পেতে দাঁড়িয়ে ভেতরের কথা শোনে। পুরুষটি বলে, আইজ তাঁতীবাজারে গেছিলাম, দেখ তুমার লাইগ্যা কি অনছি। নারীটি বলে, আন্ধারে দেখমু কেমনে? আইচ্ছা দেখুন লাগব না কাপড়টা খুল পিন্ধায়া দিই। কী অনছ কউনা ক্যারে? আরে আমার কইতরী বুঝতাছনা, তোমার লাইগ্যা একটা কোমরের বিছা অনছি। এরপর বেশ কিছু শব্দ, হাসি, হাতের চুড়ির রিনঝিন– মিনিট পাঁচেক খাটের ক্যাচক্যাচ শব্দের সাথে দুজনের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে উঠলে মজিদ ভাবে খালেদ কি এখানে থাকে নাকি? তার বউ কি রাতের বেলা এখানে চলে আসে? একথা মনে হতেই সেখান থেকে দৌড় দেয় সে। তার দৌড় দেখে গলির মুখের হালিমওয়ালা ডাকে মজিদকে। কি অইচে ভাই দৌড়ান ক্যালা? ডরাইচেন নিহি? মজিদ থমকে দাঁড়ায়। বিক্রি শেষে হালিমওয়ালা তার সবকিছু গুছিয়ে রাখছে ভ্যানের ভেতরে। মজিদ গিয়ে একটি টুলে ধপ করে বসে পরে হাফাতে থাকে। হলিমওয়ালা আবার প্রশ্ন করে। ভাই ডরাইচেন ক্যালা ? ডরাইয়েন না, কারেন্টের লাইটের কাছে ভুতপেত্নী অউয়া পারেনা। ভুতপেত্নী সব গেরামে থাকে। তয় মিষ্টির দুকান গুলাতে মাঝ রাইতে মিষ্টি খাওনের লাইগ্যা জ্বীনেরা আহে। জ্বীনের পুলাপানগুলা সব মাদ্রাসায় পড়ে। কেউ কেউ নিকি ইনভার্ছিডিতও পড়ে হুনচি কিন্তু হেরা খুবই আদব কায়দা জানে মাইনষেরে ডর দেহায় না। হাসরের দিন জ্বীন আর ইনসানেরই বিচার অইব, বুঝলেন ভাই। মজিদ কোনো কথা বলে না দেখে সে তার কাছে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বলে, আপনের সইলউল খারাপ অইচে নি? মজিদ টুল ছেড়ে উঠে হাঁটা ধরে। টুলটি গুছিয়ে রাখতে রাখতে পেছন থেকে হালিমওয়ালা আবার বলে, রাইত অয়া গেচেগা অহন বাসায় যান। বলে হালিমওয়ালা গলির উল্টোমুখে বেরিয়ে যায়। মজিদ আবার গলির এমাথা ওমাথা হাঁটতে হাঁটতে খালেদকে কিভাবে ধরা যায় তার কূলকিনার করতে পারে না। এভাবে মজিদের রাত বেড়ে চলে। বাড়তেই থাকে। কোনো-কোনোদিন ঘরে এসে দেখে বউ আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। আর তখনই তার মেজাজ খিঁচড়ে যায়। লাথি মেরে বউকে ঘুম থেকে ওঠায়। এরপর বউ ভাত-তরকারি আবার গরম করে দিলে পেট ভরে ভাত খেয়ে বেঘোরে ঘুমায়। তখন বউ ছাদে গিয়ে কার্নিশে বসে। আকাশের তারা দেখে। চাঁদ দেখে। আকাশের বুকে নদী খোঁজে। ওই তো চরমান্দালীয়ার সেই নদীটি, ওই তো নদী দিয়ে পালের নৌকা চলছে ওই তো ওই তো…
একরাতে মজিদের ঘুম ভেঙে যায়। আধোঘুমে উঠে বাথরুমে গিয়ে প্রস্রাব করে এসে খেয়াল করে বিছানায় বউ নেই। বারান্দায় গিয়ে দেখে সেখানেও নেই। এরপর দরজায় গিয়ে দেখে দরজা খোলা, শুধু চাপানো রয়েছে। মজিদের বুক ছ্যাৎ করে ওঠে, সে দৌড়ে ছাদে যায়, দেখে বউ পাশের গলির দিকের কার্নিশে বসে আছে। তা দেখে মজিদ মনে মনে বলে, এতদিনে বুঝা পারলাম আছল ঘটনা কী। আমি খামাখা খামাখাই এতদিন পাসের গল্লিতে খালি খালি ঘুরছি খালেদরে ধরার লিগ্যা। হ্যায় তো আসলে রোজ রোজ ছাদে অইসা আমার বউরে লাগায়। সালারে গল্লিতে পামু কেমনে?
নিজের বোকামির কথা ভেবে আবার তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। সে বউকে ফের চুলের মুঠি ধরে ঘরে এনে বিছানায় চেপে ধরে বলে, বেশ্যামাগি, তর শইল্যে অত কুড়কুড়ানি? রাইতের বেলা ঘরে না থাইক্যা ছাদের উপ্রে খালেদের লগে লাগাইতে যাচ? আইজ তর কুড়কুড়ানি সবটুক মিটামু। বলে বিছানায় ফেলে একটানে ছিঁড়ে ফেলে তার ব্লাউজ। এরপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামড়ে খামচে স্তন স্তনের বোটা, তলপেট, উরুসন্ধি রক্তাক্ত করে, ক্রুদ্ধ এক ষাঁড়ের মতো লিঙ্গ উচিয়ে বউকে বিদ্ধ করতে করতে বিছানার সাথে মিশিয়ে দিতে দিতে বউয়ের কুড়কুড়ানি মেটানোর উল্লাসে মেতে ওঠে। এরপর শান্ত হয়ে ঘোষণা দেয়, বউয়ের ছাদে যাওয়া একেবারে নিষেধ। কাল থেকে দোকানে যাওয়ার সময় ঘরের বাইরের দিকে সে তালা দিয়ে যাবে। এতদিনে রহস্যের সমাধান করতে পারার আনন্দে আরাম করে ঘুমায় মজিদ। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে তার বেলা হয়ে যায়। আসলে বেলা বেশি হয়নি, মাত্র সকাল আটটার সময় লিটনের মা তাকে ডেকে তুলে চোখ মুছতে মুছতে বলে, মজিদ ভাই আফনের সর্বনাশ হয়া গেছে। আফনের বউ পলায়া গেছে। মজিদ উঠে বসে তাকিয়ে থাকে লিটনের মায়ের দিকে। চোখ ডলে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। লিটনের মা আবার বলে, আফনের বউ পলায়া গেছে। এরপর ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলে, আফনের রক্ষা, ঘরের জিনিসপত্র কিছুই নেয় নাইক্কা। ইস্টিলের আলমারি খুইল্যা দেহেন তো সোনার গয়নাগটি যা দিছিলেন সব মনে হয় লয়া গেছে। এবার মজিদ বুঝতে পারে, চোখ রগড়ানো থামিয়ে সেও ঘরের চারদিকে তাকায়, এরপর তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে নিজের কোমর থেকে চাবি খুলে নিয়ে আলমারি খোলে। ষ্টিলের আলমারির ভেতরের তালা দেওয়া ড্রয়ার খুলে লাল মখমলের কপড় মোড়ানো গহনার বাক্সটি খুলতেই লিটনের মা এসে গহনাগুলো ধরে ধরে দেখে। কানের ঝুমকা, গলার হার, হাতের রুলি, মাথার টিকলি, সবকিছু ঠিক আছে। লিটনের মা হাফ ছেড়ে বাঁচে। এরপর সে মজিদকে বলে, যা অয় মঙ্গলের লাইগ্যাই অয়। আফনে কুনু চিন্তা কইরের না, রান্দাবারার কুনু সমস্যা অইতনা, আমি দেহুমুনে। বলে লিটনের মা চলে যায়। খোলা আলমারি বন্ধ করতে করতে মজিদ দেখে কাপড়চোপড়ও কিছু নেয়নি, নিজের মানিব্যাগ বের করে টাকাগুলো গুনে দেখে ঠিক আছে, তবে সে আবিস্কার করে খালেদ চুতমারানির পুতের লগে ভাইগ্যা যাওনের সময় বউটা নিজের বইগুলি ঠিকই নিয়া গেছে।
মজিদ আবার দোকানে যায়। প্রতিদিন। যেতে যেতে ভাবে– যাউক বেশ্যামাগি, খালেদ চুতমারানির পুতেরেত চিনে না, মধু খাওয়া সেস অইলে হালায় কয়দিন পর মাগিরে যে টানবাজারে বেইচ্যা দিব, মাগি হেই কতা বুজেনাইক্কা। আর শেখ সাহেব বাজার লেন থেকে ছাপড়া মসজিদের সালাম ট্রেডার্সে বসা লোকেরা বলতে লাগলো খালেদ নামের কুনু পুলাই মেছবাড়িতে নাইক্যা, কুনুদিন আচিলই না। মজিদ হালায় একটা পাগল, খামাখা খালেদের পিছে পইরা ছুন্দরি বউটারে হারাইছে। মজিদ হালায় আর কুনুদিন সাদি করা পারব না, হালার কাচে মাইয়া দিব ক্যাঠায়…
২১শে জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
৪ জুন ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ