Published : 24 Dec 2024, 02:23 PM
আমাদের দেশে ছোট পত্রিকার চল বহু বছর থেকে। পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন কিংবা অন্য কোনও বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে উৎসাহী তরুণ লেখকরা গাঁটের পয়সা খরচ করে যেমন দরিদ্রহালে ছোট পত্রিকা বের করতেন, এবং সেধে সেধে সেসব বিক্রি করতে, বর্তমানে কম্পিউটারের কল্যাণে সেসব পত্রিকার চেহারা যেমন পালটে গেছে, তেমনি তাদের সংখ্যাও বোধ করি গেছে কমে। তবে বর্তমানে দেশে কয়েকটি বেশ উন্নত মানের পত্রিকা আছে যারা বছরে একবার কি দুবার প্রকাশিত হয় এবং দেখে তাদের অনিয়মিত ছোট কাগজ বলার কোনও উপায় থাকে না। এই সব পত্রিকা মাঝে মাঝে আমাদের বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিকের ওপর বেশ বৃহৎ কলেবরে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ কর থাকে। এরকম একটি পত্রিকা পুলক হাসান সম্পাদিত ‘খেয়া’ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এদেশেরই অপার সম্ভাবনাময় কিন্তু বর্তমানে অনেকটা স্বেচ্ছায় পর্দার আড়ালে চলে যাওয়া কবি সেলিম সারোয়ার খেয়ার হেমন্ত ১৪৩১ সংখ্যার নির্বাচিত কবি।
মনে পড়ে ১৯৭২ সালে আমি যখন এম এ ক্লাসের ছাত্র, তখনই সেলিম সারোয়ার ইংরেজি বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। আমাদের ক্লাস না পড়ালেও আমি তাঁর টিউটোরিয়াল গ্রুপে আরও চার পাঁচজন ছাত্রের সঙ্গে ক্লাস করেছি। এতো বছর পর কী পড়েছি তা মনে না থাকলেও, উনি যে একজন ভালো শিক্ষক ছিলেন এবং ছিলেন স্টুডেন্ট ফ্রেন্ডলি সেই অনুভূতি মনে হয় এখনো স্মৃতির টাকরায় কোথাও রয়ে গেছে। তাঁর লেখা কবিতা সেসময় আমার তেমন পড়া না হলেও আমার কাব্যপ্রেমিক সতীর্থদের অনেকের মুখেই তাঁর প্রেম বিষয়ক কবিতার লাইন উচ্চারিত হতে শুনেছি। আমার সতীর্থ এবং পরবর্তীকালে কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফয়েজ সিরাজ তার দরাজ গলায় আওড়াতো “কৃষ্ণচূড়া সমাকীর্ণ মঞ্চে মেয়েদের বসন্ত উৎসব দেখা হবে নাকো আর” জাতীয় চরণ। এর প্রায় তিরিশ বছর পর, আমি তখন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিনের দায়িত্বে আছি, তো একদিন কম্পিউটার খুললে হঠাৎ চোখে পড়ে একজন সেলিম সারোয়ার সউদি আরবের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এখানে অধ্যাপনার জন্য খোঁজখবর নিতে লিখেছেন। তিনি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসতে চান বলেও জানিয়েছেন। আমি খুবই খুশি হই কারণ তিনি আমারই শিক্ষক সেলিম সারোয়ার যার একাডেমিক রেকর্ড খুবই ভালো এবং রয়েছে ম্যাকগিলের একটা পিএইচ ডিও। প্রথমদিকে তাঁর কিছুটা দোদুল্যমানতা থাকলেও দেশে তাঁর কাব্যচর্চার খোরাক ও পরিবেশ এবং কবিতা প্রকাশের সুযোগ বেশি ইত্যাদি বলে ভোলালে তিনি ফিরে আসতে রাজী হন এবং সস্ত্রীক চলে আসেন। পরে তিনি নিজেও নর্থ সাউথ ইউনিভারসিটির ইংরেজির চেয়ারম্যান এবং অনুষদের ডিন হয়েছিলেন।
সেলিম সারোয়ার স্বল্পপ্রজ লেখক। অন্যের লেখা সম্পর্কে তো বটেই, নিজের লেখা নিয়েও ভয়ানক খুঁতখুঁতে বলে তিনি বহুপ্রজ হননি, এবং খ্যাতির ঊষালগ্নেই বিদেশ গিয়ে দীর্ঘকাল অবস্থান হয়তো দেশে চর্চিত সাহিত্যে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ বিঘ্নিত করে। তবে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস পড়ানোর চাপ, সেই সঙ্গে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও বলবো দেশে ফেরার পর সেলিম সারোয়ারের সাহিত্যচর্চায় কিছুটা গতি আসে। এসময়ই প্রকাশিত হয় তাঁর অনুবাদের বই শেক্সপীয়রের সনেটসমগ্র। একে তো সনেট অনুবাদ একটি দুরূহ কাজ, তায় শেক্সপীয়রের সনেট। কলেজে পড়ার সময় মনে পড়ে পড়েছিলাম জগদীশ ঘোষের সনেটের আলোকে মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ । সেই বইয়ে উদ্ধৃত একটা লাইন এখনো মনে আছে : “ভালোবাসি সনেটের কঠিন বন্ধন/ শিল্পী যেথা মুক্তি লভে, অপরে ক্রন্দন।“ ছন্দ তাল লয় আর আঁটসাঁট বাঁধন সৃষ্টির পর সনেটশিল্পী হয়তো হাফ ছেড়ে বাঁচেন, কিন্তু সেখানে তো অপরের, অর্থাৎ পাঠকের, খুশি হবারই কথা; তবে হ্যাঁ, কেউ যদি কাঁদেন তো সেটা অনুবাদক। মূল সনেটের জমাট বুনন অবিকৃত রেখে অন্য একটি ভাষায় তা স্থানান্তর করা বাস্তবিকই এক অসাধ্য সাধন। এই কাজটিই সেলিম সারোয়ার করেছেন তাঁর এই শেক্সপীয়রের সনেট সমগ্র-এ। বাংলা ভাষায় কয়েকজনই শেক্সপীয়রের সনেট অনুবাদ করেছেন, কিন্তু সেলিম সারোয়ারের এই অনুবাদ আমার কাছে মনে হয় সবার সেরা কারণ এটা যেমন মূলানুগ, তেমনি শিল্পোত্তীর্ণ এবং একই সঙ্গে গবেষণাধর্মী। ঊনবিংশ শতকের কবি-প্রাবন্ধিক ম্যাথিউ আর্নল্ড বলেন অনুবাদকের উচিত পড়াশোনা করে, গবেষণা করে এবং পূর্ববর্তী অন্যান্য অনুবাদকর্ম সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে অনুবাদে নিয়োজিত হওয়া। সেলিম সারোয়ার সেটাই করেছেন। এখানে শেক্সপীয়রের সনেটের বিভিন্ন অনুবাদের একটা চমৎকার তুলনামূলক আলোচনা এবং কবি-নাট্যকারের সময়ে ব্যবহৃত নানা শব্দের অর্থানুষঙ্গের পরিবর্তন, ভিন্নতর পাঠ ইত্যাদি উল্লেখ করে কাজটিকে তিনি রীতিমতো একটি গবেষণা-অনুবাদে রূপান্তরিত করেন। মনে পড়ে এই বইটির একটি প্রকাশনা উৎসবও হয়েছিলো সম্ভবত পাবলিক লাইব্রেরির, নাকি জাদুঘরের?, ছোটো কোনো অডিটোরিয়ামে; এবং সেখানে খান সারওয়ার মুরশিদ এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও বইটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। সম্ভবত অনুষ্ঠানটার একটা ভিডিও কিংবা অডিও রেকরডিংও হয়েছিলো। সেটা উদ্ধার করা সম্ভব হলে খেয়ার এই বিশেষ সংখ্যায় তা যুক্ত হতে পারতো এবং তাতে নিঃসন্দেহে এই সংখ্যাটির আবেদন আরও বাড়তো।
খেয়ার কবি সেলিম সারোয়ার সংখ্যায় বেশিরভাগ অংশ জুড়েই রয়েছে কবির নিজের লেখা সাহিত্যতত্ত্বের ওপর কয়েকটি দুরূহ গবেষণা প্রবন্ধ, গোটা পাঁচেক ইংরেজি প্রবন্ধ, কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ যখন নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলার ইন রেসিডেন্স হিসেবে নজরুল ইসলামের ওপর গবেষণা করছেন সেই সময়কার কথা এবং অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের ওপর ইংরেজিতে একটি স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ, বেশ কয়েকটি কবিতা—এদের মধ্যে রয়েছে একটি সনেটও, শেক্সপীয়রের দশটি অনূদিত সনেট মূল ইংরেজি সহ এবং শেক্সপীয়র অনুবাদের সেই পূর্বালোচিত গবেষণাধর্মী ভূমিকা। শেষ অংশে রয়েছে সেলিম সারোয়ার সম্পর্কে তাঁর শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি লেখা এবং কবির গুণগ্রাহী বেশ কিছু তরুণ লেখকের সপ্রশংস মূল্যায়ণ। তবে এ ধরণের সংখ্যায় সাধারণত একটি দুটি সাক্ষাৎকার, কিছু পারিবারিক ছবি এবং বংশলতিকাও থাকে। আলোচ্য পত্রিকায় সেসবের অভাব কিছুটা অসম্পূর্ণতা সৃষ্টি করেছে বৈ কি। এছাড়া রচনাগুলির প্রকাশকাল, সনতারিখ ইত্যাদি বিবরণ একেবারেই অপর্যাপ্ত। উপরন্তু মুদ্রন প্রমাদ তো আছেই। এসব দিকে পেশাদারিত্বের অভাব ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা বেশ কঠিন। তবুও বলবো, নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ একজন যথার্থ কবি অনুবাদক ও সাহিত্য গবেষককে সামনে এনে সম্পাদক পুলক হাসান একটি খুবই প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।