স্টিক্স নদী পেরিয়ে কারন যতোই আওকিগাহারা অরণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তার নৌকা নিয়ে, শিশুটির ততোই স্মৃতি লোপ পাচ্ছিলো।
Published : 17 Jul 2023, 10:56 AM
সুধাংশু পূর্বস্বর
---------------------------
“হায়ালিন নিথরা নামের এই নদীটি কখনোই পেরুতে যেয়ো না, কেননা যারাই হায়ালিন নিথরার স্বচ্ছ, গভীর ও বরফের মতো ঠাণ্ডা জল পেরিয়ে অপর পাড়ের ওই সুবিশাল অরণ্যের ভেতরে গিয়েছে তারা আর কখনোই ফিরে আসেনি। কখনো আসবেও না।” ধাইমা শিশুটিকে এই উপদেশ দিয়েছিলো।
ওই বিষণ্ণ নদীর ধারে সারা দিন খেলা ক'রে বেড়াতো শিশুটি, শিকার করতো সোনালি রঙের মাছ। ঝোঁপে-ঝারে সে খুঁজে বেড়াতো কচ্ছপের ডিম আর নদীর উপর দিয়ে ভেসে আসা হাওয়া তার আত্মার গভীরে জন্ম দিতো অতলান্ত শোকের। হয়তোবা এ-কারণেই এই নদীর নাম সে দিয়েছিলো 'ঘনীভূত বিষণ্ণতার প্রবাহ'। এই রহস্যময় নদী সম্পর্কে সে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছে অনেকবার, কিন্তু কোথাও এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য পায়নি শুধুমাত্র লাভক্রাফটের লেখা একটি রূপক কাহিনী ছাড়া।
তার দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো দেবদারু-মেহগনি-শিরীষ গাছের মাথায় শীতকালীন পাখির আনাগোনা দেখে, অনামিকা ফুলের মধু শুষে নিয়ে অথবা জ্যোৎস্নারাতে খোলা জানালা দিয়ে তার বিছানার উপরে আসা মায়াবী আলো ও হাওয়াতাড়িত ছোপ ছোপ ছায়ার রহস্যময়তা উপভোগ ক'রে ক'রে। কিন্তু হায়ালিন নিথরা নদী থেকে ভেসে আসা গুঞ্জন তাকে প্রায়ই বিষণ্ণ ক'রে তুলতো এবং অজ্ঞাত এক আতঙ্ক জাগাতো তার মনে।
নদীটি সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্যে সে তাদের নগরের প্রখ্যাত ভূগর্ভ-লাইব্রেরিতে গিয়েছিলো, যা দেখতে ছিলো অনেকটা আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাচীন গ্রন্থাগারের মতোন। কিন্তু এখানে সে বইয়ের পর বই ঘেটে শুধুই ক্লান্ত হয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ কোনো কিছুরই সন্ধান পায় না। লাইব্রেরির অজ্ঞাত কোনো এক কক্ষে বিমর্ষভাবে একটা ঘণ্টা বেজে ওঠার শব্দ শুনে দূরাগত কোনো এক অপরাধের স্মৃতি মনে প'ড়ে যাওয়াতে তার সত্তায় জাগ্রত হয় আদিম আতঙ্ক। তার মনে হতে থাকে এই রহস্যময় নদীর অশুভ প্রতিভাস তাকে অচিরেই গ্রাস ক'রে নেবে।
উদ্ভ্রান্ত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে স্বয়ং লাইব্রেরিয়ানকেই সে জিজ্ঞেস ক'রে বসে, “কেন হায়ালিন নিথরা নদী পেরুতে আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে নিষেধ করা হয়েছে? ওই নদী কার অভিশাপে অভিশপ্ত?” যান্ত্রিকভাবে লোলচর্ম লাইব্রেরিয়ান শিশুটিকে উপদেশ দেন তাঁর পরিচিত এক শৌখিন চিত্রশিল্পীর কাছে যাওয়ার, যিনি পেশায় একজন ইউনানি চিকিৎসক হলেও পৌরাণিক বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।
ওই বুড়ো চিত্রশিল্পীর সাথে শিশুটির পরিচয় ঘটে পরদিন বিকেলে। পরিচয়পর্বের দিন বৃদ্ধের জন্যে সে নিয়ে গিয়েছিলো একগুচ্ছ নার্সিসাস ফুল এবং প্রথম দিন থেকেই শিশুটি ওই বৃদ্ধের দোকানের ঔষধগুলোর প্রতি হয়ে পড়ে ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট। কেননা ওইসমস্ত তথাকথিত ঔষধের ঝাঁজালো ভেষজ স্বাদ তার ভালো লাগতো। এজন্যে প্রায়ই সে ঐ দোকানে যেতো আর এভাবেই সে বৃদ্ধের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলো। জন্ম ও যৌনতা, প্রেম ও মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর সাথে আলোচনা হতো শিশুটির।
বৃদ্ধ তাকে ঘনীভূত বিষণ্ণতার প্রবাহ হায়ালিন নিথরা নদী সম্পর্কে জানান। জন্ম ও মৃত্যুর রহস্যকে ধারণ ক'রে রাখা এই নদী আসলে গ্রীক পুরাণের বিস্মৃতির নদী স্টিক্সের অংশ আর নদীর অপর পাড়ের ওই সুবিশাল অরণ্যটি হচ্ছে দীর্ঘশ্বাসময় মৃত্যুলোক হেডিস। এই জনপদে যার নাম দেওয়া হয়েছে আওকিগাহারা।
শিশুটি বৃদ্ধের কথা শুনে বিভোর হয়ে যায়। মৃত্যুর এতো কাছাকাছি বাস করে সে? অথচ মৃত্যুর স্বরূপ সে জানে না? মৃত্যুকে সে অনুভব করতে চায়, কেননা মৃত্যু (যা কীনা ঘনীভূত রহস্যের আধার) তার মনের আয়নায় ছায়া ফেলে অনেকটা যেনো ফুলের পাপড়ির ওপর ভ্রমরের ঘুমিয়ে পড়ার মতো।
সেদিন থেকে সে বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
ঝরন্ত পাতারা তাকে বিষণ্ণ ক'রে তুলতো।
পুনরজ্জীবিত ফিনিক্সের কান্নার সুর বহুদূর থেকে ভেসে এসে তাকে ডুবিয়ে দিতো বিষণ্ণতায়।
শেষরাত্রির ঘণ্টার শব্দ তার আত্মায় জাগিয়ে তুলতো এক নিস্তব্ধ বিষণ্ণতা। বিষণ্ণ কোনো এক ফুলের দীর্ঘশ্বাস শুনে মধ্যগ্রীষ্মের কোনো এক সুবাসে ভরা শেষরাতে সে বাসা থেকে পালিয়ে হায়ালিন নিথরার পাড়ে আসে আর দেখা পায় ছোটো একটি কাঠের নৌকার। ইউনানি ডাক্তারকেই সে অধিষ্ঠিত দেখতে পায় পুরাণে উল্লেখিত মাঝি কারনের ভূমিকাতে। শিশুটি একটুও অবাক হয় না, কেননা বাহ্যপৃথিবীর অনেকটাই আমাদের অন্তর্লোকের স্বপ্ন দ্বারা গঠিত। কারন নামের ওই গম্ভীর ও অভিব্যক্তিহীন মাঝিকে কড়ি গুণে দিতেই এই কৌতূহলী শিশুটিকে সে নৌকায় উঠিয়ে নেয়।
স্টিক্স নদী পেরিয়ে কারন যতোই আওকিগাহারা অরণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো তার নৌকা নিয়ে, শিশুটির ততোই স্মৃতি লোপ পাচ্ছিলো। শিশুটি অরণ্যের অসহ্য এক স্বর্গীয় সুর শুনে ক্রমেই বিবশ হয়ে যেতে থাকে।
যখন তারা আওকিগাহারা অরণ্যে পৌঁছায় তখন শিশুটির স্মৃতি পুরোই হারিয়ে গেছে স্টিক্স বা হায়ালিন নিথরার জলে। তার মধ্যে কোনো যুক্তিবোধ নেই, ভাষিক জ্ঞান নেই, তার অস্তিত্ব সম্পর্কেই সে সচেতন নয়, তার মধ্যে আছে শুধু অস্পষ্ট আবেগ আর ভাবালুতা। সে এখন সুতো দিয়ে নাচানো পুতুল।
কারন শিশুটির হাতে বাঁশি তুলে দেয় আর শিশুটি আস্তে আস্তে প্রবেশ করে আওকিগাহারা অরণ্যের গভীরে। ছায়াময় এক সত্তা হিসেবে সে ছায়ামানবদের অর্কেস্ট্রার দলে যোগ দেয়।
বিষণ্ণ ও স্মৃতিহীন হাওয়া বইতে থাকে, কেননা হায়ালিন নিথরার জলে প্রত্যেকেই হারিয়ে ফেলেছে স্মৃতি। স্মৃতিশূন্য শ্বেত ফুলগুলো শিশুটির গায়ের ওপর ঝ'রে পড়ে ও সৌরভ ছড়ায়। মৃত সব আরণ্যক গাছপালায় ও ডালে ডালে হাওয়ার তাড়নে খস খস শব্দ হয় আর দৃষ্টির অগোচরে নিঃশব্দে রাশি রাশি পাতা ঝরে।