তাঁর চিন্তা, মেধা, শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করেছেন তা কেবলই মানুষ এবং জীবনের জন্য; সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য।
Published : 10 Aug 2023, 08:11 AM
সালটা ২০১৭ অথবা ২০১৮। ঠিক মনে নেই। সময়টা এমন ছিলো যে, কোথায় আছি না-আছি তার ঠিক কিংবা ঠিকানা থাকতো না। চিত্রাপাড়ের মানুষ কবি আব্দুল্লাহ আল রিপন স্যার একদিন বললেন: চলেন নড়াইল যাই। নড়াইল শহরের পাশ ঘেঁষে একটি নদীর প্রবাহ। নদীটির নাম চিত্রা। দু'কূল চিত্র'র (নাকি চিত্ত?) মতো সুন্দর বলেই না-কি নদীটির নাম হয়েছে চিত্রা। আহ! চিত্রা, নড়াইল আর কীর্তিনাশা পদ্মায় লঞ্চের ইলিশ মাছ-ভাত। আজও (হয়তো আরও বহুকাল) স্মৃতিতে দোলা দিয়ে যায়।
চিত্রশিল্পের মানুষ নই আমি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখা ছাড়া এ-শিল্প বোঝা আমার সাধ্যেও নেই। কিন্তু মনে এক সুপ্ত বাসনা ছিলো: নড়াইল গেলে সুলতানকে আর তাঁর কর্মযজ্ঞ দেখার সৌভাগ্য হবে। যিনি কি-না তাঁর কাজকর্মে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা তুলে ধরেছেন আর দুনিয়ার কৃষককে করেছেন সেই কেন্দ্রের রূপকার, তাঁর কর্মযজ্ঞ দেখতে পারাটা সৌভাগ্যের ব্যাপার বৈকি। আরও একটি বাসনাও অবশ্য ছিলো: বিজয় সরকারের বিচরণভূমিটাও দু'চোখে ভরতে পারবো।
বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী। গুণগ্রাহীরা বলতেন পাগল বিজয়। বৈরাগ্য ত্যাগ করে না-কি অধিকারী হতে চেয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে কবিগানের এক আসরে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, বাংলার কবি নজরুল ইসলাম। আর কবি জসীম উদ্দীন তাঁর গান শুনে বলেছেন, 'মাঝে মাঝে দেশীয় গ্রাম্য গায়কদের মুখে বিজয়ের রচিত বিচ্ছেদ গান শুনিয়া পাগল হই। এমন সুন্দর সুর বুঝি কেহই রচনা করিতে পারে না।' ফলে এ-আর বলতে: সে কি আর হওয়ার! জাতপাতের বৈরাগ্য ত্যাগ হলেও মরমিয়ার বৈরাগ্য ত্যাগ হয়নি। গেয়েছিলেন তিনি: 'পাগল বিজয় বলে চিত্ত চোর,/ আসবে কি জীবনে মোর,/বুকে রইলো আশা ভরা বাসনা।'
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী শেখ মোহাম্মদ সুলতান ওরফে লাল মিয়া ছিলেন বিজয়কৃষ্ণ সরকারের একান্ত প্রিয় বন্ধু। প্রায়ই ছুটে যেতেন সুলতান বিজয়সঙ্গ করতে। এই বিজয়গাঁথাটুকুর উপলক্ষও আসলে সুলতান। সুলতানের জন্মশতবর্ষ। সেই সুলতান যিনি বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাসকে তাঁর শিল্পকর্মের রসদ হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন। হাজার বছর ধরে কৃষকের শ্রমের উপর আমাদের অঞ্চলটা দাঁড়িয়ে আছে--এই চরম এবং পরম সত্যটি শুধু ধারণ করতেন তাই নয়, তিনি পালন করতেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমার ছবির বিষয় হচ্ছে সিম্বল অব এনার্জি। এই যে মাসলটা, এটা যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। মাটির সাথে যুদ্ধ। তার বাহুর শক্তিতে লাঙলটা মাটির নিচে যাচ্ছে, ফসল ফলাচ্ছে। শ্রমটাই হলো বেসিস।'
তিনি তাঁর বিশ্বাসের কথাই মূলত আর্টে বলতে চেয়েছেন। তাঁর চিন্তা, মেধা, শ্রম দিয়ে যা কিছু নির্মাণ করেছেন তা কেবলই মানুষ এবং জীবনের জন্য; সুন্দর থেকে সুন্দরতম অবস্থায় এগিয়ে যাবার জন্য। যেহেতু চিত্রশিল্পের বুঝ আমার নেই, এই সুলতানকেই আমি অনুধাবন করতে পারি। জ্ঞান করেছেন তিনি: 'আসলে, মূল ব্যাপারটা হচ্ছে এনার্জি, সেটাই তো দরকার৷ ঐ যে কৃষক, ওদের শরীরের অ্যানাটমি আর আমাদের ফিগারের অ্যানাটমি, দুটো দুই রকম৷ ওদের মাসল যদি অতো শক্তিশালী না হয় তাহলে দেশটা দাঁড়িয়ে আছে কার উপর? ওই পেশীর ওপরেই তো আজকের টোটাল সভ্যতা৷'
বোধের পরজ বসন্তের ভারে ন্যুব্জ ছিলেন সুলতান। শাড়ি পরে ঘুঙুর পায়ে নাচতেন; আপন খেয়ালে তিনি নেচে চলতেন। অপূর্ব বাঁশিও বাজাতেন; বাজাতে পারতেন তবলাও। কখনো রাধা তো কখনো কৃষ্ণ সেজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেরাতেন। কেন এভাবে ঘুরে বেড়াতেন আদম সুরত? এই প্রশ্নটি দ্বারা আমাদের অনুধাবন করতে বেগ পেতে হয় না, যে, সুলতান সন্ধান করেছিলেন জীবনের পরমতম বোধের। ফলে, কৃষকদের পেশীর উপর টোটাল সভ্যতাকে দাঁড় করিয়ে ক্ষান্ত হন না তিনি। জীবনকে নানাভাবে বাজাতে চাওয়ার প্রবল অভিপ্সার বোধ থেকে বাঁশি ও তবলা বাজিয়ে, শাড়ি পরে ঘুঙুর পায়ে তিনি নাচেন। রাধা-কৃষ্ণ সেজে মূলত জীবন ও বেঁচে থাকার অপার আনন্দের সমস্তটুকুই শুষে নেয়াই ছিলো এর উপলক্ষ? পান করতেন শেষবিন্দুটা পর্যন্ত? আমাদের মধ্যে এই প্রশ্নটি জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক নয়, যে, তাঁর মধ্যে মাতৃত্বের বোধটিও জাগতো? নারী-পুরুষ একাকার হয়ে মানুষ কেমন হয়, এইসব কর্ম ও কাণ্ডজ্ঞান থেকে তিনি তা অনুধাবন করতে চেয়েছিলেন?
তিনি তো আসলে বাংলার সুলতান। মুখ আর মুখোশ তাঁর আলাদা হয় না! নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার অভিপ্সাও তাঁর মধ্যে বিশেষ কাজ করে না। শঠতা বুঝতেন না তিনি? শিল্প ও কলাসহযোগের? না-কি এই সবকিছুকে ঘৃণায়, বিবমিষায় এড়িয়ে চলতেন? দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো যার শুধু মাটি এবং মানুষের প্রতি; যার ছবির মানুষেরা মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে সংগ্রাম করে, মহব্বত করে যারা বেঁচে থাকে; ফলে এতসব ছলা ও কলার চাতুর্য'র বদলে তিনি জ্ঞান করতেন: 'এদের শরীর যদি শুকনো থাকে, মনটা রোগা হয়, তাহলে এই যে কোটি কোটি টন মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তুসকল আসে কোত্থেকে? ওদের হাতেই তো এসবের জন্ম৷ শুকনো, শক্তিহীন শরীর হলে মাটির নিচে লাঙলটাই দাব্বে না এক ইঞ্চি৷'
১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছুমদিয়া গ্রামে জন্মলাভ করেছিলেন শেখ মোহাম্মদ সুলতান ওরফে লাল মিয়া। জীবদ্দশায় তো বটেই, মৃত্যুর পর যেন দেশে-বিদেশে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনীর হাঁকডাক পড়ে যায়। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই বিভিন্ন শহরে তাঁর ১৭টি একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিলো। ফলে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ সম্মাননা প্রদান করা হলে তিনিই তো বলবেন, 'শিল্পের কখনো পুরস্কার হয় না। শিল্পের ভার তো প্রকৃতি নিজ হাতে প্রদান করে।'
জন্মশতবর্ষে গভীর শ্রদ্ধা জানাই বাংলার সুলতানকে। এই মহান শিল্পীর জন্মশতবর্ষে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষের কাছে এই আর্জিও জানাই: বাংলার সুলতানকে ধারণ করার দায় আছে; দায় আছে গণমানুষের এই শিল্পীর চিন্তাকে, কর্মকে তাঁর মানুষের কাছে পৌঁছানোর। ফলে রাষ্ট্রীয়, সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগতভাবে নানান উদ্যোগ নেয়ারও আহবান জানাই।