শেষে এ কথাও বলতে চাই, কবি আসাদ চৌধুরীর স্বাধীনতা পুরস্কার না পেয়ে চলে যাওয়া আমাদের জন্য সুখকর হয়নি।
Published : 13 Oct 2023, 11:49 AM
বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির যে সম্পদশালী জমিন, সেই ভাণ্ডারে কবি আসাদ চৌধুরীর চিন্তার সোনালি সম্ভার সংরক্ষিত থাকবে, এ নিয়ে কোন বাঙালির সামান্যতম সংশয় নেই! বরং এভাবেও বলতে হয়, যতরকম কাজ আমরা তাঁর জীবদ্দশায় পেয়েছি, তার জন্য কয়টি আসন তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে? কবিতায় নিজের শিল্প-মেধার শক্তি দিয়ে বাংলা ভাষায় একটি সম্পূর্ণ গ্যালারী তিনি সৃষ্টি করে গেছেন। মনে আছে, এই তো বছর পাঁচেক হবে, তার সাথে আড্ডায় কবিতা প্রসঙ্গে বললেন, ‘ রাকীব, কবিতা এখন আর আসে না, জোড় করেও তাকে পাওয়া যায় না! সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে!’ আমি বললাম, আসাদ ভাই কবিতায় যারা এসেছিলেন, সবাই আপনার নামের পাশে সৃষ্টির সৌন্দর্যে জ্বলজ্বল করছে, তারা যায়নি, তারা আছে, থাকবে! তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিতে আমার মন ভরিয়ে দিলেন।আমার কথায় তিনি যে আনন্দিত হয়েছেন, হাসির মাঝেই তার প্রশংসার প্রকাশ ছিল পরিপূর্ণ। এমন অকৃপণ মুগ্ধ করা হাসির মুখমণ্ডল নিয়ে এই পৃথিবীতে কয়জন জন্মাতে পারে!
এক অসামান্য প্রখর ব্যক্তিত্বে গড়া এমন বিরল মানুষ বাংলায় খুব বেশি আমরা পাই না। আসাদ চৌধুরী এমনই একজন কবি যিনি কবিতায় নিজের দেশ, ভাষা এবং সংস্কৃতির সংকটে আমাদের জাতীয় স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেছেন, আমাদের স্বপ্নের ভাঙ্গন তিনি মেনে নিতে পারেননি। দেশ নিয়ে কবিতায় তার ক্রোধ এবং বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা তার নিজের মতো করে প্রকাশ করেছেন, আমরা তার কবিতা যখন পড়ি, উত্তেজিত হওয়ার বদলে উপলব্ধি করি বেশি। তার ব্যক্তিত্ব ছিলো বাংলাদেশের মাটি দিয়ে গড়া এক দেহের ভিতরে সোনার বাংলার প্রাণ। ‘সবারে বাসরে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে।’ অতুলপ্রসাদ সেনের এই জীবনব্রত যেন তিনিও এই বাংলায় আত্মায় ধারণ করে জন্মেছিলেন।
শব্দের একজন প্রকৃত শিল্পী কবি আসাদ চৌধুরী। লিখেছেন যেমন বাগ্মিতায়ও ছিলেন বারুদে ভরা চৌকস। কেবল কবিতায় থেমে থাকতে পারেননি, তার হাতে লেখা শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া আমাদের শিশুসাহিত্যে অনন্য সংযোজন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ অষ্টম সংস্করণ বেরিয়েছে, তিনি নিজেই বলেছেন বইটি নিয়ে, দেশের শাসনভারে যখন যারা ছিলেন তারা সব দলই তার উপরে চাপ সৃষ্টি করেছেন কিছু পরিবর্তনের জন্য, কিন্তু তিনি একটি শব্দও পরিবর্তন করেননি। একজন লেখকের এই চিন্তার জিদ থাকাটা একটি জাতিকে মৌলিক গ্রন্থ উপহার দেয়, আসাদ চৌধুরীর কাছে থেকে আমরা তা পেয়েছি।
তাঁর অসংখ্য ভালো কবিতা আছে, তিনি চলে গেছেন, যতটা গেছেন ততটাই আমাদের কাছে আসবে তাঁর রেখে যাওয়া কবিতা। আমরা একজন মহান কবিকে হারালাম, তাঁর কবিতা আমরা দীর্ঘদিন পড়বো, তিনি বাংলা কবিতার উদ্যানে অন্যতম একটি নন্দিত বৃক্ষ। তার কাব্যগ্রন্থগুলোর নামগুলো এক অপূর্ব কাব্যময়তায় মাদকরসের নেশা আনে, যেমন — ‘তবক দেওয়া পান’, ‘বিত্ত নাই বেসাত নাই’, ‘প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়’, ‘জলের মধ্যে লেখাজোখা’, ‘যে পারে পারুক’, ‘মধ্য মাঠ থেকে’, ‘মেঘের জুলুম পাখির জুলুম’, ‘দুঃখীরা গল্প করে’, ‘নদীও বিবস্ত্র হয়’, ‘টান ভালোবাসার কবিতা’, ‘বাতাস যেমন পরিচিত’, ‘বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই’, ‘কিছু ফুল আমি নিভিয়ে দিয়েছি’ এবং ‘ঘরে ফেরা সোজা নয়’।
তাঁকে যতটুকু কাছে থেকে দেখেছি, সত্য বলার এমন অকপট মানুষ কমই দেখেছি! প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেয়া পান’ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের আপ্যয়নে কার্পণ্য করেননি, বরং মুগ্ধ করেছিলেন। বিটিভিতে প্রচারিত তাঁর প্রচ্ছদ অনুষ্ঠান দেখে অনেকের মতো আমিও তাঁকে প্রথম চিনি এবং তাঁর ভক্ত হয়ে যাই। তিনি তখন আমাদের সবচেয়ে স্মার্ট কবি, সেই তুমুল যৌবনে আসাদ ভাই ছিলেন আমাদের প্রিয় আনন্দ-আইকন, আমি তাঁর মতো স্মার্ট কবি হতে চাইতাম!
তাঁর সাথে আমারও অনেক স্মৃতি আছে, তাঁর মৃত্যুতে আজ দুঃখের বাতাস বড় বেশি ওড়াচ্ছে মনে ঘুমিয়ে পড়া সেইসব স্মৃতিদের! বাংলা কবিতা, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির নিত্য নতুন স্রোতের নতুন প্রজন্ম আপনাকে মনে রাখবে আসাদ ভাই!
কবে আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম তা মনে করতে চেয়ে একটি গল্প মনে পড়ে গেল! বইমেলায় আপনি এবং আবদুল মান্নান সৈয়দ গল্প করছিলেন, আমি মান্নান ভাইয়ের কাছে গেলাম আমার লিটল ম্যাগের জন্য তার লেখা চাইতে, আপনি আমাকে চিনলেন, একজন নতুন-তরুণ লেখককে পরিচয়ের পরে মনে রাখার যোগ্যতা সবার থাকে না, কিন্তু আপনার ছিলো। তারপর আমার কয়েক বছরের সাংবাদিকতা জীবনের কাজে এবং আড্ডায় বিভিন্ন সময়ে নানা জায়গায় আপনার সাথে দেখা হয়েছে। আপনাকে দেখলে মনে হতো দীর্ঘদিনের চেনা প্রিয় মানুষ আপনি। ১৯৯১ সালে আমার দেশ ছেড়ে আসার পরে আপনার সাথে দীর্ঘ ১৭ বছর আর দেখা হলো না। ২০০৮ সালে আপনি মন্ট্রিয়লে এলেন আপনার ভাগ্নে আমাদের প্রিয়জন শামিমুল হাসানের বাসায়। আমরা আপনাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করলাম, বহুদিন পরে আপনাকে দেখে সে কী গভীর টান অনুভব করেছিলাম!
আপনার পরিবারের সাথে প্রায় প্রবাস জীবনে চলে এসেছিলেন, টরন্টো শহরের এমন কোন আড্ডা অথবা অনুষ্ঠান হতো না আপনার উপস্থিতি ছাড়া! ২০১৮ সালে আমাদের বাড়িতে উঠানের আড্ডায় আপনাকে পাওয়া ছিলো পরম আনন্দের। দুইদিন ধরে আপনার সাথে আড্ডা আমাদের অনেকের জীবনে স্মৃতির অহংকার হয়ে আছে। আপনি কতো শত বিষয় নিয়ে কথা বললেন, নিজের কবিতা পড়লেন, অন্যদের লেখার পাঠ শুনলেন, আমাদের উঠানের আড্ডায় গভীর রাত পর্যন্ত গান শুনলেন। উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত প্রায় একশত জন কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের এই আড্ডায় আপনি হয়ে গেলেন মধ্যমণি — সকলের প্রাণের আসাদ ভাই।
যতটুকু আপনাকে দেখেছি, আপনার চলন-বলনে মনে হতো যেন দিল্লীর কবি মির্জা গালিবের উত্তরসূরী, আবার মনে হয়েছে, না, কবি আসাদ চৌধুরী এই বাংলার জীবনানন্দ দাশ এবং শামসুর রাহমানের সৃষ্টির পরম্পরা নিয়ে এসেছেন। আপনি হতে চেয়েছেন সকল ধর্মের সকল বর্ণের কবি, আপনি হয়েছেন মানুষের সাংস্কৃতিক দুরত্ব ঘুচিয়ে দিতে পারা একজন মানবিক কবি। আপনার জীবন দর্শন নিয়ে বহুদিন আমি ভেবেছি, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আপনার চিন্তা এবং চর্চা আপনার ধর্ম বিশ্বাসে জড়ায়নি! যতদূর জানি আপনার পূর্বপুরুষের আগমন পারস্য থেকে, আপনার ধর্মবিশ্বাসে সুফিবাদের এক নিমজ্জন দেখেছি, যা আমাদের দেশ থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তের পথে। আপনি সেই মানুষ, যিনি একজন আধুনিক বাঙালি এবং মুসলমান —কোথাও কোন বিরোধ নেই, আমাদের মননে আপনি এমন পরিচয়ে অনন্য ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, থাকবেন! বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং ধর্মের বিভাজনে আমাদের বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে যখন ধর্মীয় পরিচয় বড় হয়ে উঠতে চায়, তখন আপনি আমাদের এক নির্ভরতার নোঙ্গর। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং সৌন্দর্য আপনি আমৃত্যু লালন করেছেন, আমরা আপনার কাজ এবং স্মৃতিকে ভালোবাসার আলিঙ্গনে রাখবো আসাদ ভাই, আপনার রেখে যাওয়া সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখি, মৃত্যুতে আপনার কিছুই খোয়া যায়নি!
শেষে এ কথাও বলতে চাই, কবি আসাদ চৌধুরীর স্বাধীনতা পুরস্কার না পেয়ে চলে যাওয়া আমাদের জন্য সুখকর হয়নি। পুরস্কার বড় নয়, মেধা বড়, তাই পুরস্কারের পাশে বসে থাকা লোকগুলো যখন একজন সৃষ্টিশীল মেধাবী বাঙালির কাছে পৌঁছাতে পারে না, তখন আমাদের বড় পুরস্কার ছোট হয়ে যায়!