Published : 16 Dec 2015, 09:19 PM
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এখনো কি উল্লেখ করার মতো শিল্পমানোত্তীর্ণ মহাকাব্যিক সাহিত্য রচিত হয়েছে? প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ এলেই পত্রিকাগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। সেখানে গল্প-প্রবন্ধ-কবিতা থাকলেও তার শিল্পমান নিয়ে নবীন প্রবীণ লেখকরা প্রকাশ করেছেন তাদের সংশয় ও আশাবাদ। অলাত এহ্সানের গ্রন্থনায় প্রকাশ করা হলো তাদের সেই অভিমতসমূহ। বি.স.
………………………………………………
………………………………………………
আজকের দিনে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলেই ভাষা আন্দোলনকে সামনে আনা হয় তার প্রথম ধাপ হিসেবে। ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী আহমদ রফিক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে ইতিহাসের সেই বিবেচনাকে পুষ্ট করেছেন। কবিতা, প্রবন্ধ ও গবেষণার মাধ্যমে ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক জাতির এসব দিক নিয়েই আলোচনা করেছেন। তার কাছে, '৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ না বলে, একে 'স্বাধীনতা যুদ্ধ বলাই ভাল।'
এই স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে অনেক উপন্যাস ছোটগল্প লেখা হয়েছে, তবে কবিতাই সবচেয়ে বেশি। 'মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য' বলতে বাংলাদেশের সাহিত্যের একটা ট্রেন্ড দাঁড়িয়েছে, আহমদ রফিকের কবিতায় এই প্রসঙ্গ প্রবলভাবে এসেছে। তবে লিও তলস্তয়ের বিখ্যাত 'ওয়ার এন্ড পিস' উপন্যাসের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এপিকধর্মী বা মহাকাব্যিক ভাব প্রকাশে, সেই রকম কোয়ালিটি আছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেই ধরনের কালজয়ি উপন্যাস এখনো রচিত হয়নি।' মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি ও বাস্তবতা ধরা কঠিন না হলেও, 'মুক্তিযুদ্ধের নানামাত্রিক দিক নিয়ে বড় উপন্যাস লিখবেন, সেই ধরনের মেধাবি উপন্যাসিক বোধহয় নাই।' একাডেমিক বা সাহিত্যিক–উভয় দিক দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের গবেষণার দিকটাও কম।
'আমি তো ওই ব্যাপারে কিছু প্রবন্ধ ছাড়া কিছু লেখি নাই। কবিতা কিছু লেখা হলে হতে পারে।'-আত্মমূল্যায়নের ভাষায় বলেন আহমদ রফিক। 'কিন্তু প্রবন্ধ আমি যেগুলো লেখছি, তার অধিকাংশে স্বাধীনতা যুদ্ধের চরিত্র, তার শ্রেণিগত চরিত্র বা তার দক্ষতাগুলো যা সাধারণত লেখা হয় না তেমন কিছু কিছু লেখা লিখেছি আরকি।' তবে স্বাধীনতা বিষয়ে লেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
………………………………………………
………………………………………………
মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের প্রসঙ্গ এলে অনিবার্যভাবেই কথাসাহিত্যিক সৈয়দ সামসুল হকের নামটি সামনে চলে আছে। মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ না থাকলেও তার গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও গীতিনাট্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নানাভাবে, নান্দনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে এসেছে। '৭১-এ বিবিসিতে কর্মরত সৈয়দ হক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইংল্যান্ডে অবস্থান করায় মুক্তিসংগ্রাগে সরাসরি যুক্ত হতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বলতে তার উপন্যাস 'নিষিদ্ধ লোবান' ও গীতিনাট্য 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' এক্ষেত্রে প্রাতঃস্মরণীয়। সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ কতাটা এসেছে বা তা কতটা মানোত্তীর্ণ হয়েছে, এমন প্রসঙ্গ তুলতেই 'আমি বলবো না এই বিষয়ে।' বলে এড়িয়ে যান। জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের এবং সাহিত্যের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থাকলেও, অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি বলেন, 'না, আমি এই বিষয়ে কথা বলবো না। ' এমনকি তিনি তার সাহিত্য নিয়েও কথা বলতে নারাজ এই বর্ষিয়ান সাহিত্যিক। অন্যের সাহিত্য নিয়েও তার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে বলার কিছু নেই। বহুবার বলি, বহু জায়গায় বলি।'
………………………………………………
………………………………………………
দেশভাগ উত্তর সময়ে এদেশে কবিতার স্বকীয়তা তৈরিতে ষাটের দশকে কবিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ষাটের দশকের অন্যতম কবি রফিক আজাদ। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংগ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় সংকটে তার সাহিত্যিক ভূমিকা স্মরণীয়। স্বাধীনতার পর, সত্তরের দশকের প্রথমার্ধেই 'ভাত দে হারামজাদা' কবিতার মধ্যদিয়ে তিনি যে বাস্তবতাকে তুলে ধরেন তা কাব্যিক দক্ষতার পাশাপাশি তখনকার জাতির আবেগকে সাহকিকতার সঙ্গে ধারণ করার এক অনন্য নজির হয়ে আছে।
সাহিত্যে 'মুক্তিযুদ্ধ এসছে, আরো আসতে পারতো' বলেন কবি রফিক আজাদ। মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছরেও মানোত্তীর্ণ সাহিত্য রচিত না হওয়ার পেছনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বোঝাপড়া ও অভিজ্ঞতা থিতু না হওয়াকেই কারণ মনে করেন তিনি। 'মানুষের জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা অনেক সময় দ্রুত প্রকাশ পায় না। কাজেই হতাশ হওয়ার কিছু নাই।' কবিতা ও গল্পে মুক্তিযুদ্ধ যতটা এসেছে গবেষণা ও উপন্যাসে তত আসেনি। আমাদের দেশে উপন্যাসের অবস্থা তেমন ভাল নেই। 'তার চেয়ে বরং তরুণরা অপেক্ষাকৃত ভাল করছে। তাদের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি অভিজ্ঞতা না থাকলেও তারা পড়া-লেখা করবে, যত সাহিত্য রচিত হয়েছে তা পড়বে। তারা ভাল করবে। তাদের রচিত মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বেশ ভাল মানের হচ্ছে'–অভিমত এই বর্ষিয়ান কবির। বড় প্রেক্ষাপটে উপন্যাস রচিত না হওয়া শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক জাতির ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখার জন্য আরো সময় লাগবে বলে মনে করেন তিনি, 'এজন্য অধৈর্য্য হওয়ার কিচ্ছু নাই, হতাশ হওয়ারও কিচ্ছু নাই।'
………………………………………………
………………………………………………
'মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে সেই অর্থে তেমন কিছু হয়ইনি', মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য কতটা হয়েছে, প্রশ্নের জবাবে বলেন আমাদের অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। মুক্তিযুদ্ধ ও গণমানুষের সংগ্রামের রূপকার হিসেবে বাংলা সাহিত্যে হাসান আজিজুল হক প্রাতস্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে তার বিশেষ সংকলনও আছে। তার সাম্প্রতিক উপন্যাস 'বিধবাদের কথা' তো বটেই, প্রধান উপন্যাস 'আগুন পাখি'র কাহিনীতেও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে। দীর্ঘদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপনা করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে তার পরে সবচেয়ে জোড়েসোড়ে যার নাম উচ্চারিত তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
"যেমন মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে হলেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা'য় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ তেমনভাবে আসেনি। এটা যুদ্ধোত্তর সময়ে স্বপ্নভঙ্গের দিকটি সামনে এনেঙছে। তাছাড়া তার আগে যে বইটা 'চিলেকোঠার সেপাই', তাতে স্বাধীনতা-পূর্ব আন্দোলনগুলো আছে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কোনো ব্যাপার নেই। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প আছে–'মিলির হাতে স্টেইনগান', 'রেইন কোর্ট'–এমন কয়েকটা গল্প খিলেছেন তিনি। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমাদের মোটামুটি যে প্রধান লেখক আছেন, তারা তেমন কিছু লিখেননি।" সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবান' মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হলেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় তা বাঙ্গময় হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া যুদ্ধ শুরুর প্রাক-মুহূর্তে আনোয়ার পাশার রচিত 'রাইফেল-রোটি-আওরাত' উপন্যাসটি 'অসাধারণ কিছু নয়। তাছাড়া ও তো কেবল দেখলো। ওগুলো একধরেন স্কেচের মতো , ভাল ভাল স্কেচ হয়তো বা, তার বেশি কিছু না।' এছাড়া মাহমুদুল হকের 'জীবন আমার বোন', ছাড়া আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উপন্যাস রচিত হয়নি।
পশ্চিমা দেশের এরিক মারিয়া রেমার্কের উপন্যাসগুলোতে যেভাবে যুদ্ধ এসেছে আমাদের দেশে তেমন আসেনি। সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ না আসার 'কারণ এ ব্যাপার অভিজ্ঞতার লোক খুব কম যারা পুরো সময়টি এর মধ্যে ছিল।' যেমন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে লেখন 'এ ফেয়ার ওয়েল টু আর্মস', স্প্যানিস সিভিল ওয়ারের ওপর লিখলেন, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে তেমন নেই।
প্রসঙ্গক্রমে তলস্তয়ের কথা এলে, তিনি বলেন, 'আমি তো উল্লেখই করলাম না ওই নামটা। কারণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এপিক ধর্মীদের মধ্যে একটা হচ্ছে ওয়ার অ্যান্ড পিস।' আমরা শক্তিশালী সাহিত্য পেলেও তেমন এপিকধর্মী উপন্যাস পাইনি। এর জন্য কি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে? এ প্রসঙ্গে বলেন, 'এমনও তো হতে পারে, বিস্ফোরণেই শেষ হবে, মাঝে মাঝে আমার সেইটাই মনে হয়, বিস্মরণেই শেষ। অপেক্ষা করে কোনো লাভ হবে কি না জানি না। আমি তার কোনো লক্ষণ দেখছি না। কারণ মুক্তিযুদ্ধোত্তর যে বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছি তাতে তো মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ তো বৃথা করা হয়েছে! অন্ধকার তো। মুখের চলতি স্লোগান হচ্ছে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'। 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'টা কী? জিজ্ঞেস করলে কাউকে পাওয়া যায় না। চেতনাটা কী, কী চেতনা সঞ্চার করেছে। সেই অনুযায়ী রাষ্ট্র কী হওয়া উচিত? সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রটা কী হওয়া উচিত, এই রাষ্ট্র কি তা হয়েছে?'
১৬ ডিসেম্বর কিংবা ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ উপলক্ষে যেসব সাময়িকী প্রকাশ করে তাতে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণিকতা কিছুই থাকে না। এখনো যেভাবে হাত, মস্তিক, স্মৃতি ব্যবহার করতে পারছি, তাতে এম্বিশন পোষণ করি বটে একটা বড় উপন্যাস লিখবো, তাতে মুক্তিযুদ্ধ থাকবে।'
নতুনদের মধ্যে মামুন হুসাইন ও শাহাদুজ্জামান ভাষা, প্লট, বয়ন নিয়ে কারিগরি করেন বটে, তবুও বড় কোনো উপন্যাস লেখার স্পষ্টা রেখা কোথাও দেখেন না।
………………………………………………
………………………………………………
'আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা তো বটেই, আমার জেনারেশনেরই সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সব চেয়ে বড় ঘটনা।'–কথাসাহিত্যে ও গবেষণা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ কতটা এসেছে এমন কথা শুরুর প্রারম্ভে প্রবীণ রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক হায়দার আকবর খান রনো এসব বলেন। উনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ নেতার সারাজীবনের লেখালেখির অন্যতম বিষয় মুক্তিযুদ্ধ ও জনগণের রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ। তার 'শতাব্দী পেরিয়ে' শীর্ষক আত্মজীবনী '৫২-'৯০ বাংলাদেশের সংগ্রামের ইতিহাস ও রাজনীতি বুঝবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রণাঙ্গনের বর্ণনা এড়িয়ে মানুষের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া তুলে ধরার মধ্যদিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথাসাহিত্য-গান-নাটক-চলচ্চিত্র তৈরি হলেও, 'যথেষ্ট রচিত হয়েছে বলে আমি মনে করি না।' মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু গান রচিত হয়েছে। সাহিত্য-চলচ্চিত্র-গান যা-ই হোক তাকে যথাযথ সংরক্ষণ করা উচিত' বলে মনে করেন এই প্রাবন্ধিক। তবে প্রবন্ধের মধ্যনিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-দর্শন উঠে আসার সুযোগ থাকলেও, 'প্রবন্ধের নামে অনেক আত্মকথা লিখেছেন। সব না হলেও, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লেখার চেষ্টা হয়, এই হলো সমস্যা।' ফলে বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক হায়দার আনোয়ার খান জুনো'র লেখা 'একাত্তরের রণাঙ্গনে শিবপুর' বইয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'ওটাকে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ বই বলে মনে করি। কারণ সেখানে একটা ব্যতিক্রমধর্মী যুদ্ধের বর্ণনা আছে এবং সেখানে নিজেকে ফোকাস না করে ঘটনাটাকে এবং মানুষকে সামনে নিয়ে এসেছে।' মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চার সংকটময় দিকটিও হলো, মানুষের ইতিহাসকে সামনে নিয়ে আসা হয় কম। 'মুক্তিযুদ্ধে মানুষের ভূমিকাটা সামনে আনা উচিত সব চেয়ে বেশি। সেটা অতটা আসে নাই, যতটা আসা দরকার ছিল। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দলবাজি করা ও দলীয়করণ করার প্রবণতা তো আমাদের দেশে আছেই।' সাহিত্যে ও গবেষণায় মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণিকতা রক্ষা করে গণমানুষের হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সীমাবন্ধতাও লক্ষ্যণীয় বলে মনে করে তিনি।
………………………………………………
………………………………………………
ষাটের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের কবিতায় আবির্ভূতদের মধ্যে মুহম্মদ নূরুল হুদা অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে তার কাব্য-সিদ্ধি এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। 'জাতিসত্তার কবি' খ্যাত নূরুল হুদা'র কবিতায় দড়িয়া পাড়ের জনপদের কথার সঙ্গে বাংলা ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা বিধৃত হয়েছে ব্যাপকভাবে। 'ভাল-মন্দ আমি জানি না, তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খেলা হয়েছে ' বলেন তিনি। দেশভাগ-পূর্ব সময়েই, ১৯৪০ সালে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন 'বাঙালীর বাংলায়'। মুক্তিযুদ্ধের তিনটি পর্যায়–প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ পর্যায়, মুক্তিযুদ্ধ পর্যায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পরের পর্যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যানের নাম ভাষাযুদ্ধ। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা ষাটের দশক থেকে প্রবলভাবে হয়েছে।' এইভাবে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে লেখাকে মুক্তিযুদ্ধের পর্যায়ভূক্ত করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কবি হুমায়ূন করিব 'স্টেনগান', 'আমার ভাই' ইত্যাদি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য লিখেছেন।
'আমি তো বলবো, গত তিন-চার দশক ধরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্যা লেখা হয়েছে। কিন্তু প্ল্যান করে, নিরীক্ষা করে তেমন কোনো মহাকাব্যিক কিছু লিখা হয় নি।' উপন্যাসের অবস্থাও তেমনি। কিন্তু হাজার কবির যে কবিতা রচিত হয়েছে তা যদি একই সংকলনভুক্ত করা হয়, তা মহাকাব্য হয়ে যাবে, সেটা অবলীলায় বলা যায়। অনেক গল্পের খণ্ডকল্প নিয়ে একটা মহাকাব্যিক উপন্যাসও হতে পারে। তবে, 'প্রতিভাবান বালকের মতো' সাহিত্য চর্চা না করে, কবি-সাহিত্যিকরা যদি যথাযথ প্রস্তুতি, পরিশ্রম, অনুশীলন করেন, তেমন সাহিত্য তৈরি হওয়া সম্ভব বলে মনে করেন এই অগ্রজ কবি।
হাতে গোনা সাহিত্যিকের কথা বাদ দিলে, 'বাংলাদেশের সাহিত্যের মান যা, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্যের মানও অনেকটা তাই। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে সাহিত্য মান কমে গেছে বা বেড়ে গেছে একথা বোধ হয় ঠিক হবে না। তবে আমাদের সচেতন হওয়ার সময় আসেনি বলবো না, বরং বলবো এসে পার হয়ে যাচ্ছে।' তিনি জোর দেন 'বোধের সচেতন সম্প্রসারণের নাম কবিতা'। মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের ঈস্পিত মান অর্জনের জন্য বোধের সচেতন সম্প্রসারণই জরুরি মনে করেন তিনি।
সাড়ে চারদশকে কাঙ্ক্ষিত সাহিত্য রচিত না হওয়া, আমাদের অপেক্ষারই নামান্তর। 'অপেক্ষা করা ছাড়া ব্যর্থ মানুষের আর কী করার থাকতে পারে।' বাংলাদেশের মতো মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে, বিশ্বেই কম আছে। এক হাজার বছর পরেও এ নিয়ে লেখা যেতে পরে। প্রসঙ্গক্রমে তলস্তয়ের ভূমিকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "তলস্তয় 'ওয়ার এন্ড পিস' লিখেছেন। আমরা লিখতে পারিনি। বললে বলতে হবে, হাজার বছরেও তলস্তয় সহজে আসবেন না। তিনি যুদ্ধের ওপর লিখেছেন বলেই 'ওয়ার এন্ড পিস' হয়নি, তলস্তয় বলেই তা হয়েছে।' একইভাবে শেক্সপিয়ার আগে হ্যামলেটের ঘটনা নিয়ে অনেকে চেষ্টা করলেও, তা 'হ্যামলেট' হয়ে ওঠেনি; যখন শেক্সপিয়ার লিখেছেন তখনই এটা পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছে। এটা অতিলৌকিক না হলেও 'হঠাৎ-লৌকিক' বলে মনে করেন তিনি। তাই আমাদের তেমন লেখকের জন্যও অপেক্ষার কথা অস্বীকার করা যায় না।
………………………………………………
………………………………………………
তার লেখালেখির গুরুত্বপূর্ণ দিকটিই হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে যতটা কথা হয়েছে, তার সাহিত্যিক দিক নিয়ে কথা হয়েছে খুব কম। তবে প্রবীণ এই সংস্কৃতি সংগ্রামী মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য কম বা বেশি রচিত হয়েছে এই বিচেনায় না গেলেও মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য রচিত হয়েছে–এটা তিনি মনে করেন। 'মুক্তিযুদ্ধের সময়টা থেকেই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য রচনা শুরু হয়েছে।' তার আছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রচিত সাহিত্যের গুরুত্ব অধিক। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শওকত ওসমানের লেখা 'জাহান্নাম হইতে বিদায়' এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা রচিত 'রাইফেল-রোটি-আওরাত'-এর কথা উল্লেখ করে বলেন, 'তার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয়েছে সেগুলো, বর্তমানে সাহিত্য নিয়ে যারা পড়াশুনা-লেখালেখি করছেন তাদের কাছে লেখা সম্ভব।' জাতির সবচেয়ে বড় ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে পরিমাণ সাহিত্য তৈরি হতে পারতো বা সাহিত্যের যে মান বজায় থাকতে পারতো, তা হয়েছে কি না, সেই প্রসঙ্গে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধ তো এখনো প্রবাহমান। মুক্তিযুদ্ধকে এখনো নৈর্ব্যাক্তিকভাবে দেখার মতো অবস্থা তো আমাদের সৃষ্টি হয় নাই। কাজেই যেগুলো সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলো ইতিহাসের উপাদান হিসেবে থাকবে। এর ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে নৈর্ব্যাক্তিকভাবে সাহিত্য সৃষ্টি করবেন। তাই কোনো কিছুই উপেক্ষা করার আছে বলে আমি মনে করি না। এই মানের বিচার না করাই ভাল।' তার কাছে, মান বিচারের চাইতে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যের রক্ষণকে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন মনে করেন।
………………………………………………
………………………………………………
বাংলাদেশের সাহিত্য চর্চায় মুক্তিযুদ্ধ যতটা এসেছে, সময়ের পরিক্রমায় প্রাকৃতিকভাবেই এসেছে বলে মনে করেন অগ্রজ কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যদি আশা করা হয়–/এখনই কালোত্তীর্ণ সাহিত্য হয়ে যাবে, এমনটা তিনি আশা করেন না। বরং 'সময়ের পরাম্পরার মধ্যদিয়ে আস্তে আস্তে রচিত হবে। এবং আমাদের দেশে এটা থেমে নেই।' বাংলা গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ-আত্মকথন কিংবা ডাইরি-নাটক-চিত্রকলা-ভাস্কর্য, সবখানেই মুক্তিযুদ্ধ একটা বিশেষধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের সাহিত্যে 'মুক্তিযুদ্ধ' একটি বিশেষ অধ্যায় হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে এটা আমাদের জন্য গৌরবের বলে তিনি উল্লেখ করেন। সাহিত্য তো বটেই, এমনকি আজকের দিনের জাতীয় রাজনীতিও মুক্তিযুদ্ধ দ্বারা মেরুকরণ হয়েছে। অর্থাৎ 'যেসব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার পক্ষে তারা জনগণের কাছাকাছি পৌঁছুতে পেরেছেন, অন্যরা কিন্তু নেই।' ক্রমে তাদেরও বোধোদয় হচ্ছে।
জোড় করে নয় বরং, প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক নিয়মে সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মহৎ বা বৃহৎ সাহিত্য রচিত অনেক পরেই হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এবং তা এখনো হচ্ছে। গত বছর এবং এ বছর যথাক্রমে প্যাত্রিক মাদিয়ানো ও এ্যালেক্সেভিস সোয়েতলানার সাহিত্যে নোবেল জয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই। যা অর্ধশত বছরেরও বেশি সময়ের আগের ঘটনা। তাই সাহিত্যে যতটুকু মুক্তিযুদ্ধ এসেছে, 'আমি ডিস হার্টেট না, আমি মনে করি এটা আস্তে আস্তে আরো বিকশিত এবং সমৃদ্ধ হবে' বলে মনে করেন তিনি। তবে এতো দিনেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এপিকধর্মী কোনো সাহিত্য রচিত না হলেও ভবিষ্যতে লেখার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই তার মত। এখন পর্যন্ত সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ অনেক বেশি আবেগ আর কাহিনীতে বন্দি থাকার কারণ হলো, 'পেইন্টিংয়ে রিয়ালিস্টিক ছবির মধ্যদিয়ে আমাদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গ বেশি আসে এই জন্য যে, এটা খুব সহজেই দর্শকের সাথে, তাদের অনুভূতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারে।' সাহিত্যেও তেমনি আবেগ-অনুভূতির মধ্য দিয়ে পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। তবে এখন পর্যন্ত নিরীক্ষাধর্মী লেখা বাকিই রয়ে গেছে।
………………………………………………
………………………………………………
কবিতা-গল্পের পাশাপাশি মঞ্চ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে কাজ হয়েছে। তাছাড়া কথাসাহিত্যের পর থিয়েটার-কর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সাহসী ভূমিকাও সুবিদিত। তাছাড়া নাট্যকলায় এদেশে কয়েকজন শক্তিশালী ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে। অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্দেশক মামুনুর রশিদের নাটকে মুক্তিযুদ্ধের নান্দনিক ও চিন্তাশীল উপস্থিতি বলিষ্ঠ। তবে এও সত্য কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ যতবেশি এসেছি, নাটকে ততটা আসেনি। এই প্রেক্ষাপটে, তা কি আসা উচিত ছিল না? 'না'–স্পষ্ট উত্তর তার। 'অলরেডি একটা ক্ষতি হয়েছে' তিনি বলেন। এটা হচ্ছে, বাংলাদেশ টেলিভিশনের পৃষ্টপোষকতায় একসময় মুক্তিযুদ্ধের নাটক সম্প্রচার হতো। সে সময় প্রচারিত সব নাটকের কাহিনীই প্রায় এক–একজন যুবক মুক্তিযুদ্ধে গেছে, এদিকে বাড়িতে তার প্রেয়সী পাকিস্তানি আর্মি দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে। যুবক তখন এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে গুলি ছুড়ছে, অথবা হতাশ হয়েছে। 'এই ফর্মূলা চলেছে অনেক বছর। এবং বাহাত্তর সালে ঢাকার বাইরে কত নাট্যকার যে জন্ম হয়েছিল, খালি মুক্তিযুদ্ধে দেখছে, তাই লিখেছে। এগুলো কোনোটাই শিল্পোত্তীর্ণ নয়।' মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিশাল ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা থাকলেও শিল্পসম্মত ও মানোত্তীর্ণ নাটক তৈরির জন্য পরের প্রজন্মকেই তিনি বেশি সম্ভাবনাময় ও উপযোগী মনে করেন।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে 'কিছু কিছু উপন্যাস তো ভাল হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশই তো ক্লিশে। তবে চিত্রকলায় যেটা এসেছে সেটা খুব ভাল।' 'জয়জয়ন্তী'র মতো গুরুত্বপূর্ণ নাটক লেখার পরও মামুুনুর রশিদ এখনো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিল্পসম্মত, নিরীক্ষাধর্মী ও কালোত্তীর্ণ নাটকের জন্য মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের উপরই বিশেষ জোরারোপ করেন।
………………………………………………
………………………………………………
কথাসাহিত্যে সুশান্ত মজুমদার বর্তমান উপস্থিতি কম থাকলেও সাহিত্যে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার সাহিত্যচর্চার গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়েই আছে মুক্তিযুদ্ধকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দেখা। বলা যায়, এই ধারার লেখায় তার সমৃদ্ধি ও সামর্থ তাকে আলাদা করে দিয়েছে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর দেশে কথাসাহিত্যে নিজে সাফল্য দেখিয়েছেন, এমন সাহিত্যিকের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য। 'স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, ত্যাগের মাধ্যমে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, তার শিল্প-সফল পরিণতি সাহিত্যে ঠিক মতো আসেনি। দেখা যাচ্ছে যে, আমরা অনেকে ইচ্ছা পূরণের কাহিনী তৈরি করছি। আমরা যুদ্ধকে ঠিক মতো না বুঝে আমাদের ইচ্ছাকে লিখেছি, এমনও হয়েছে। কতগুলো চরিত্র করেছি যা আমাদের তৈরি করা পুতুল। আবার এমনও হয়েছে যে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিল্প-সফল লেখা হয়েছে। ভাল গল্পও রচিত হয়েছে যা যথেষ্ট উন্নতমানের, আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু আরো হওয়া উচিত। আমি আশা করি ভবিষ্যতে নিরাবেগভাবে বোঝাপড়া করে, খুব উপলব্ধি করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিল্পসম্মত সাহিত্য রচনা করতে পারবে, এই আশা আমার আছে।' বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ দিক হলো, সে সময় মুক্তিযুদ্ধে অংগ্রহণকারী, কিংবা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনকারী বেশ কয়েকজন পরবর্তীতে সাহিত্যেরও ঈস্পিত মান অর্জন করেছেন। তাদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্যিক উপাখ্যান তৈরি হতে পারতো, এমন আশা করা হয়। 'তাৎক্ষণিকভাবেও ভাল সাহিত্য রচিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে একে মোকাবেলার ক্ষমতা বেশির ভাগ লেখকদের ছিল না। আবার অপেক্ষা করে করেও, দেখা গেছে ক্লান্ত হয়ে গেছি আমরা; কিন্তু ভাল সাহিত্য পাইনি, এমন ঘটনাও আছে। তবে অনেক অপেক্ষাই আমাদের অসহ্য ও দীর্ঘস্থায়ী মনে হয় যে, আমাদের আর কত অপেক্ষা করতে হবে?' তিনি অনুভব করেন, কবিতা ও গল্পে মুক্তিযুদ্ধ যথেষ্ট আসলেও গবেষণা কর্ম, প্রবন্ধ, উপন্যাসে তেমন আসে নি। যদি গবেষণা যথাযথ হয় তাহলে ভবিষ্যতে মানোত্তীর্ণ সাহিত্য আমরা পাব, বলে মনে করেন এই কথাসাহিত্যিক।
………………………………………………
………………………………………………
লেখালেখির ক্ষেত্রে কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশিদের প্রধান অঞ্চল বোধ হয় মুক্তিযুদ্ধ। 'মুক্তিযুদ্ধের মুজিবনগর' শীর্ষক গবেষণার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা যে সব বাংলাদেশি সাহিত্য চর্চা করছেন তাদের সাহিত্যে অনিবার্যভাবেই মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এলেও, উপন্যাসটা এইদিক দিয়ে অপেক্ষাকৃত দূর্বল বলে তার মত। 'মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তির কোনো উপন্যাস লেখা হয়নি বলে' তার মনে হয়। 'এখানে আবেগটাই মুখ্য হয়ে কাজ করে, ফলে শিল্পমানের বিচারটি এখানে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের চার দশ পেরিয়েছে, এখন সময় এসেছে শুধু আবেগ দিয়ে নয়, দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখবার। সেইটা খুব গুরুত্ব দিয়ে হচ্ছে বলে মন হয় না।'
প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ'কে কেন্দ্র করে পত্রিকার বিশেষ সাময়িকী প্রকাশনা ধরে মুক্তিযুদ্ধের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ সাহিত্য রচিত হলেও আখেরে তা কতটুকু শিল্পসম্মত তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যায়। সেখানে 'যুক্তিসিদ্ধ যে বিবেচনা, সেইটাই হচ্ছে না।' প্রবন্ধ সাহিত্যেও মুক্তিযুদ্ধের গভীর দর্শন ও স্বরূপ আজও উন্মোচিত হয় নি। "সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ওপারের লেখক, আমাদের না, তিনি তার 'পূর্ব-পশ্চিম' উপন্যাসে যেটুকুবা এনেছেন, সেটুকুও আমাদের এখানে আসেনি। আমাদের হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন 'দেয়াল', সেটা মুক্তিযুদ্ধে উপন্যাস হলো, কিন্তু সেটাও পরিপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন বলে মনে হয় না। তার 'জ্যোৎস্না ও জনীর গল্প'টাও আমি একইভাবে বিবেচনা করি। এখানে মুুক্তিযুদ্ধের আবেগ যতটা থেকেছে, সাহিত্যমূল্য ততটা থাকে নি।" একইভাবে সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবান', শওকত ওসমানের 'জাহান্নাম হইতে বিদায়', সেলিনা হোসেনের 'যুদ্ধ', কিংবা আত্মসমালোচনার জায়গা থেকে নিজের 'দাঁড়াবার জায়গা' উপন্যাসকেও পুরো মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন বলে মনে করেন না রফিকুর রশিদ।
………………………………………………
………………………………………………
'আমি তো সব মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য পড়ি নাই' সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ কতটা এসেছে, সে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস 'তালাশ'র লেখিকা শাহীন আখতার বলেন। 'তবে এমনি অনেকেই বলে দেখি, আমি নিজেও দেখেছি, –এখনকার প্রজন্মের কথা বলতে পারবো না– তবে আমার তো মনে হয় না কেউ বাকি আছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু লিখেন নাই।' সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে এসেছে এই নিয়ে তার ভেতর সংশয় থাকলেও সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ যথেষ্ট এসেছে বলে তিনি মনে করেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের পঁয়তাল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় ধরনের সাহিত্য তৈরি হওয়ার জন্য কম নয়। 'ওই রকম যদি নিজের ভেতর থাকে, চেতনা যদি সার্ভাইভ করে, তাহলে একশ' বছর পরেও লেখা হতে পারে।… যার কারণে মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি এমন কাউকে দিয়েও তা তৈরি হতে পারে। আমার মনে হয়, দূরত্ব তৈরি হলেই মনে হয় বেশি ভাল ওই ধরনের মহৎ সাহিত্য তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে।' সমসাময়িক বিষয়ে লিখতে গেলে বাস্তবতা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে বিধায়, 'মুক্তিযুদ্ধকে মহৎ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রিয়্যালিটির সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়ার যে ব্যাপার আছে, ওইটা তো মনে হয় না এখনো আমার তৈরি হয়েছে। তাই না? আমরা তো একপ্রকার এখনো মুক্তিযুদ্ধের ভেতরেই আছি।'
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সবাই কমবেশি লিখলেও তার সাহিত্য মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলাই যায়। শাহীন আখতারের নিজের লেখায় এবং তার পঠিত সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভাল কিছু লেখা আছে তা সহজেই বলা যাবে। তবে তার 'তালাশ' উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি ও প্রামাণিকতার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধের ননফিকশন, দলিলপত্র, বিভিন্ন ডকুমেন্টের সহযোগিতার নিয়েছেন। 'এই ডকুমেন্টগুলো যথাযথ সংরক্ষিত থাকলে, ভবিষ্যতে ভাল লেখার জন্য সহায়ক হবে। …সেজন্য সময় কোনো ব্যাপার না। ' তবে কথাসাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের উপস্থিতি সহজ উদাহরণ হলেও, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রবন্ধ ও গভীর গবেষণাধর্মী কম হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এটার নেগেটিভ-পজেটিভ উভয় দিক থাকলেও, 'হ্যাঁ, আমার মনে হয়, আমাদের মধ্যে, জাতি হিসেবে, আমাদের মধ্যে তথা বাঙালীদের মধ্যে, …আমরা মনে হয় ওই রকম ইনফরমেটিভ দিক নিয়ে নাড়াচাড়া করার চেয়ে গল্পগাথাই বেশি পছন্দ করে।' এর পজেটিভ দিক হিসেবে শৈল্পিক দিক থাকলেও এর ফলে আমাদের অনেক জরুরি জিনিস হারিয়ে যায়, যা সংরক্ষণ করা জরুরি।
………………………………………………
………………………………………………
রাজনৈতিক ধারার সাহিত্যে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপৃত কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম। ছাত্র জীবনে প্রগতিশীল রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও সাহিত্যের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখিই তার সাহিত্যচর্চার প্রধান দিক, বলা যায়। "আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্নভাবেই এসেছে। এতে কোনো সন্দেহ নাই। শুরু থেকেই, এমন কি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে 'বাংলাদেশ কথাকয়' শিরোনামে একটা গল্পসংকলন কলকাতা থেকেই প্রকাশ হয়েছিল।" অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য রচনা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে।
'কিন্তু যে অর্থে আমার বলি, একটা কালোত্তীর্ণ চেতার প্রকাশ ঘটাবে, সেই অর্থে বলতে গেলে মনে হয় না এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সাহিত্য আমরা পেয়েছি। সেটার জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন আছে' বলে মনে করেন এই কথাসাহিত্যিক। কোনো একটি সময়ে বিশেষ কোনো ঘটনা করে তাৎক্ষণিকই কোনো কালোত্তীর্ণ সাহিত্য রচিত না হলেও, সশস্ত্র যুদ্ধের ৪৫ বছর অতিক্রমকে 'এক অর্থে যথেষ্ট বলা যায়, আবার কখনো তা হয়তো আরো সময় দাবি করে।'
যুদ্ধ নিয়ে তলস্তয়ের 'ওয়ার এন্ড পিস' অনেক পরে রচিত হলেও রুশ বিপ্লব নিয়ে নিকোলাই অস্ত্রভস্কি'র 'ইস্পাত' তাৎক্ষণিকভাবে রচিত। সন্দেহাতীতভাবে তার একধরনের আবেদন থাকলেও তা যতটা তারুণ্যকে উজ্জীবিতার্থে উল্লেখযোগ্য কিন্তু মহাকাব্যিক অর্থে নয়। আমাদের তেমন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন লেখা গুরুত্বপূর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস কোনোটাকেই বলা যায় না। এই তালিকায় আনোয়ার পাশা'র 'রাইফেল-রোটি-আওরাত', মাহমুদুল হকের 'জীবন আমার বোন', আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প 'রেইনকোর্ট' বা 'মিলির হাতে স্টেনগান', হাসান আজিজুল হকের গল্পগ্রন্থ 'নামহীন গোত্রহীন' ইত্যাদির নাম প্রথমেই আসে। 'এ অর্থে ১৯৭৫ পরবর্তী দেশে যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, তারপরে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সাহিত্যে যে নতুন একটা জাগরণ, বলতে গেলে সৈয়দ শামসুল হকের লেখা থেকেই শুরু হয়। ' সৈয়দ হকের কাব্যনাট্য 'পায়ে আওয়াজ পাওয়া যায়', উপন্যাস 'নিষিদ্ধ লোবান', কিংবা আশির দশকের প্রথম দিকে সাপ্তাহিক বিচিত্রা'য় প্রকাশিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'স্মৃতিমেদ' সেসময় আলোড়ন তৈরি করে। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প থাকলেও উপন্যাসে তাকে সেই উচ্চতায় ভাবা যায় না বলেই তার মত।
তবে 'একটা সংকট আসলে ছিল, সরাসরি যারা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য রচনায় ততটা অংশগ্রহণ করেন নাই' বলেই মনে করেন ইমতিয়ার শামীম। 'মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আলাদা যে অভিজ্ঞতা, বলতে গেলে আমাদের সাহিত্যিকদের তা নেই।' সেই অভিজ্ঞতা থাকার পরও তারা কতটা মানসম্মত সাহিত্য লিখতে পারতেন, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও, অভিজ্ঞতাটা থাকা গুরুত্বপূর্ণ। 'মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য নিয়ে আমাদের প্রত্যাশার যে জায়গা তা বিশ্বসাহিত্যের মানদণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গেলে সেই ধরনের মানোত্তীর্ণ সাহিত্য, বিশেষত উপন্যাস এখনো রচিত হয় নি।'