সারা জীবন সেই জয়েরই ধারাবাহিকতা তাঁকে ক্রমাগত খ্যাতিমান ও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননার দিকে নিয়ে গেছে। তাঁর প্রয়াণের মাধ্যমে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে অবসান হলো সামুরাই যুগের।
Published : 14 Apr 2025, 11:54 PM
যে-সাহিত্যিক আন্দোলন বিশ শতকের লাতিন আমেরিকান সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তুলেছিল, সেই বুম আন্দোলনের বিলম্বিত এবং শেষ প্রতিনিধি ছিলেন পেরুর মারিও বার্গাস যোসা। গতকাল তিনি প্রয়াত হলেন। তাঁর প্রয়াণের সংবাদ আমি পেয়েছি একদিন পরে; কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও গবেষক শ্রদ্ধেয় আন্দালিব রাশদী ভাইয়ের মারফত আজকে দুপুরে। আমাকেই জানাবার কারণ, তিনি জানতেন আমি মারিও নিয়ে এক কালে মত্ত সময় কাটিয়েছি। রাশদী ভাইও লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের কেবল অনুরাগীই নন, অনুবাদকও। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ মারিও বার্গাস ইয়োসা নামে তাঁর একটি অনুবাদগ্রন্থও আছে। অতএব, মারিও বিষয়ে তিনি ও আমি এক অভিন্ন বলয়ের বাসিন্দা। সেই কারণেই বোধহয় তিনি দুঃসংবাদটি জানা মাত্র আমাকে অবহিত করেছেন।
সত্যি বলতে কি, মারিও সম্পর্কে আমি অনেকদিন যাবৎ কোনো খোঁজখবর রাখছিলাম না। তিনি বেঁচে আছেন—এইটুকুই কেবল জানতাম। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি পৃথিবীর বন্ধন ধীরে ধীরে ছিন্ন করছেন, তা অনুমান করা গেলেও আমরা কখনোই এই বেদনাদায়ক সংবাদের জন্য প্রস্তুত থাকি না। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর মতো আমরা বলতে পারবো না: “ভগবানের গুপ্তচর/ মৃত্যু এসে বাঁধুক ঘর”। মৃত্যু যে তার শরীরে ইতিমধ্যেই ঘর বেঁধেছে, তা জানতাম, কিন্তু মানতাম না। রাশদী ভাই, যখন এই দুঃসংবাদটা জানালেন, তখন কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে কোনো কিছুই ভাবতে পারিনি। মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায়, বিশেষ করে প্রিয়জনদের মৃত্যুর সংবাদে স্তব্ধ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। মারিওকে ‘প্রিয়জন’-ভুক্ত করায় অনেকেই ঔদ্ধত্য বা অনধিকার বলে মনে করতে পারেন। কারণ তিনি এমনই এক উচ্চতার অধিবাসী ছিলেন যে আমার মতো বামনের পক্ষে তাঁকে স্পর্শ করার কোনোই সুযোগ নেই। কিন্তু পাঠের অধিকারও অন্য এক স্পর্শের সুযোগ করে দিতে পারে, সেই স্পর্শ হোক না বিমূর্ত, অনঙ্গ কিংবা বিদেহী, কিন্তু তাও কোনভাবেই গৌণ নয়। "All men who repeat a line from Shakespeare are William Shakespeare"—মারিও’র গুরু হোর্হে লুইস বোর্হেস এমনই এক অধিকারের উচ্চতায় তুলে দিয়েছিলেন পাঠককে। এতএব, এই সূত্রে মারিওকে প্রিয়জন ভাবতে তো কোনো দোষ নেই। মারিও বার্গাস যোসা আমার প্রিয়জন কেবল পাঠের সূত্রেই নয়, তার লেখা অনুবাদ ও তার সম্পর্কে লেখার সূত্রেও।
১৯৮৭ সালে Wilson Quartarly পত্রিকার একটি সংখ্যায় মারিও বার্গাস যোসার Book, Gazette and Fredoom নামক একটি প্রবন্ধ (মনে হয় ওটা একটা বক্তৃতাই ছিল) পড়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। অবশ্য আরও আগে থেকেই তাঁর সম্পর্কে শুনতে পাচ্ছিলাম অগ্রজ কোনো কোনো লেখকের মুখে। আমার সমসাময়িকদের মধ্যে মারিও’র ভক্ত ছিলেন বন্ধু ও কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন। অগ্রজতুল্য অনুবাদক আলী আহমেদও তখন মারিও পড়ছেন। মার্কেস ও মারিও প্রায় অভিন্ন যোজনায় আমাদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছিল। মার্কেস-এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা তখনও আমরা সেভাবে জানি না। পরে জেনেছি সমসাময়িক হয়েও এই মার্কেস তার কেবল বন্ধুই ছিলেন না, মার্কেসকে নিয়ে লিখেছেন Garcia Marquez: Historia de un Deicidio নামে সাড়ে ৬ শ পৃষ্ঠার এক গবেষণা গ্রন্থ। আবার এই প্রিয় মানুষটিকেই এক ঘুষিতে চেহারা বদলেও দিয়েছিলেন। দুজনই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে খুবই সরব, কিন্তু প্রথম দিকে একই রাজনৈতিক আদর্শের হলেও, পরে দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে বেঁকে। সেই বাঁকা পথ আর কোনদিনই এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়নি। মারিও কেন মার্কেসকে ঘুষি মেরেছিলেন তা দুজনের কেউ-ই জীবদ্দশায় জানিয়ে জাননি। যদিও মারিও বলেছিলেন, তিনি এর কারণ স্মৃতিকথায় লিখবেন। আদৌ লিখে গেছেন কিনা জানি না। তাঁর সমগ্র রচনা যখন বেরুবে তখন হয়তো জানা যাবে।
ষাটের দশকটা গোটা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের জন্য এক পয়মন্ত সময়। একদিকে মেহিকো থেকে উঠে আসছেন কার্লোস ফুয়েন্তেস, অন্যদিকে আর্হেন্তিনায় উত্থান ঘটছে হুলিও কোর্তাসারের মতো ‘উপন্যাসের বলিভার’-এর, কলম্বিয়ায় ‘এ যুগের সের্বান্তেস’ গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, চিলের হোসে দোনোসো, উরুগুয়ের হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির। আমার সৌভাগ্য যে সাহিত্যের মানচিত্র বদলে দেয়া এই লেখকদের লেখার প্রতি যৌবনের শুরুতেই আকৃষ্ট হয়েছিলাম। এমনকি, এদেরই একজন, কার্লোস ফুয়েন্তেসকে চাক্ষুষ ও কথা বলার সৌভাগ্যও অর্জন করেছিলাম। মারিও বার্গাস যোসার সাথে দেখা হয়নি বটে, তবে তাঁকে নিয়ে আমার অনূদিত মারিও বার্গাস যোসার জীবন ও মিথ্যার সত্য ( ২০১৫) নামক বইটি তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই। আর সেই সূত্রে তার পক্ষ থেকে তাঁর সাহিত্যসচিবের একটি চিঠি পেয়েছিলাম আমার চিঠির জবাবে।
এই নিবন্ধের লেখক কর্তৃক অনূদিত ও সংকলিত ‘বার্গাস যোসার জীবন ও মিথ্যার সত্য’ গ্রন্থ হাতে মারিও বার্গাস যোসা
কিন্তু মারিওকে নিয়ে ওটাই আমার একমাত্র বই নয়, তাঁর সাথে হোর্হে লুইস বোর্হেসের সম্পর্ক নিয়ে আমার প্রবন্ধ এবং তাঁর কয়েকটি সাক্ষাৎকারের অনুবাদ নিয়ে ২০২৩ প্রকাশিত বোর্হেস ও মারিও: আলাপে পরস্পর বইটিও উল্লেখ করা উচিত। মারিওর প্রতি আমি যখন প্রথম আকৃষ্ট হয়েছিলাম তখন কল্পনাও করিনি যে এক সময় তাঁকে নিয়ে আমি লিখবো বা তাঁর লেখা অনুবাদ করবো। কিন্তু লেখার নিয়তি আমাকে ধীরে ধীরে ওই দিকে নিয়ে গেছে। কেন নিয়ে গেছে? এর জবাব নিশ্চিতভাবেই তাঁর সাহিত্যকর্ম। হোসে দোনোসো ও ওনেত্তি ছাড়া বাকি তিনজন লেখকই আমার বিবেচনায় এমনই উচ্চতার লেখক যারা বিশ্বসাহিত্যের ধারাকে, বিশেষ করে ইউরোপিয় ধারাকেই চ্যালেঞ্জ যেমন করেছেন, তেমনি নিপুণ দক্ষতায় তাঁদের সৃষ্টিশীল রচনার মাধ্যমে মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, পতন ও সম্ভাবনা, স্বদেশ ও বিশ্বকে এমনভাবে, এতটাই বিশ্বস্তায় রূপায়ন করেছেন যে তা দেশের গন্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক মর্যাদা অর্জন করেছে। মার্কেস বিপুল পরিমান সৃষ্টিশীল রচনার প্রণেতা হলেও, মননশীল রচনা, আমরা যাকে প্রবন্ধের গোত্রভুক্ত বলে অভিহিত করি, সেরকম রচনা খুব একটা নেই। এই দিক থেকে ফুয়েন্তেস ও মারিও পুরোপুরি ব্যতিক্রম। রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য, চিত্রকর্ম ও লেখাধুলাসহ নানান বিষয়ে তিনি লিখেছেন। El Paraíso en la otra esquina নামে লিখেছেন ফ্লোরা ত্রিস্তান ও তাঁর নাতি পল গগাঁকে নিয়ে এক অসামান্য উপন্যাস। দোমিনিকান রিপাবলিকের প্রেক্ষাপটে এবং স্বৈরাচারী রাফায়েল ত্রুহিয়্যোকে প্রধান চরিত্র করে লিখেছেন La fiesta del chivo নামক দারুণ উপভোগ্য এক উপন্যাস। তাঁর বেশির ভাগ উপন্যাসেরই প্রেক্ষাপট পেরু, কিন্তু মাঝেমধ্যেই তিনি দেশের গণ্ডি পার হয়ে চলে গেছেন অন্যত্র। এরকম আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে La guerra del fin del mundo যার প্রেক্ষাপট ব্রাজিল। সারা জীবনে তিনি ২১টি উপন্যাস লিখেছেন।
এই নিবন্ধের লেখক কর্তৃক অনূদিত মারিও বার্গাস যোসাকে নিয়ে দ্বিতীয় গ্রন্থ
উপন্যাসের বিষয়ের ক্ষেত্রে এইসব বৈচিত্রের পাশাপাশি প্রাবন্ধিক হিসেবেও তাঁর বৈচিত্র ও বিস্তার চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মতো। রুবেন দারিওকে নিয়ে স্বতন্ত্র বই দিয়ে শুরু, এরপর একে একে ফ্লবেয়ার, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, হোসে মারিয়া অর্গেদাস, হুয়ান কার্লোস ওনেত্তি, হোর্হে লুইস বোর্হেস—এদের প্রত্যেককে নিয়ে রয়েছে তাঁর স্বতন্ত্র গ্রন্থ। সারা পৃথিবীর কত অসংখ্য লেখক ও তাদের বই নিয়ে যে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন তার কোনো হিসেব নেই! কোনো কোনো প্রবন্ধের বিষয় বাংলাদেশের সামাজিক পরিস্থিতি। তাঁর কোনো এক উপন্যাসে আমরা হাজির হতে দেখবো রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি। আবার এসবের পাশাপাশি লিখেছেন গুরুভার আরও কিছু প্রবন্ধের বই যেগুলোর কোন কোনটার বিষয় গোটা সভ্যতার ব্যাধি। নাটকও বাদ যায়নি, এ পর্যন্ত মোট নয়টি নাটক তিনি লিখেছেন।
৮৯ বছরের দীর্ঘ জীবনে এই পরিমাণ রচনা হযতো বেশি নয়, কিন্তু এইসব রচনার শিল্পমূল্য ও বিষয়ের বৈচিত্রের কথা বিবেচনা করলে পরিমাণে তা কমও নয়। মারিও ছিলেন বহুপ্রজ। বেঁচেছেনও দীর্ঘকাল। কিন্তু বেঁচেছিলেন নায়কোচিতভাবে। কারণ মাত্র ২৫ বছর বয়সেই তিনি প্রথম উপন্যাস প্রকাশ করে গোটা লাতিন আমেরিকায় সাড়া তো ফেলেছিলেনই, এমনকি, প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা স্পেনের প্রকাশনা সংস্থা সেই বাররাল থেকে প্রবর্তিত বিবলিওতেকা ব্রেবে পুরস্কার অর্জন করেন।
মারিও এসেই জয় করেছিলেন। এবং সারা জীবন সেই জয়েরই ধারাবাহিকতা তাঁকে ক্রমাগত খ্যাতিমান ও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননার দিকে নিয়ে গেছে। তাঁর প্রয়াণের মাধ্যমে লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে অবসান হলো সামুরাই যুগের। তিনি ছিলেন শেষ সামুরাই।