টাকার প্রান্তে হাতছানি দেয় সরল অঙ্ক-মিনার /চারদিকে তার কাঁটাতারের সীমা
Published : 21 Jul 2020, 12:19 AM
আশির দশকের সবচেয়ে অনালোচিত, অনালোকিত, কিন্তু আমার বিবেচনায় অসামান্য কাব্যশক্তির অধিকারী যিনি বাংলা কবিতায় প্রথমবারের মতো মুদ্রার স্বভাব আর অর্থের মৌল প্রবণতাকে চিহ্নিত করলেন অসামান্য দক্ষতায়। পেশাগত অমাময়ী উপাদানকে তিনি সেই আশির দশকে যে অকপট স্পর্শে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় সপ্তবর্ণে প্রস্ফূটিত করেছিলেন তার করুণ ও পর্যুদস্ত অর্থনৈতিক বাস্তবতা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল দীর্ঘ দিন। কি অসামান্য দূরদৃষ্টি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের অনাগত ভবিষ্যতকে দেখতে পেরেছিলেন সেই সময়ে– তা ভাবলে অবাক হতে হয়। কিন্তু পেশার আনুকূল্যজাত এই সুবিধায় মজে থাকার মতো কবি তিনি নন বলেই বিষয়ান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিলেন তার সহজাত কাব্যিক শক্তি ও গুণের কারণে। ফলে তিনি বহু রকমের কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি বহু রকম প্রকরণে তিনি সাঁতার কেটেছেন– কার্লোস ফুয়েন্তেস যেমনটা বলেছিলেন মেক্সিকোর বিপ্লবী উপন্যাসের জনক মারিয়ানো আসুয়েলা সম্পর্কে। বুলান্দ, হ্যাঁ, বুলান্দ জাভীরের কথাই বলছি। তিনি নিশ্চুপ, প্রচারবিমুখ আর তারচেয়েও বেশি উল্লেখ্য, নিজের ব্যাপারে অবাঙালিসুলখ উচ্চাকাঙ্ক্ষাবর্জিত এমনই এক কবি যিনি ওসবের তোয়াক্কা করেন না। অথচ, খুবই অল্পসময়ের মধ্যে তিনি পশ্চিমের সমকালীন প্রকরণ ও প্রবণতাগুলোকে নিবিষ্ট সতর্কতা ও মনোযোগে আত্মীকরণ করে নিয়েছিলেন নিজের ছাঁচে ও মৌলিক স্বভাবের অনুকূলে। বুলান্দ আমাদের কবিতার মধ্যে এমন কিছু মৌলিক প্রবণতাকে অন্তর্ভুক্ত করলেন যার নজির খুঁজে পাওযা যাবে না আমাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। ছন্দ ও আলিংকারিক দক্ষতায় বুলান্দ যেমন কুশলী, তেমনি একটি যুগের বৈশিষ্ট ও ভাষাকেও তিনি দক্ষতার সাথে যেভাবে নিজের কবিতায় প্রমিত রূপে হাজির করেছেন তা অতুলনীয়। বুলান্দ, আমাদের কবিতায় সত্যিকার অর্থেই এক বুলান্দ দরোয়াজা। আসুন, প্রবেশ করি এই বুলান্দ দরোয়াজা দিয়ে কবিতার সেই অদৃশ্য ভুখণ্ডে যা আপনার পাঠের অপেক্ষায় দৃশ্যমান হওয়ার জন্য ব্যাকু্ল। –রাজু আলাউদ্দিন
প্রতিদ্বন্দী
তুমি ভালোবাসো নাগরিক ভোর জুঁই।
আর ভালোবাসো আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠা ঘরবাড়ি
অস্তবেলায় গেরুয়া মাটির পথ ধরে হেঁটে যাওয়া
অত জোর নেই মনে
তুমি ভালোবাসো যাকে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি।
তুমি ভালোবাসো নাগরিক বনভূমি
আর ভালোবাসো এভিনিউ জুড়ে ছায়াতরু মেহগনি
দূর পেভমেন্টে সাদাকাশবনে মায়াবিনী হাতছানি
মেয়েদের স্কুলে দৃপ্ত দাঁড়ানো ঋজু উইলোর সারি।
অত জোর নেই মনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি।
তুমি ভালোবাসো লেকের সীমায় বন্দি নিথর জল
হোসপাইপের জানু ফেটে নামা কিশোর নদীর গান
গ্রিন হাউসের শীতাতপে ফোটা গোলাপের গ্রন্থনা
মৃত পড়ে থাকা ঝিলের চিবুকে সবুজ বলয় রেখা
অত জোর নেই মনে।
তুমি ভালোবাসো লোডশেডিং-এর রাত
আর ভালোবাসো ফিকে জ্যোৎস্নায় মাতাল ঘুমনগর
নারকোল শাখা ছুঁয়ে পড়া ছাদে রাত জেগে জেগে দেখা
ছায়াপথ জুড়ে ঝুঁকেঝুঁকে হাঁটা লম্বিত কারো ছায়া
দূর ঝাউবনে দলবেঁধে নামা সাদাপাখা বকপাতি
অত জোর নেই মনে।
তুমি ভালোবাসো ঘুমন্ত বন্দর
নিঝুম জেটিতে নোঙ্গর করা অন্ধ নৌবহর
তুমি ভালোবাসো অলস শ্রাবণ দিন
নীরব দুপুর চুপ চিলেকোঠা, মৌরসি রিমঝিম
অত জোর নেই।
তুমি ডাকলেই ঠোঁটের গোপন দু'পাতার এস্রাজে
চুমোর ধ্রুপদ সংগীতে হই লীন।
প্রিজম কিংবা স্টিরিওফোনিক
কবিতা বণিক দাঁড়াও ক্ষণিক
কবিতা শোনাই স্টিরিওফোনিক
দুইটি শরীর সমান্তরাল
অযৌন প্রতিবন্ধি
মিলন রহিত চিরায়ত কাল
প্রিজম ঘটালো সন্ধি
দুইটি পংক্তি মোহনাবিহীন জানে না যুগলবন্দি
তিনতলা কাচ আলোকারসাজিতে ঘটালো জটিল সন্ধি
দুইটি পংক্তি সংগমহীন জানে না স্তবক শক্তি
বিলম্বিতচল শামুক পয়ার শিকলো মোহনা মুক্তি
শর্তস্বরূপ কিশোরী পংক্তি হয় আনুভূমি তনু
কিশোর পংক্তি উপগত হয়ে তুলে নেয় রঙধনু
টান টান ছিলা দেহ টান টান
পয়ার মাত্রা ভাঙে খান খান
রঙের নেশায় কিশোরী শরীর
খুলে দেয় পাতা গোপন যোনির
কিশোর পংক্তি পরাগ মাখিয়ে
শিরায় শোণিত ফেনায়
এলোমেলো ছোঁড়ে
গান্ধর্ব তীর
প্রবল উত্তেজনায়
রামধনু খেলে রঙের ঝাঁপি নদীতে রঙের বান
যুগল নদীতে প্রমত্ত স্রোতে স্টিরিওফোনিক গান
থই যদি চাও মিলবে না বাঁও
প্রগতি ডায়াক্রমিক
ফিরে যাও ভাই ব্যস্ত বণিক
কবিতা ফুরোলো স্টিরিওফোনিক।
বাজার
বাজার আমাকে খুব তাড়া করে। গন্ডারের মতো
একলা পেলেই
ধেয়ে আসে আমার দিকেই। বস্তুত
জলছাপে গুপ্ত বাঘ টাকা থেকে নিখোঁজ হতেই
পণ্যের আড়ালে সে অবস্থান নিতে পারে
এ কথা ভেবে
সাধারণত আমি খুব ভয়ে ভয়ে থাকি।
সন্তর্পণে পথে নামি।
পারতপক্ষেও কোনো দোকানে ঢুকি না।
পাছে ঘুরে দাঁড়াতেই
পণ্যের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে টুঁটি চেপে ধরে।
এই সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিতে পারি না বলেই
সেলসম্যান ডাকলেই মনে হয় বুঝি
সে আমাকে পসরার উর্ণাজালে নিয়ে যেতে চায়
এর মধ্যেও বাঘের কোনো প্ররোচনা থাকতে পারে
জেনে তার প্রলম্বিত হাসির মধ্যেও
বাঘের প্রলুব্ধ জিব নড়ে উঠতে দেখি
একান্তই যদি কোনো দিন
কখনও কোথাও কোনো দোকানে ঢুকে পড়ি
খুব সতর্ক হয়ে বিভিন্ন পণ্যের দিকে চোখ রেখে রেখে
কোনো কিছু না কিনেই বাইরে চলে আসি।
তখনই ক্যাশবাক্স থেকে বাঘটি প্রকাশ্যে আসে
আমার দিকে দাঁত বার করে হাসে
তাচ্ছিল্যের হাসি।
কান্ট্রি গার্ল
টাকার প্রান্তে হাতছানি দেয় সরল অঙ্ক-মিনার
চারদিকে তার কাঁটাতারের সীমা
দিঘির মতো অর্থ বেঁধে রাখে
সীমার ভেতর গোল তোরণের পিছে
জলছাপে এক গোপন বাঘের সতর্ক প্রহরা
বাঘের বশীকরণ যারা জানে
তারাই পাবে রহস্যময় আঁধার ঘরের চাবি।
যখন ভাবি লক্ষ্য আমার প্রান্তসীমার সরল অঙ্ক-মিনার
তখন কেন আরোহণের আদিম যন্ত্রণায়
বায়বীয় শরীর আমার ধোঁয়ার মতো খুব
অভিসন্ধিপরায়ণ কুণ্ডলী পাকায়;
অনায়াসে পেরিয়ে যায় সকল বন্ধ দ্বার
নিমিষে য়ে দারোয়ানের সতর্ক চোখ ফাঁকি।
যখনই পাই অর্থের অন্তর
অন্তর থেকে নিহিত অর্থ গোলাপের মতো খোলে
মেলে ধরা পাপড়িগুলো খুব সহজে পড়ি
তুষার মৌলি শীর্ষে ঘুমানো ঝরনা লাফিয়ে নামে
খোঁপামুক্ত দীঘল কালো চুল
পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে মাছের মতো কেউ
সাত-সমুদ্র সমান শূন্য হাহাকারের ঢেউ
চোখে যে তার দু'কূল ভাঙা ঘোলা নদীর জল
শিশ্ন আমার খড়গ-কৃপাণ, তাজা কান্ট্রি-গার্ল
আহা, ভাটার কাদামাটির ওপর থাকল তোমার কায়া
অর্থ আমার আনন্দ ভাই, তুচ্ছ মোহমায়া।
ক্যাশভল্টের ফার্নেস
হাজার ওয়াটের লাল জ্বলে উঠল ও ডি. লেজারে
সিসি লেজারে জ্বলে উঠল গনগনে লোন ফিগার
লোনের কাঁচা পয়সাগুলো খই-এর মতো ফুটছে রাস্তা-ঘাটে
শিলাবৃষ্টির মতো
চৈত্ররাতের তারার মতো
তারাবাজির ফলকির মতো
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে লোনের টাকাগুলো নিসর্গে
(বস্তুত নর্দমা হয়ে ভাগাড়ে
আন্ডারড্রেন হয়ে সুইস ব্যাংকে)
লোন ফিগার জ্বলে উঠল ব্যাংকিং ব্যবস্থার মেরুদণ্ডে
মজ্জায় শিরায় স্পন্দনে।
চক্রবৃ্দ্ধি শ্বাপদের লেলিহান জিব সঞ্চয়কারীদের
ঠাণ্ডা গাল চেটে দিচ্ছে।
তাদের স্বপ্নের তওয়ায় তাদের সঞ্চিত সিকি,
আধুলি আর কাঁচা টাকাগুলো স্ফীত হতে
হতে চাপাতিরুটির মতো ফুলে উঠছে
(বস্তুত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে ঠাণ্ডা সাপ
বিষক্রিয়ায় নেমে এল নিরুদ্বিগ্ন ঘুম)
সেভিংস একাউন্টের পোষা পায়রাগুলো
এফ. ডি. আর.-এর রাজকীয় হাঁসগুলো
লোনের ওভেনে রোস্ট হয়ে চলে যাচ্ছে
ডিলিং অফিসার, সাইনিং অথরিটি, আর বোর্ড
অফ বরোয়াদের আলো-আঁধারি বাটোয়ারার টেবিলে।
লোন ফিগার জ্বলে উঠল বন্টন ব্যবস্থার চোরাগলি।
আর বিপননের অন্ধকার ঘুপচিতে
ছাপোষাদের কষ্টসঞ্চিত রক্ত ব্লাডব্যাংকের
আন্ডারড্রেন হয়ে চলে যাচ্ছে অভিজাত ক্লিনিকসমূহে
বহুমূল্যে কিনে পোষা রোগ নিরাময়ে
আমাদের প্রোটিনগুলো পাচার হয়ে চলে যায়
চাইনিজ রেস্তোরাঁয়।
অতিভুক্ত ক্ষুধামন্দা সুড়সুড়ি দিতে
সীমান্ত পার হয়ে কখনো কখনো
ভীনদেশি পুঁজিস্পর্শ পেতে।
ব্যাংকিং আওয়ারের শুরুতে আজ
ফার্নেসের মতো জ্বলে উঠল ক্যাশভল্ট।
জ্বলে উঠল গনগনে কয়লার তাড়ার মতো টাকা
জ্বলে উঠল থরেথরে সর্ট আউট করা কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা।
অনাঘ্রাত কিশোরী লোন প্রোপোজালগুলোর
হার্ট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে
উদার শিল্পনীতির মালা, নিরীক্ষার তাজা রক্ত
অথরিটিবিহীন কলম-শ্রমিকেরা
অসহায় শরীরে অত্যাচারের
চিহ্ন নিয়ে ক্রমশ চেয়ার থেকে নেতিয়ে পড়ছে
রক্তে ব্যর্থ আন্দোলনের গম্ভীর কোলাহল
করোটি জুড়ে গুঞ্জন করে মৃত্যুর মৌমাছি।
আনুভূমিক কবিতা
ব্রিজের নিচেই মরানদী
সত্য যদি
চাও
ঝাপটে ধর তাকে
পাঁকে।
পাঁকের মধ্যে আলিঙ্গনের আনন্দ তো জানো
সত্য যদি চাও
যাও
উপর থেকে শাণিত এক জলপ্রপাত হানো
কাদার গভীর থেকে তোমার শিকড় খুঁড়ে আনো।
উষ্ণ প্রস্রবণে পাবে মরা নদী বান
বুকের নিচে কাতরানো এক ডাঙার মাছের গান।