জুলাই মাসের এক দুপুরে বাংলাদেশ থেকে এক বন্ধুর ফোন পেলাম। তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠা।
Published : 05 Oct 2016, 06:43 PM
বন্ধুর চাচাতো ভাইয়ের ব্রেন টিউমার হয়েছে বলে আশঙ্কা করছে তারা, যদিও বাংলাদেশে চিকিৎসক নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেনি। তারা এমআরআই করে টিউমারের একটা ধরনের কথা বলেছে কেবল।
স্বাভাবিকভাবে ফোনটি মোটেই সুখকর ছিল না আমার জন্য। মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে কারো এমন অসুখ হয়েছে শুনলে আরও খারাপ লাগে। অর্থের কাছে মানুষের যে পরাজয়, সেটি অনুভব করি পরতে পরতে।
বন্ধুটি জানালো, তার ছোট ভাইকে সিঙ্গাপুরে আনতে চায় চিকিৎসার জন্য। আমি সাহস দিয়ে বললাম, পাশে আছি।
তার কিছুদিন পরেই আমার ওই বন্ধুটির চাচা, চাচী আর একজন মামী এলেন সিঙ্গাপুরে রোগীকে নিয়ে।
খবর পেয়ে আমি আর আমার বর তৎক্ষণাৎ ছুটলাম। রোগীর অবস্থা এতো খারাপ হয়ে উঠেছিলো যে, সিঙ্গাপুরে আসার পর সাথে সাথেই তারা রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।
যাই হোক, আমাদের যেতে বলা হলো সিঙ্গাপুরের অন্যতম নামী হাসপাতাল মাউন্ট আলভারনিয়াতে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, রোগীর মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য একটি অপারেশন করা হয়েছে। সেটি এক ধরণের এমবোলাইজেশন (রক্তের বাধা দূর করার বিশেষ চিকিৎসা)। কেননা টিউমার এতো বড় হয়ে গেছে যে, যেকোনো সময় রোগীর ব্রেন হেমারেজ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
তাই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এড়াতে ওই অপারেশনের দরকার হয়। পরদিন টিউমার অপারেশন করতে হবে। সেই অপারেশন হবে সিঙ্গাপুরের আরেকটি বড় হাসপাতাল গ্লেনিগেলসে।
ডাক্তার যা হিসেব দিয়েছে তাতে আমরা অনুমান করছিলাম রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রায় সত্তর লাখের মত খরচ পড়বে। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম এই খরচটা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা যেত।
আমরা শুনে খুব অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, তাহলে এত টাকা লাগছে কেন? উত্তরে রোগীর মামী জানালেন, সিঙ্গাপুরে আসার আগে তারা সরাসরি ডাক্তারের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিলেন এবং ডাক্তারও রোগীর চিকিৎসা করতে সম্মত হন।
কিন্তু এজেন্টের মাধ্যমে চিকিৎসা ভিসার জন্য আবেদন করতে গিয়ে তারা কিছুটা বিপাকে পড়েন। ডাক্তার বা রোগী চাইলেও অন্য কোনো হাসপাতালে অপারেশন করানো যাচ্ছিলো না। এজেন্ট যেসব হাসপাতালে যেতে বলবে রোগীকে সেসব হাসপাতালে গিয়েই চিকিৎসা নিতে হবে।
সিঙ্গাপুরের প্রায় সব হাসপাতালেই ভালো চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে একই অপারেশন করাতে একেক হাসপাতালে একেক রকম খরচ হয়ে থাকে। খরচের পার্থক্যটা কখনও কখনও তিন বা চারগুণেরও বেশি পড়ে। কারণ, রোগীর থাকার জন্য একেক হাসপাতাল একেক ধরণের ব্যবস্থা দিয়ে থাকে।
কোনো কোনো হাসপাতালে রোগীর থাকার ব্যবস্থা ভীষণ রকমের বিলাসবহুল, আর কোথাও সাধারণ মানের। কাজেই খরচও সে হিসেবে কম-বেশি হয়।
আবার ভালো ডাক্তাররা একই সঙ্গে বিভিন্ন হাসপাতালের হয়ে কাজ করেন। যেমন ধরুন, আপনি চান একজন ভাল ডাক্তার আপনার অপারেশনটা করুক, তবে খরচটা যেন কম হয়। সেক্ষেত্রে ডাক্তার হয়তো আপনাকে পরামর্শ দিতে পারে, খুব বিলাসবহুল হাসপাতালে না গিয়ে সাধারণ একটি হাসপাতালে যেতে।
আমাদের এই রোগীর বেলাতেও তাই হয়েছিলো। এজেন্টের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে না আসলে, এই চিকিৎসকই অন্য যেকোনো হাসপাতালে অপারেশনটা করতে পারতেন এবং খরচ কম হতো।
এজেন্টরা রোগীদের নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করে কেন? নিশ্চয়ই এতে তাদের বেশি লাভের ব্যাপার থাকে।
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, সবকিছুতেই কেন এই ভাবে ‘গলা কাটা’ লাভ করতে হবে? এজেন্টরা কি পারে না, রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকের যোগাযোগ করিয়ে দিতে, তারপর না হয় রোগী তার সাধ্যমত হাসপাতালটা বেছে নিতো! এসব ভাবতে ভাবতে সকাল হয়ে গেলো।
রোগীর অপারেশন করানোর জন্য আমাদের যেতে হবে গ্লেনিগেলস হাসপাতালে। কিন্তু মাউন্ট আলভার্নিয়া হাসপাতালের বিল দেয়া সম্ভব হয়নি তখনও।
এদিকে গ্লেনিগেলস হাসপাতালের অপারেশন তাড়াতাড়ি শুরু করতে হবে। উপায় না দেখে বিল পরিশোধের আগেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে ছেড়ে দিলো।
আমরা গ্লেনিগেলস এর উদ্দেশ্যে মাউন্ট আলভার্নিয়া থেকে বের হলাম। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম মাউন্ট আলভার্নিয়াকে, বিল পরিশোধের আগে রোগীকে ছেড়ে দেয়ার জন্য।
সবদিক থেকে টাকার ব্যবস্থা করা যখন কঠিন হয়ে পড়েছিলো, ঠিক ওই মুহূর্তে হাসপাতালের সহযোগিতা আর বিশ্বাস যে আমাদের মনে কতটা ভরসা এনে দিয়েছিল, সেটা কেবল আমরাই বুঝি।
মনে মনে সেইসব দিনের কথা স্মরণ করলাম, যখন বাংলাদেশে বসে বসে প্রতিনিয়ত খবর শুনতাম, ঢাকার অমুক হাসপাতাল বিল পরিশোধ করতে না পারায় রোগীর লাশ আটকে দিয়েছে, তমুক হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা গিয়েছে।
আমরা গ্লেনিগেলস হাসপাতালে পৌঁছামাত্র একটা পরীক্ষা করে রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো।
ততক্ষণে অস্ট্রেলিয়া থেকে মাউন্ট আলভার্নিয়ায় অর্থ পৌঁছে গেছে। গ্লেনিগেলস হাসপাতালেও অপারেশনের পুরো টাকাই দিয়ে দেয়া হয়েছে।
অপারেশন করতে গিয়ে চিকিৎসকরা দেখলেন যে, এমআরআই রিপোর্টে যে ধরনের টিউমারের কথা বলা আছে, এই টিউমারটি তেমন নয়। ফলে, রোগীর বায়োপ্সি করানো হলো। বায়োপ্সি রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক জানালেন, টিউমারটা এতো বড় হয়ে গিয়েছে যে অস্ত্রপচার করে সেটি অপসারন করা সম্ভব নয়।
আর তাতে মস্তিষ্কের বিভিন্ন শিরা-উপশিরা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যা রোগীর স্থায়ী ক্ষতি সাধন করতে পারে। তবে চিকিৎসক জানালেন, কেমোথেরাপি এবং অন্যান্য ওষুধ দিয়ে ধীরে ধীরে এই টিউমার অপসারণ করতে হবে।
সত্যি বলতে কি, টিউমার অপসারণ করা না গেলেও, রোগটা শনাক্ত করতে পারায় আমরা অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত বোধ করছিলাম। রোগীকে গ্লেনিগেলস হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হলো। আমরা জেনে অবাক হলাম যে টিউমারের অপারেশন থামিয়ে দেওয়ায়, গ্লেনিগেলস হাসপাতালে অপারেশন বাবদ যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয়েছিল তার একটা অংশ ফিরিয়ে দিয়েছে তারা!!
সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে আমাদের রোগীর প্রথম কেমোথেরাপিটা দেওয়া হলো। একবার কেমোথেরাপি নিয়ে রোগী অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলো। যে ছেলে কয়েকদিন আগেও যন্ত্রণায় চিৎকার দিতো, সে এখন চুপচাপ আছে, শান্তভাবে সবার সঙ্গে কথা বলছে, ঘুমাচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানালেন, তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী বাকি কেমোথেরাপিগুলো ঢাকায় অথবা ভারতে গিয়ে দিলেও চলবে। তার মানে, এখন রোগী দেশে ফিরতে পারে।
রোগীর স্বজনদের চোখ-মুখে স্বস্তি দেখতে পেলাম আমি। তাদের স্বস্তি দেখে আমি নিজেও এক ধরণের প্রশান্তি অনুভব করলাম।
রোগীর মা জানালেন, এতো উৎকন্ঠা এতো চিন্তা আর এতো তাড়াহুড়া করতে হতো না, যদি রোগটা সময় মতো নির্ণয় করা যেত। তার ওপর আবার ঈদের কারণে পাসপোর্ট অফিস বন্ধ থাকায় আরো দেরি হয়ে গিয়েছিলো।
জানতে পারলাম, মাথা ব্যাথার কারনে রোগীকে নিয়ে যখন তারা দেশের বিভিন্ন চিকিৎসের কাছে গিয়েছেন, তখন প্রথম একমাস ডাক্তাররা রোগীর চশমার পাওয়ার বদলে দিয়েছে, কেউ সাইনাসের ওষুধ দিয়েছে, কেউ আবার সর্দি জ্বরের ওষুধ দিয়েছে।
এরপর যখন স্বজনরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে নিউরোস্পেশালিস্ট এর কাছে গিয়েছেন, তখনই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ধরা পড়ে রোগীর টিউমার। অর্থাৎ বাংলাদেশে টিউমার সনাক্ত করতেই লেগে গেলো প্রায় দুই-আড়াই মাস।
আর কিছুদিন দেরি করে চিকিৎসা শুরু করলে যে কি হতো জানি না। আমাদের এই রোগীর বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষিত বলেই হয়তো তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে রোগীকে নিউরোস্পেশালিস্টের কাছে নিতে হবে। ভাবতে পারেন, যেসব পরিবারে বাবা-মা অতটা শিক্ষিত নন, তারা কতটা অসহায় আমাদের দেশের চিকিৎকদের কাছে?
কদিন আগে রোগীর খবর নিলাম। দেশের ডাক্তারদের সম্পর্কে ভালো খবর খুব কম পাই।
জানতে পারলাম, একজন সিনিয়র চিকিৎসক কেমোথেরাপি দিতে রাজী হয়ে নির্ধারিত দিনে তিনি আর আসেননি। তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে পাঠিয়েছিলেন কেমোথেরাপি দিতে। বাধ্য হয়ে রোগীকে ভারতের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয় কেমোথেরাপি দিতে। এই হচ্ছে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা!
অথচ সিঙ্গাপুরে সেই এক ডাক্তারকেই দেখলাম তিন-তিনটা হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন।
যারা ঠিক মতো রোগ নির্ণয় করতে পারেন না, তারা চিকিৎসা করবেন কিভাবে? রোগী তো বাধ্য হয়ে বিদেশে যাবে চিকিৎসার জন্য। কিন্তু, বাংলাদেশের কয়জন মানুষ পারে, এতো টাকা খরচ করে পরিবার-পরিজনের চিকিৎসার ব্যায় বহন করতে?
সোজা উত্তর, যার টাকা আছে সে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ্ হবে, যার টাকা নেই সে চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে।
তাহলে, প্রতি বছর যে জনগনের টাকায় লেখাপড়া করে এতো এতো এমবিবিএস ডিগ্রিধারী বের হচ্ছে, তাদের দিয়ে কি করবো আমরা?
দেশের সব সেক্টরে উন্নয়নের কথা শুনছি। কবে শুনতে পারবো চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই?
লেখক: সাংবাদিক। [email protected]