ইন্টারনেটে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আলোচকরা।
Published : 03 May 2016, 05:34 PM
বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবসে মঙ্গলবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ইউনেস্কো, এমএমসি ও আইসিএস আয়োজিত অনুষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে কথা উঠে।
এই মাধ্যমের গুরুত্ব তুলে অনুষ্ঠানের আলোচক প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান বলেন, “সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এগুলো মেইনস্ট্রিম মিডিয়া এবং সেই অর্থে ট্রাডিশনাল মিডিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে আজকাল।”
“গণমাধ্যমের বিস্তৃতি যথেষ্ট হচ্ছে এবং হতেই থাকবে। আর নতুন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে,সোশাল মিডিয়া বা নিউ মিডিয়া,” বলেন সাংবাদিকতার এই অধ্যাপক।
বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবসে ইউনেস্কোর উদ্যোগে পৃথিবীর একশটির বেশি দেশে একযোগে আলোচনা অনুষ্ঠান হয় মঙ্গলবার।
বৈশ্বিক এই আয়োজনের মূল অনুষ্ঠান হয় ফিনল্যান্ডে । বাংলাদেশে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘দ্য স্টেট অব প্রেস ফ্রিডম ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড”।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীর সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানে প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান ছাড়াও আলোচনা করেন টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল।
অনুষ্ঠানে আলোচনায় বারবারই উঠে ইন্টারনেটে সামাজিক মাধ্যমের প্রসঙ্গটি। বিশেষ করে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও বিদ্বেষ ছড়ানো, ব্যক্তি আক্রমণ করাসহ নানা বিষয় উঠে আসে বক্তাদের কথায়।
অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু জাফর মো. শফিউল আলম ভূইয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আইন সংশোধনের সুপারিশ করেন।
“আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাকে সংশোধন বা বাতিল করার কথা বলছি। তবে রামু অন্যান্য ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য সিআরপিসিকে সংশোধন করতে হবে।”
তবে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের প্রতিনিধি সালিম সামাদ ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
এসময় তৌফিক ইমরোজ খালিদী বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে ফেইসবুকে একটি মিথ্যা তথ্যমূলক প্রচারণার বিষয়ে সেলিম সামাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ওই তথ্যের সত্যতা জানতে চান।
এই পর্যায়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েকজন আলোচক বলেন, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণা হরহামেশাই দেখতে পান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের বিস্তৃতি মত প্রকাশের ক্ষেত্র প্রশস্ত করে দিলেও তার অপব্যবহার বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও তুলে ধরেন বাংলাদেশের প্রথম ইন্টারনেট সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী।
“তখন এটা খারাপ, যখন সীমা লঙ্ঘন করা হয়। উগ্রপন্থিরা যখন কোনো ঘটনায় সাধারণ মানুষকে সহিংস হয়ে ওঠার উসকানি দেয়... তখন সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের জরুরিভিত্তিতে আলোচনা শুরু করা উচিৎ।”
“উগ্রপন্থিরা যখন তাদের মতো করে স্বাধীনতার চর্চা করে, তখন অন্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কাঁচি চালাতে হয়। হয়রানি, হামলা, এমনকি খুন হওয়ার আতঙ্কও কাজ করে।”
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের মতো ‘মুক্ত গণমাধ্যমের’ দেশেও ফেইসবুকে বিক্ষোভের আহ্বান জানানোর কারণে দুই তরুণের সাজা হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন তৌফিক খালিদী।
ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু আইন প্রয়োগের পক্ষে নিজের অমত জানান প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান।
‘সোশাল মিডিয়াকে কে নিয়ন্ত্রণ করবে? নিয়ন্ত্রণ কোনো পদ্ধতি হতে পারে না,” বলে তিনি ব্যবহারকারীদের আত্মসচেতন হওয়ার উপর গুরুত্ব দেন।
জাতিসংঘের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক তথ্য কর্মকর্তা কাজী আলী রেজা বলেন, “আমরা কত আইন করব?... শিক্ষিত হতে হবে।”
মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রয়োজনে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘স্বাধীন ও দায়িত্বশীল’ কাজের উপর জোর দেন সুলতানা কামাল।
“সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, সবসময় সরকারই সব কিছু করে দেবে বা সরকারের কাছ থেকে আমাদের সব প্রত্যাশা পূরণের যে সংস্কৃতি, সেটা নিয়ে বসে থাকব কেন? আমি বিশ্বাস করি, যদি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ দায়-দায়িত্বগুলো স্বাধীনভাবে পালন করতে পারে এবং আমরা নাগরিকরা যদি নিজ নিজ দায়-দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করতে পারি, তাহলে বিরাট বড় পরিবর্তন আসবে।”
অনুষ্ঠানে প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামনিস্ট সৈয়দ বদরুল আহ্সান স্বআরোপিত নিষেধাজ্ঞার (সেল্ফ সেন্সরশিপ) সমস্যার দিকটি তুলে ধরেন।
“আমরা সরকারি নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি, ৫৭ ধারার কথা বলছি; কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে যে সেল্ফ সেন্সরশিপ করি, সেগুলোও দেখার বিষয়।”
তৌফিক ইমরোজ খালিদী সংবাদ মাধ্যমের মালিক পক্ষ আরোপিত নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে বিজ্ঞাপনদাতাদের ‘পেশিশক্তি’ ব্যবহারকে বর্তমান সময়ে মুক্ত সাংবাদিকতার চর্চার পথে বড় বাধা বলে মনে করেন সম্পাদক তৌফিক খালিদী।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটেও গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রের কিছুটা নজর রাখার প্রয়োজন আছে বলে মন্তব্য করলেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিপক্ষেও মত জানান তিনি।
ওই তদারকি কেন হবে- তার ব্যাখ্যায় তৌফিক খালিদী বলেন, “যখন উগ্র ডানপন্থিরা একটি চরম পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, তখন রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট কিছু সংবাদ মাধ্যমের নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ডের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
“তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, রাষ্ট্র কেবল তখনই হস্তক্ষেপ করে, যখন সরাসরি সরকারের স্বার্থে আঘাত আসে। সমাজে শান্তি রক্ষায় যুগ যুগ ধরে ভূমিকা রাখছে- এমন কোনো মূল্যবোধ যখন আক্রান্ত হয়, তখন রাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নেয় না।... ইউটিউবে যারা ধর্মের নামে অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, তাদের কারও শাস্তি হওয়ার কথা কখনও শোনা যায় না।”
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালায় সশস্ত্রবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষার জন্য নিষেধাজ্ঞার ধারা যুক্ত করার সমালোচনাও করেন তিনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে ২৪৪ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন; যার মধ্যে একজন নিহত হন।