মৃধা বনাম মৃধা: পিতা-পুত্রের আইনি লড়াইয়ের ‘কান্নাকাতর’ আখ্যান

সম্ভাবনার সূর্য উঠেছে হয়ত। নতুন বছরে (২০২২) বাংলা ছবির এই সূর্য আলো ছড়াবে নির্ঘাত। বছর শেষে ঘুরতে যাওয়া, মেলায় নতুন বই কেনা, নববর্ষ, ঈদ বা পূজা উৎসবে নতুন খাবার ও পোশাক কেনার মতো নতুন ছবি দেখা হয়ে উঠুক মধ্যবিত্তের পবিত্র অভ্যাস। এই অভ্যাস শুরু করুন ‘মৃধা বনাম মৃধা’ ছবিটি দেখার মাধ্যমে!

বাবার জন্য হৃদয়বন্দি এক ভাংচুর কান্নার ছবি মৃধা বনাম মৃধা। মৃধা বনাম মৃধা নিয়ে যাবে আপনাকে আপনার পরিবারে। মনে করিয়ে দেবে আপনার পরিবারের সব সদস্যের কথা, মনে করিয়ে দেবে যে কোনো ছেলের প্রথম জীবনের নায়ক তার বাবার কথা, যে কোনো ছেলের তার বাবার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কথা। আপনি কাঁদবেন। নিশ্চিত করে বলা যায় আপনি কাঁদবেন। কাঁদাতে পারাই ছবি ভালো হওযার একমাত্র নিয়ামক নয়। সবটা নিয়ে যে ছবিটা ভালো এবং মনে রাখার মতো সেটি ‘মৃধা বনাম মৃধা’।

সারা পৃথিবীতে পরিবারকেন্দ্রিক ছবি বহুবার আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যেমন ‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’। রবার্ট বেনটন পরিচালিত এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বিবাহ বিচ্ছেদের সময়কাল আর বাবা ও শিশু ছেলের মনস্তত্ব নিয়ে ডাস্টিন হফম্যান ও মেরিল স্ট্রিপ অভিনীত এই ছবি হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল কোটি দর্শকের। এপর্যন্ত বাবা-ছেলের দ্বন্দ্বের গল্প অসংখ্যবার তৈরি হয়েছে। কিন্তু মৃধা বনাম মৃধা আপনাকে বাংলা ছবির এই বাঁকবদলের সময়টাকে নতুন করে আলো দেখাবে।

মৃধা বনাম মৃধা মুক্তি পেয়েছে ২০২১ এর ২৪ ডিসেম্বর। পরিচালক রনি ভৌমিক এর প্রথম ছবি এটি। আশরাফুল ও আশফাকুল মৃধার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান ও সিয়াম। অবসরে যাওয়া আইনজীবী তারিক আনাম খানের একমাত্র ছেলে সিয়াম। সিয়ামের স্ত্রী ঐশীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নোভা ফিরোজ। এছাড়াও অভিনয় করেছেন নিমা আনাম খান, সানজিদা প্রীতি, মিলন ভট্টাচার্য্য ও রিন্টু। প্রত্যেকে স্ব স্ব জায়গায় মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন। তারিক আনাম খান ছিলেন ‘দুর্দান্ত’!

বাবার খানিকটা অতিরিক্ত শাসন বা টেককেয়ার এর অভ্যাস, খানিকটা খামখেয়ালিপনা আর মা’র মৃত্যুর স্মৃতি নিয়ে ভালোই ছিল ‘জুনিয়র মৃধা’ সিয়াম। অফিসে এক প্রেজেন্টেশনের দিন লেগে যায় গণ্ডগোল। ওয়াশরুমের মোটর নষ্ট নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করেন তারিক আনাম খান, প্রেজেন্টেশানের মাঝপথে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফিরতে বাধ্য হন সিয়াম। দ্বিতীয়বার প্রেজেন্টেশনের পর সিয়াম প্রমোশন পান এবং তাকে স্ত্রীসহ সুইডেন যেতে বলা হয়।

ছেলের সাফল্যের এই আনন্দ সংবাদ বিষাদে রূপ নেয়। সুইডেনে যেতে তাকে মানা করেন তারিক আনাম খান এবং শুরু হয় বাবা ছেলের দ্বন্দ্ব। নিজেদের কথোপকথনের এক পর্যায়ে জুনিয়র মৃধা তার স্ত্রী ঐশীকে বলেন- ‘বাবাকে ওল্ড হোমে রেখে আমরা সুইডেন যাব’। এরপর মামলা করেন তারিক আনাম খান এবং অভিমানাহত বাবা ছেলের দ্বন্দ্ব গড়ায় আদালতে।

নিশ্চিতভাবে আবারো বলা যায় সবার অভিনয় আপনার মন ছুঁয়ে যাবে, গল্প কখনো আপনার আরোপিত মনে হবে না। মনে হবে না জুনিয়র মৃধা সিয়াম বড়পর্দার বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করেন, মনে হবে না নোভা ফিরোজের এটা প্রথম ছবি। মনে হবে না নাটকের মিলন ভট্ট কিংবা নিমা আনাম খান ছবিতেও মনে রাখার মতো অভিনয় করতে পারেন।

এই ছবি দেখে বাবাকে মনে পড়বে খুব, কেউ বলবেন -বাবা তোমাকে মিস করছি ভীষণ, কেউ ভাববেন বাবা কত অন্যায় না করেছি তোমার প্রতি। কারও কারও কাব্যিকভাবে মনে পড়বে চানক্য সেনের লেখা ‘পুত্র পিতাকে’ বা ‘পিতা পুত্রকে’ বইয়ের কথা, কেউ হয়ত জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখার একটা লাইনই স্মরণ করবেন-‘পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ থাকতে পারে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই’। সিনেমা হল থেকে বের হবার সময় কারও হয়ত মনেই পড়বে না বাবার জন্য সর্বশেষ আপনি কবে কেঁদেছিলেন!

ছবির অন্যতম প্রাণ পরিচালনার মমতা আর সুন্দর ফটোগ্রাফি। পরিচালক রনি ভৌমিক আর সিনেমাটোগ্রাফার রায়হান খান আলাদাভাবে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা পেতেই পারেন। ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন ইমন সাহা। রম্য গান- –‘ওরে আমার বাপ, দাও না করে মাফ’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন রাগীব স্বাগত এবং ঐশী আর আবেগ ঠাসা গান-‘হৃদয় জুড়ে বইছে এক আদিম অভিমান’ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন জাহিদ নীরব। ‘ওরে আমার বাপ’ ছাড়াও ই কে মজুমদার ইস্তি ‘মুখোশ’ শিরোনামের গানটির সংগীত পরিচালক ছিলেন যে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন তরিক মৃধা। এছাড়া তুষার রহমান একটি গানের কথা লিখেছেন, গানটির সঙ্গীতায়োজন করেছেন।

মৃধা বনাম মৃধার শুটিং শুরু হয়েছিল ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে যা শেষ হয়েছিল অগাস্টে। খুব যত্ন আর পরিচর্যার কারণে ছবিটা ২১ দিন শুটিং এর পর শেষ করা গিয়েছিল। চট্টগ্রাম আর ঢাকাতেই শুটিং হয়েছে। ৩০টা সিনেমা হলে মুক্তি পেলেও কয়েকটি হল থেকে ছবিটা নামিয়ে দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। ছবিটা নিয়ে যতটা আলোচনা হবার কথা ছিল ততটা আলোচনা হয় নি, দর্শক সমাগমও হয়তো কম হয়েছে।

মৃধা বনাম মৃধার মতো ছবি প্রচলিত দর্শকদের রুচি বদলে দেবে এবং জয় হবে বাংলা সিনেমার!