জ্বালানি আর খাদ্যের বাজার, ইউরোপের ব্যাংক ব্যবস্থা, উদীয়মান অর্থনীতি কিংবা রাশিয়ার রুবল– কোনোকিছুই যুদ্ধের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেনি।
Published : 24 Feb 2023, 11:23 PM
এক বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বিশ্ববাজারের পাশাপাশি সব ধরনের অর্থনীতির দেশকে কমবেশি অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জ্বালানি আর খাদ্যের বাজার, ইউরোপের ব্যাংক ব্যবস্থা, উদীয়মান অর্থনীতি কিংবা রাশিয়ার রুবল– কোনোকিছুই এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ, যা ইউরোপকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। এই যুদ্ধ ঘিরে গত ১২ মাসে আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থায় যে পরিবর্তন এসেছে, পাঁচটি চার্টে তা ব্যাখ্যা করেছে রয়টার্স।
ডলারের জয়জয়কার
ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরুর পর গত একটি বছরজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রেখে দোর্দণ্ড প্রতাপে, এর অনেকগুলো কারণও রয়েছে। একটি কারণ হল, চরম অস্থির সময়ের মধ্যেও সবচেয়ে নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে ডলার। যুদ্ধের জেরে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ইউরোকে ভুগতে হয়েছে দারুণভাবে, এটাও ডলারকে তেজী রাখতে ভূমিকা রেখেছে।
গত সেপ্টেম্বরে ডলারের দর দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। সেখান থেকে এখন সামান্য কমলেও অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে অন্তত ৮ শতাংশ বেশি এর দর।
সরকারি বন্ডগুলোকে আগে বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম বলে ধরা হলেও যুদ্ধের জেরে সেখানেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অবশ্য যুদ্ধ শুরুর পর বিনিয়োগকারীরা যখন তাদের সম্পদ বিনিয়োগের নিরাপদ জায়গা খুঁজছিলেন, সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বন্ডগুলোর দাম বেড়েছিল।
কিন্তু যুদ্ধের জেরে জ্বালানি সঙ্কট যখন শুরু হল, মূল্যস্ফীতি যখন বাড়তে থাকল, পরিস্থিতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যখন সুদ হার রেকর্ড পরিমাণে বাড়াতে শুরু করল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বন্ডগুলোর দামও ফের পড়তে শুরু করল।
রাশিয়ার পাইপলাইন
ইউক্রেইন যুদ্ধ জ্বালানি খাতে যে সংকটের জন্ম দিয়েছে, ততটা আর কখনও হয়নি। করোনাভাইরাস মহামারীর পরবর্তী সময়ে জ্বালানির দাম এমনিতেই আকাশচুম্বী ছিল। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর ইউরোপে গ্যাসের মূল্য দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আর অগাস্টে তা আগের বছরের তুলনা বেড়ে যায় প্রায় ৭০০ শতাংশ।
যুদ্ধের আগে ইউরোপের ৩০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ দিত রাশিয়া। কয়েক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন পেরিয়ে সেই গ্যাস ইউরোপে পৌঁছাত। কিন্তু রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ঢেউ শুরু হলে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে জ্বালানির দামের সঙ্গে সঙ্গে মন্দা আর ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা এক শীতের শঙ্কা বাড়তে থাকে ইউরোপে।
তবে ইউরোপের জন্য বাঁচোয়া, শীত এবার ততটা ভয়ঙ্কর চেহারা নেয়নি। আর দ্রুতই গ্যাসের নতুন উৎসের সন্ধান তারা পেয়েছিল। তাতে গ্যাসের দাম আবার কমে ২০২১ সালের অগাস্টের পর সর্বনিম্ন অবস্থায় চলে এসেছে। কিন্তু পাইকারি বাজারে এর প্রভাব হয়েছে ব্যাপক। ভোক্তাদের মোটামুটি ৬ থেকে ৯ মাসের একটি ধাক্কা লেগেছে ওই সময়ের দাম বৃদ্ধির কারণে।
খাদ্যমূল্য
করোনাভাইরাস মহামারীর পর ২০২১ সালে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়তে শুরু করেছিল। তার মধ্যে ইউক্রেইনে রাশিয়ার আক্রমণ নতুন করে জটিলতা তৈরি করে। তাতে খাদ্য সঙ্কটের পাশাপাশি কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ বিপর্যস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে থাকে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর খাদ্যমূল্য আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। আর ২০২১ সালে তার ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
জ্বালানির উচ্চ মূল্য, অন্যান্য খরচ, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং বিপুল চাহিদা বাজারব্যবস্থায় ওপর চাপ তৈরি করে। পুরো ২০২২ সাল জুড়েই খাদ্যশস্য, মাংস, দুধ ও উদ্ভিজ্জ তেলের দাম রেকর্ড বৃদ্ধি পায়।
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য মূল্য কমতে শুরু করলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর সুফল খুব একটা যাচ্ছে না ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে। এসব দেশে খরচের বড় একটি অংশই খাদ্য ও জ্বালানির পেছনে যায়।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য শূন্যে নামানোর যে লক্ষ্য ছিল, মহামারী আর ইউক্রেইন যুদ্ধ এসব দেশের জন্য তা অর্জন প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।
রাশিয়ার রুবল
গত বছরের পুরোটা জুড়ে রাশিয়ার রুবল ব্যাপক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে রাশিয়ার আক্রমণের পরপর মার্চের মধ্যেই রুবল প্রায় ৫০ শতাংশ দর হারায়। তবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, বিদেশি মুদ্রায় নিষেধাজ্ঞা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার বাড়ানোর ফলে জুনে তা আবার প্রায় ২০০ শতাংশ বেড়ে যায়। এরপর এই এক বছরে রুবল অবশ্য তার যুদ্ধের আগের সময়ের গড় হার ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
তেল-গ্যাস থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্যই রাশিয়া অন্যান্য আন্তর্জাতিক মুদ্রার চেয়ে রুবলকে দুর্বল রাখতে চায়, যাতে ইউক্রেইনে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখার খরচ যোগাতে এবং বাজেট ঘাটতি কমানোর ও অভ্যন্তরীণ ব্যয় মেটানো সহজ হয়।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের রিজার্ভের বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করেও সঙ্কট কাটানোর চেষ্টা করছে। ঘাটতি কাটাতে শুধুমাত্র ডিসেম্বরেই প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে রাশিয়ার মুদ্রার ওপর আরও নতুন চাপ আসতে পারে। যুদ্ধের বর্ষপূর্তি ঘিরে দশম দফা নতুন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ভাবছে ইউরোপের দেশগুলো।
সঙ্কটে ইউরোপীয় ব্যাংক
যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপের ব্যাংকগুলোকে বড় ধরনের জটিলতায় পড়তে দেখা গেছে। যেসব ব্যাংক নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে, সেগুলো বেশ সফলই হয়েছে। তবে পিছিয়ে পড়তে হয়েছে দুই কুল রক্ষা করতে চাওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
অস্ট্রিয়ার রাইফেইসেন ব্যাংক ইন্টারন্যাশনালের শেয়ার যুদ্ধ শুরুর দিন থেকেই বড় ধরনের দরপতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ২০২২ এর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এর শেয়ারের দর কমেছে ৪০ শতাংশের বেশি।
এদিকে ফ্রান্সের সোসিয়েতে জেনারেল তাদের হাতে থাকা রাশিয়ার রোজব্যাংককে মে মাসে বিক্রি করে দিয়েছিল, যেখানে তাদের লোকসান হয়েছির প্রায় প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার।
ইতালির ইউনিক্রেডিট রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ব্যাবসা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার পরও রাশিয়ার শীর্ষ ১৫টি ব্যাংকর মধ্যে একটির মালিকানা এখনও তাদের হাতে আছে। অবশ্য সেই সমপর্ক তারা ছিন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে।