চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুরুর আগে একটি পিকআপ ভ্যানের গাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়েছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে দাবি করলেও সে রকম কোনো আলামত তদন্তকারীরা এখনও পাননি।
Published : 24 Feb 2019, 09:25 PM
বরং বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকের মজুদ থাকা ওয়াহেদ ম্যানশনের দেয়াল যেভাবে ভেঙে বাইরে ছিটকে গেছে, তাতে বিস্ফোরণ আর আগুনের উৎস ওই ভবন বলেই তাদের ধারণা জোরালো হচ্ছে।
তদন্তের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো এখনই চূড়ান্ত কিছু বলছে না। তদন্ত শেষ হলে প্রতিবেদনেই তারা অগ্নিকাণ্ডের কারণ এবং ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে চূড়ান্ত মতামত দেবেন।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ের ওই অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের আধা ডজন তদন্ত দল গত কয়েক দিন ধরে কাজ করছে।
এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে তাদের কাজ অনেকটা গুছিয়ে এনেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অনেকেরই ধারণা, বিস্ফোরণের পর আশপাশের দোকান আর ভবনে রাসায়নিক আর প্লাস্টিক-প্রসাধনের গুদাম থাকার কারণে আগুন ব্যাপক মাত্রা পায়।
তবে সেই বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম তথ্য আসায় এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
কিন্তু পরে ঘটনাস্থল ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ওই ভবনের কাছে বিদ্যুতের কোনো ট্রান্সফর্মার ছিল না। আশপাশের এলাকায় যেসব ট্রান্সফর্মার ছিল, সেগুলোও অক্ষত রয়েছে।
নন্দ কুমার দত্ত রোডের বাসিন্দা মো. আশিক উদ্দিন সেই রাতে চুড়িহাট্টা মোড় থেকে ৩০-৩৫ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি সেদিন জানিয়েছিলেন, হঠাৎ বিকট শব্দের পর ওয়াহেদ ম্যানশন ও পাশের রাজমহল হোটেলের সামনের রাস্তায় একটি পিকআপ ভ্যানকে উপর থেকে নিচে পড়তে দেখেন তিনি।
“আমার মনে হয়, সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হওয়ায় ওই গাড়ি ছিটকে উপরে উঠে গিয়েছিল। আমি দেখেছি নামার সময়। এরপর মুহূর্তে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।”
পরে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনও সাংবাদিকদের একই কথা বলেছিলেন।
কিন্তু বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান পরির্শক শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনো আলামত তারা এখনও খুঁজে পাননি।
“আমরা তদন্ত করছি দুটো সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় রেখে। প্রথমত সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, দ্বিতীয়ত রাসায়নিক থেকে বিস্ফোরণ। কিন্তু সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কোনো আলামত আমরা এখনও পাইনি।”
আর দুই-এক দিনের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন শামসুল আলম।
অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে পুড়ে যাওয়া দুটি পিকআপ ভ্যান ও একটি প্রাইভেটকার রাস্তার পাশেই পড়ে আছে। এর মধ্যে একটি প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডার এখনও অক্ষত থাকতে দেখা যায়। পুড়ে যাওয়া বাকি দুটো গাড়িতে কোনো সিলিন্ডার দেখা যায়নি।
দুটি গাড়ির ওপরের অংশ দারুণভাবে দুমড়ে মুচড়ে গেছে, যা দেখে মনে হয় ওপর থেকে ভারী কিছু সেখানে পড়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিস্ফোরণের পর ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার দেয়াল ভেঙে ওই গাড়ি দুটোর ওপর পড়ে। পাশাপাশি গাড়ি দুটি আগুনে পুড়ে যায়।
“পাশের দুটো ভবনের দেয়ালও ভেঙেছে। তবে সেগুলো ভেঙেছে ভেতরের দিকে। আর ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার দেয়াল ভেঙে বাইরের দিকে ছিটকে গেছে। ভেঙে পড়া দেয়ালের নিচেও মৃতদেহ পাওয়া গেছে।”
আগুন নেভানোর সময় ওই কলাপসিবল গেইট ভাঙা হয়েছিল কি না জানতে চাইলে দেবাশীষ বর্ধন বলেন, “না, এটা এমনই ছিল।”
চারতলা এই ভবনের নিচতলায় ডজনখানেক দোকান, আর দোতলায় পারফিউম ও প্লাস্টিক সামগ্রীর গোডাউন ছিল। আগুনে ওই দুটি ফ্লোরের পুরোটাই পুড়ে গেছে।
এ অগ্নিকাণ্ডের পর যে ৬৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তার মধ্যে ২৪টি পাওয়া যায় ওয়াহেদ মঞ্জিলের নিচতলায়, সিঁড়ি ঘরের ফ্লোরে দলা পাকানো অবস্থায়।
গত বৃহস্পতিবার সকালে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ওই বাড়ির বেইজমেন্ট খুলে সারি সারি রাসায়নিকের ড্রাম ও বস্তার স্তূপ দেখতে পান। আগুন বেইজমেন্টে পৌঁছালে পরিস্থিতি আরও কতটা ভয়াবহ হতে পারত, তা অনুমান করে আঁৎকে ওঠেন তারা ।
তিনি বলেন, "পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হত এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমার মত কাজ করেছে।"
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি শনিবার ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশের ভবনের নিচতলায় থাকা রাজমহল হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেন। ওই ভিডিও টেলিভিশনগুলোতেও প্রচার করা হয়।
সেখানে দোখা যায়, রাতে খাবার হোটেলের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই বাইরে হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণ হয় এবং আগুন জ্বলতে শুরু করে। এর মধ্যেই উপর থেকে হোটেলের নিচে এসে পরে বেশ কিছু পারফিউমের বোতল ও ক্যান।
রোববার ওই ভবনের দোতলা পরিদর্শন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল ক্ষতবিক্ষত দেয়াল এবং পড়ে থাকা ক্যানেস্তারাগুলো পরীক্ষা করে দেখেন।
রাস্তার উল্টো দিকের ক্ষতিগ্রস্ত ভবন দুটি দেখিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এই ভবনের দেয়াল বিস্ফোরণে ভেঙে ওই দুই ভবনে গিয়ে লাগে।”
পরিদর্শন শেষে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা এখন ফাইন্ডিংসগুলো আমাদের মত করে বিশ্লেষণ করব। আজ আমাদের লাস্ট ভিজিট ছিল। স্পটটা আবার দেখে গেলাম। আগেও দেখেছি, আনাদের কনফামেশনের জন্য জাস্ট রি-ভিজিট করছি “
তবে আগুনের উৎস সম্পর্কে এখনই চূড়ান্ত কোনো মন্তব্য করতে চাননি প্রদীপ রঞ্জন।
তিনি বলেন, “প্রাইমারি ডেটা ও সেকেন্ডারি ডেটা দুটোই আমরা কালেকশন করেছি। ফায়ার সার্ভিসসহ ত্রিশজনের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছি। এখন আমরা বিশ্লেষণ করব, তারপর প্রতিবেদন দেব।”
[প্রতিবেদনটি তৈরির ক্ষেত্রে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ওবায়দুর মাসুম।]