স্বাধীনতা নাকি স্বেচ্ছাচারিতা!

গতরাতে এক বাসা থেকে দাওয়াত খেয়ে ফিরছিলাম। যেহেতু শুক্রবার রাত আর আড্ডাটাও জম্পেশ ছিল, তাই ফিরতে ফিরতে ঘড়িতে রাত প্রায় বারোটা।

ফাতেমা-তুজ-জোহরা, সুইডেনের স্টমহোম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2017, 11:20 AM
Updated : 25 March 2017, 11:20 AM

পথে একবার বাস বদলাতে হয়। প্রথমে অবাক হলাম প্রথম বাসটি স্টপেজের কাছে না দাঁড়িয়ে কেন আগেই নামিয়ে দিল! নেমে দেখি সামনে আরো একটি বাস দাঁড়ানো, তার সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স। পাশ থেকে হেঁটে যাবার সময় অ্যাম্বুলেন্সটির ভেতরে তাকিয়ে দেখি একজন রোগী আছে যাকে তিন চারজন মিলে সাহায্য করছে।

দেখে মনে হলো অবস্থা বেশ গুরুতর। কিন্তু খটকা লাগলো তখন যখন রোগীকে যারা সাহায্য করছে তাদের ডাক্তার বা নার্স কম পুলিশ বেশি মনে হলো। চারপাশে খেয়াল করলাম তখন, ছাড়া কয়েকটা জটলা, বেশ কিছু পুলিশের গাড়ি এবং বেশ অনেকজন পুলিশকেও দেখলাম।

স্টকহোমে কিছু এলাকা আছে যেগুলো পরিষ্কারভাবেই মুসলিম অধ্যুষিত। মধ্যপ্রাচ্য, আরব এবং আফ্রিকা থেকে আসা মানুষ সেখানে বেশি থাকে বলেই আমরা মজা করে এলাকাগুলোকে ‘ভ্যালি অব আরব’ অথবা ‘খেজুর এলাকা’ বলি। ওই এলাকাটাও সেই ভ্যালি অব আরবের কাছাকাছি একটা এলাকা। আমরা জানি, ওই এলাকাগুলো একটু অপরাধপ্রবণ।

গতরাতে দেখে বোঝাই যাচ্ছিল যে বেশ খারাপ কিছু হয়েছে অথবা হতে যাচ্ছে! কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কিছু পুলিশ ভীষণ দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো, কিছু পুলিশ গাড়িতে উঠে সেইভাবে চাকায় আওয়াজ তুলে টান দিয়ে চলে গেল, যেইভাবে সাধারণ কোন অ্যাকশান মুভিতে দেখা যায়।

বাসস্টপেজে আরো কিছু মানুষ ছিল, আমরা সবাই ভেতর দিকে সেটে দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর অ্যাম্বুলেন্সটা সরে গেলে, রাস্তা পরিষ্কার হলে বাস আসলো। আমরাও বাড়িতে ফিরলাম। বাসায় ফিরেই মনে হলো- দেখিতো টিভিতে কিছু দেখায় কিনা, কোন ব্রেকিং নিউজ!

পরে মনে হলো, পথে আমি একটাও মিডিয়ার গাড়ি অথবা ক্যামেরা বুম নিয়ে দৌড়াদৌড়ি দেখিনি। আজকেও অনলাইন পেপার পত্রিকা কোথাও এ সংক্রান্ত কোন খবর নাই। ইংরেজি অনলাইন দ্যা লোকালের টপ নিউজ হলো বসন্তের ফুল নিয়ে একটা স্পেশাল! গতরাতে ওখানে দাঁড়িয়ে মনে পড়ছিল, সারা দিনের সোয়াট কাহিনী, এয়ারপোর্টে বোমা বিস্ফোরণ ইত্যাদি।

কিছুদিন আগে ভ্যালি অব আরবের একটা অংশে গ্যাং ওয়ারে দু’জন মারা যান, তার প্রতিশোধ হিসেবে বাসায় ঢুকে মেরে ফেলা হয় আরো দু’জনকে। এই ঘটনাটি প্রায় এক সপ্তাহ পরে তদন্ত করে পাজেল মিলিয়ে তারপর মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয় এবং এমনভাবে যেটা জেনে পাবলিক আতংকিত না হয়ে আশ্বস্ত হয়!

বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে আসলে কিছু বলতে ভয়ই লাগে! ফেসবুক জুড়ে বিখ্যাত সব সাংবাদিকরা আছে। যারা অনেকেই ভাবেন তাদের জানা বোঝা শেখা শেষ! সমালোচনা করা এবং নেয়া এই দুইয়ের তীব্র ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক দেখা যায় আমাদের মাঝে। ক্ষুদ্র সময় হতে পারে কিন্তু এই পেশাকে আমিও দেখেছি এবং জেনেছি খুবই কাছ থেকে।

এখানে ‘পাবলিককে খাওয়ানো’ এই শব্দটা খুব চালু! শব্দটা যতটা শুনতে কুৎসিত ততটাই কাজেও কুৎসিত। এই খাওয়ানোর নামে যা খুশি তাই লেখা, যা খুশি তাই বলা, যখন তখন ব্রেকিং! এগুলোর যেন অলিখিত সার্টিফিকেট পাওয়া হয়ে যায়। তাতে নিজের দেশের ইমেজ কি দাঁড়াচ্ছে, তা ভাবার সময় কোথায়!

এখানে ক্লাসে যখন সবাই শোনে আমি সাংবাদিক, আমাকে সবাই প্রশ্ন করে তোমাদের প্রেস কি স্বাধীন? আমি চিন্তায় পড়ে যাই। পাল্টা প্রশ্ন করি প্রেসের স্বাধীনতা বলতে তোমরা কি বোঝাও? তাদের ধারণা বাংলাদেশে সাংবাদিকদের পাইকারি হারে মেরে ফেলা হয়। সরকারের কোন সমালোচনা করলে তাদের গুম করে দেয়া হয়। আমাদের দেশ সন্ত্রাসীর দেশ! পাকিস্তানের মত আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোক সন্ত্রাসী! তাই সাংবাদিকরা দুইদিক থেকেই ভীষণ ভার্নারেবল অবস্থায় থাকেন।

নিজের দেশের এই যে চিত্র এটা আমরাই তৈরি করেছি। আমরা সাংবাদিকরা। বোমা হামলার সচিত্র প্রতিবেদন আমরা লাল কালির হেডলাইন করি। কিন্তু আদালতের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় যখন বিচার চলে সেই নিউজ ছোট হতে হতে নাই হয়ে যায়। আবার যেদিন অপরাধীর ফাঁসির সময় আসে আমরা আবার বিপুল উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আর বাইরের দুনিয়া দেখে আমরা কত অসুস্থ একটা জাতি, মৃত্যু যত কুৎসিত হবে আমাদের নিউজ তত মূল্যবান হবে!

কোন পজিটিভ নিউজ নাকি পাবলিক খায় না। অহেতুক টুইস্ট না করলে নিউজ পার্সন হিসেবে নিজের ঠিক দাম বাড়ে না। মনে আছে গত বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরুর ঠিক আগে, দক্ষিণ এশিয়ার যত দেশ অংশ নিয়েছিল সে সব দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেলিফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। সেই হিসেবে তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকেও ফোন দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।

সিম্পল একটা বিষয়। যদিও ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক অনেক বিষয় জড়িত, কিন্তু ওই বিশেষ কলটি ক্রিকেট দলকে শুভেচ্ছা জানাতেই ছিল। পিএম অফিসের প্রেস রিলিজ দেখে আমার এবং স্পোর্টস টিমের এটাই মনে হয়েছিল।

কিন্তু আমার তৎকালীন এডিটর সেই নিউজকে টুইস্ট করে সেখানে রাজনীতি, তিস্তা নানা বিষয় ঢুকিয়ে মোদী-হাসিনার টেলিফোন আলাপ বানিয়ে ফেলেন। বিষয়টা ঠিক হচ্ছে না বলে আর্গুমেন্ট করায় আমি হলাম বেয়াদব, কমনসেন্সহীন! দুধের শিশুরাও বোঝে ক্রিকেট একটা উছিলা মাত্র। মোদী আসলে পলিটিক্যাল ইস্যুতে কথা বলতেই ফোন দিয়েছিলেন! সেটা ছিল রাতের শেষ নিউজ। ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট’, তাই সারারাত স্ক্রলেও সেই নিউজ চলল।

পরদিন পিএম অফিস থেকে ধাতানি আসার আগ পর্যন্ত তেমনটাই চলছিল। স্বাধীনতা মানে যদি হয় যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা তবে হ্যাঁ, আমার দেশের প্রেসও পরাধীন! কিছু জিনিস আছে যেটা প্রকাশের তুলনায় নিয়ন্ত্রণ করতে জানাটা বেশি জরুরি, আবেগ এবং স্বাধীনতা তেমন দুটি বিষয়।

লেখক: প্রবাসী ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট

এই লেখকের আরও পড়ুন

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!