ইউরোপের দেশগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে অসাধারণ! সুইডেনও এর বাইরে নয়। বাস, ট্রাম, কমিউটার ট্রেন ছাড়াও মেট্রো সার্ভিস, যা মাটির নিচে তিনটি স্তরে চলাচল করে।
Published : 22 Nov 2016, 04:49 PM
তবে দেশটির প্রধান শহর স্টকহোমের বাইরে মেট্রো যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। সেটা মূল আলোচনার বিষয় না। আগের একটি লেখায় বলেছিলাম, পৃথিবীর দীর্ঘতম শিল্পকর্মের প্রদর্শনী বলা হয় এই মেট্রো স্টেশনগুলোকে। আজ সেটা নিয়েই লিখবো।
স্টকহোমের মূল কেন্দ্র টি-সেন্ট্রাল থেকে বিভিন্ন দিকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সাবওয়ে বা মেট্রো সিস্টেম। এর একশটি স্টেশনের মধ্যে ৫৩টি মাটির উপরে আর ৪৭টি মাটির নিচে।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে ট্রাম চালু হলেও মেট্রো যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয় ১৯৫০ সালের শেষ দিকে। সেই সময় সুইডেন বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন সমস্যা কাটিয়ে উঠতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ঠিক সেই পরিস্থিতিতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সোশাল ডেমোক্র্যাট সরকার সিদ্ধান্ত নেয়,ইউরোপের অন্যান্য দেশের মত শিল্পকলাকে অভিজাত শ্রেণির ড্রইং রুম,আর্ট গ্যলারি আর বড় বড় রেস্টুরেন্টের দেয়াল থেকে তুলে এনে সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার।
সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই স্টেশনগুলোকেই এক একটি শিল্পকলার প্রদর্শনী হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কখন কিভাবে সেই প্রক্রিয়া শুরু হলো এবং সেজন্য কী উপায়ে শিল্পীদের খুঁজে প্যানেল করা হলো, সে ইতিহাস সহজেই পাওয়া যায়।
মেট্রোর লাইনগুলো লাল,সবুজ এবং নীল-তিনটি রং দিয়ে ম্যাপে দেখানো হয়। লাল লাইন সবচে পুরনো এবং কম গভীর। নীল লাইন সবচে নতুন এবং সবচে গভীর। সেন্ট্রাল স্টেশন এবং এর আশেপাশের স্টেশনগুলো মাটির নিচে এবং দূরেরগুলো বেশিরভাগই মাটির উপরে।
কিছু কিছু স্টেশনে এই লাইনগুলো একটা আরেকটাকে ক্রস করেছে। লম্বা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে মাটির নিচে নামতে নামতে চারপাশের পাথুরে দেয়ালের গায়ে রং-বেরং-এর চিত্র ফুটে ওঠে। আবার কোথাও কোথাও কিছুই নেই, কেবলই খাপছাড়া পাথুরে দেয়াল। তখন বোঝা যায়,শিল্পকলা আসলেই জীবনের সাথে কতটা জড়িয়ে থাকে।
এরপরে অবশ্য আরো অনেকবার গিয়েছি,তখন ঘুরে ঘুরে দেখেছি এমাথা থেকে ওমাথা। বন-জঙ্গল পার হয়ে কী করে নগর সভ্যতার বিকাশ হলো সেটা চিত্রিত ছিল সেই লাল-সবুজ পটভূমিতে। এছাড়াও সুইডেনের সবচেয়ে বড় পশু ‘এলি’ যাকে এরা বলে 'বনের রাজা',তার একটি রেপ্লিকা। ঐতিহ্যবাহী সুইডিশ বাড়ির রেপ্লিকা দেখা যাবে পাথরের দেয়ালের মাঝে।
রঅদহুসেত এ নামলে মনে হবে কোন প্রাচীন দূর্গে চলে এলাম !পুরো স্টেশনটাকেই একটি ভগ্নদূর্গের আদল দেয়া হয়েছে। গাঢ় নীল ছাদ এবং চারপাশের দেয়াল পার হয়ে এক পাল তোলা ভাইকিং নৌকা দেখতে পাবেন ফ্রিদেমসপ্লনে। পাশেই ভাইকিং সভ্যতার আরেক নিদর্শন বিশাল এক অ্যাঙ্কর।
টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির স্টেশনটার নাম 'টেকনিসকা হগসকোলান'। সেখানে টেকনোলজি এবং মহাজাগতিক বিভিন্ন বস্তু ও সাংকেতিক চিহ্নের পাশাপাশি এক মাথায় ছাদে ঝুলানো আছে এক লাল আপেল। এটাই একমাত্র বস্তু যা আমার বোধগম্য। আর আমি ওটার নাম দিয়েছি ‘নিউটনের আপেল’।
এরকম অনেক রেপ্লিকা দেখেছি বিভিন্ন স্টেশনে। কোথাও আছে রুটির ঝুড়ি, তো কোথাও হোস্তের (শরত)ঝুড়ি। শরতে খাওয়া হয় এমন ফল এবং ফুলে সাজানো এরকম ঝুড়ি দোকানেও কিনতে পাওয়া যায়। মধ্য সামারে একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হলো 'মিডসামার ফেস্টিভাল'। সেই উৎসবে ব্যবহৃত মাথার গোল মুকুট এবং এ সংক্রান্ত আরও অনুষঙ্গ দেখা যাবে 'মিডসোম্মারস্ক্রানসেন' স্টেশনে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পকর্মের স্রষ্টার নাম এবং এর ব্যাখ্যা থাকলেও সুইডিশ না জানার কারণে শুরুতে বুঝতাম না।
ট্রান্সলেটরের সাহায্য নিয়ে অর্থ হয়তো পেতাম কিন্তু মর্মার্থ পেতে হলে এদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। অথবা চলতি ট্রেনে বেখেয়ালে চোখে পড়া কোন জিনিস হয়তো,পরে জানতে পারা কোন বিষয়ের সাথে রিলেট করলেন। সেটাও এক ধরনের মজা। আর সেটা যদি হয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক কোন বিষয়, তবে তো কথাই নেই !
এই যেমন কিছুদিন আগে হক্যেরিঙ্গেন যাচ্ছিলাম। ওদিকটায় মেট্রো মাটির উপরে উঠে এসেছে। স্যান্ডসবোরি পার হতে হতে ট্রেনের জানালা দিয়ে চোখ পড়লো সারি সারি কবর। এত পুরনো,এত সবুজ,এত দীর্ঘ আর এত সুন্দর যে মনোযোগ না আটকে পারেই না !
পরে একদিন অন্য কাজে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখলাম ওদের ঘোষণা করা একটা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আছে স্টকহোমে। গুগল ম্যাপে খুঁজে পেলাম সেই গ্রেভইয়ার্ড !সেটার বিস্তারিত না হয় আরেকদিন বলবো।
লেখক: প্রবাসী ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট