সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে তাই মাঝে মাঝেই আমি এবং আমার বর বেরিয়ে পড়ি। অল্প দূরত্বের জায়গাগুলোতে একবেলা বেড়িয়ে আসি। অনেক সময় মেট্রো, কমিউটার ট্রেন বা লাইটার ট্রেনে চেপে বসি। শেষ স্টপেজে গিয়ে ঘুরি-ফিরি, কফি খাই- তারপর চলে আসি। বলা হয়, স্টকহোমের মেট্রোলাইন পৃথিবীর দীর্ঘতম 'এক্সিবিশন'! কেন? সেটা আরেক গল্প, আপাতত কিছুদিন আগে ঘুরে আসা ভাইকিং গ্রামের কথা বলবো।
স্টকহোম মূল শহরের উত্তর পূর্বদিকে একেবারে সমুদ্রের তীরের শহর নর্তালিয়ে। পুরো স্টকহোমেই, শহরের ভেতর দিয়ে চলে গেছে অনেক হ্রদ এবং লেক। তবে ম্যাপে যদি নর্তালিয়ের দিকে তাকাই তবে দেখা যায়, নীলপানি একেবারে জালের মত বিছিয়ে আছে। এক রোদেলা শনিবার হঠাৎই মনে হলো, গ্রীষ্ম শেষ হতে যাচ্ছে তবু নর্তালিয়ে ঘুরে আসা হয়নি। যেই ভাবা সেই কাজ! বেরিয়ে পড়লাম দুজনে।
নর্তালিয়ে তো আসলাম, এখন কী করা যায়? কোথায় যাওয়া যায় ? বাসে বসেই অনলাইনে দেখছিলাম নর্তালিয়ার কাছেই একটি গ্রাম আছে, ভাইকিং ভিলেজ যেটাকে পর্যটকদের জন্য সবচে' বেশি রেকমেন্ড করা হয়েছে। বাসস্টপেজের পেছনেই নদী এবং নদীর তীর ধরে গেলেই পুরনো শহর। বেশ কিছু ডক আছে নৌকা নোঙর করার। পার্ক, গাছপালায় সাজানো ছিমছাম শহরতলি। আমরা নদীর তীর ধরে পুরনো শহর ঘুরে ফিরে, ঠিক করলাম 'ভাইকিং ভিলেজ' যাব। আর তার জন্য আরেকটি বাসে উঠতে হবে। বাসটি নর্তালিয়ে থেকে স্টকহোমেই আরেকটা 'কমিউনে' যাবে।
মূল প্রবেশের ফটক পেরিয়ে বনের ভেতর দিয়ে খানিকক্ষণ চলার পর গ্রামে ঢোকার সদর দরজা। দরজা পার হতেই সামনে পড়বে গ্রামের দৃশ্য আর প্রবেশপথের পাশেই বোর্ডে টানানো গ্রামটি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য। ভাইকিং গ্রাম মূলত একটি 'ওপেন মিউজিয়াম'। তিনদিক থেকে সুইডেনের অন্যতম বড় লেক এরিক। লেক ঘিরে রাখা জায়গাটিকে ভাইকিং আমলের একটি ছোট্ট গ্রামের মত করে তৈরি করা হয়েছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে একসময় যে জলদস্যুদের বিচরণ ছিল- তাদের জীবনযাত্রা উপস্থাপনের একটা প্রয়াস।
গ্রামটি দেখলে মনে হবে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা গ্রাম। কিন্তু ঘোরাঘুরি করলে বোঝা যায় খুব যত্ন করেই এভাবে রাখা হয়েছে। গ্রামের মধ্যে কিছু মানুষ সেই পুরানো ভাইকিং আমলের কাপড় পরে ঘোরাঘুরি করছিল। আসলে ওরাই গ্রামের দেখাশোনা করে। দর্শনার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
আমরা যেদিন গিয়েছিলাম পরদিন শিশুদের একটা উৎসব ছিল, তারই প্রস্তুতি চলছিল। গ্রাম প্রধানের বাড়ি ছাড়াও গ্রামে আছে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, রান্নাঘর, শোবার ঘর ইত্যাদি। ঘরের ভেতর কাঠের মাচায় ভাল্লুকের চামড়ার বিছানা পাতা। যেন এক্ষুণি কেউ এসে শুয়ে নাক ডাকতে শুরু করবে। আছে ভাড়ারঘর, তাঁতঘর, ফসলের ঘর, ওয়ার্কশপ যেখানে নৌকা বানানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়া ও বাসনকোসন ইত্যাদি বানানো হয়।
ডানদিকে জঙ্গল আর গ্রামের সীমানার ঘরগুলোকে স্টেজ বানিয়ে ফেলা যায়। পরদিন শিশু উৎসবের জন্য সেখানে সাজসজ্জা চলছিল। আরেকটু সামনে গেলে, বেড়া দেওয়া একটা গোল জায়গা। সেখানকার গাইডের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই জায়গায় তারা বিভিন্ন ওষুধি গাছ লাগায়। ওরকম আরো একটি বাগান আছে গ্রামের আরেক প্রান্তে।
বাঁ দিকে পানির ওপরে কাঠের মাচা করে বসার জায়গা। মাঝে টেবিল পাতা আর পাশে বার্বিকিউ চুলা- যেন পোড়ামাংস আর পানীয় খেতে খেতে ভাইকিংরা আলাপচারিতা নিত্যই মাতেন অথবা পরবর্তী সাগর অভিযানের পরিকল্পনা করেন। আরেকপাশে এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে পাথর কেটে কাঠের পাত বসিয়ে বানানো সিঁড়ি, নেমে গেছে পানিতে। সেখানে কাঠের ঘাট পানির তালে দুলছে।
বোঝাই যায় ভাইকিং মেয়েদের গোসলের জন্যই ওই ঘাট। গ্রামের মাঝামাঝি জায়গায় অনেকটা ফাঁকা, দুই সারি বেঞ্চ পাতা আরেক মাথায় গ্রাম প্রধানের চেয়ার পাতা। সে এক বিশাল চেয়ার! আমি বরসহ সেই চেয়ারে অনায়াসে বসে পড়লাম! গ্রাম প্রধানের চেয়ার আর সন্ধ্যার আড্ডার জায়গার মাঝে ফাঁকা জায়গায় আছে কয়েকটি টোটেম। এর মধ্যে একটি দেখে আমার হিন্দু দেবী কালীর কথা মনে হয়েছিল।
ভাইকিং ভিলেজ মোটামুটি সারা বছর খোলা থাকে। তবে শীতকালে কোন ধরনের অনুষ্ঠান থাকে না। গ্রীষ্মে বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসে অনেক ধরনের উৎসব চলে। কখনো কখনো সারারাত চলে বিভিন্ন আয়োজন। কেউ চাইলে রাতে থেকে যেতে পারে গ্রামে তবে ঘুমাতে চাইলে সে ব্যবস্থা নিজের করতে হবে।
গ্রামটা একটু ভেতরে বলে বাস থেকে নেমে কিছুটা হাঁটতে হয়। গাড়ি নিয়েও যাওয়া যায়, মূল ফটকের বাইরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা আছে। কোন ধরনের প্রবেশ মূল্য নাই, তবে মিউজিয়াম থেকে ২০০ থেকে ২৫০ ক্রোনার বিনিময়ে গাইডের ব্যবস্থা করা হয়। তবে তার জন্য গ্রুপের সদস্য চল্লিশ জনের বেশি হতে হয়।
গ্রামের তিনদিকেই পানি এবং তীরের পাথরগুলো ভীষণ পিচ্ছিল তাই একটু সাবধান থাকা ভালো। লেকের বাতাসে গ্রাম ঘুরে দেখতে দেখতে ক্ষুধার্ত বা তৃষ্ণার্ত হলেও কিছু করার নাই, কাছে পিঠে কিচ্ছু পাওয়া যাবেনা। কাছাকাছি খাবারের যে দোকান, সেটাও বাসস্টপেজের কাছে। তাই সঙ্গে করে কিছু খাবার বিশেষ করে পানি নিয়ে নেয়া ভালো।
লেখক: প্রবাসী ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট