ভাষা না জানার কারণে সুইডেনে আসার পর অনেক দিন পর্যন্ত আমার জগত নিজের ঘর ও স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
Published : 18 Sep 2016, 06:07 PM
ইউরোপের রাষ্ট্র সুইডেনে বসবাসরত ৯ মিলিয়ন লোক সুইডিশ ভাষায় কথা বলে। এটা উত্তর জার্মানির একটা ভাষা, অনেকটা ডাচ ও নরওয়েজিয় ভাষার মতো।
সম্প্রতি ‘ইন্টেন্সিভ সুইডিশ ফর প্রফেশনালস’ নামে একটা স্কুলে সুইডিশ ভাষা শিখছি। শুরুতে সব মনোযোগ ছিল সুইডিশ ভাষাটাকে চারপাশ থেকে বোঝা। একারণেই ক্লাসের অন্য সবার সঙ্গে ঠিক মেশা হয়ে উঠতো না। এখন ভাষার আকার প্রকার কিছুটা বুঝতে পারি। তাই সহপাঠীদের সঙ্গেও ভাব বিনিময় চলে বেশ।
স্কুলে ইদানিং অনেক গ্রুপ সেশন থাকে। ছোট ছোট গ্রুপে ভাঙা ভাঙা শব্দে ডিসকাশন চলে। বাচ্চাদের মতো অনেক কষ্টে খুঁজে পাওয়া শব্দ জোড়া দিয়ে চলে মনের ভাব প্রকাশ।
গেল সপ্তাহে স্কুলে আমাদের আলফ্রেড নোবেল সম্পর্কে পড়ানো হয়েছে। আক্ষরিকভাবে বলা চলে সেটা ছিলো শিশুদের আলফ্রেড নোবেল। পড়ানো শেষ হলে, নিজেদের মধ্যে অল্প বিস্তর আলোচনা শেষে আমাদের বাড়ির কাজ দেওয়া হলো, ‘নিজের দেশের কোন এক বিখ্যাত ব্যক্তির কথা সবাইকে বলা।’
সেটাও ওই শিশুতোষ সুইডিশ ভাষায় বলতে হবে। যার কথা বলবো, তার নাম উল্লেখ করা যাবে না। অন্যরা শুনবে এবং অনুমান করবে কার কথা বলা হচ্ছে। একারণে দুই একটা বিষয় ইংরেজিতে ব্যাখ্যা করা যাবে, তবে খুব বেশি নয়।
অবশেষে সেই প্রেজেন্টশনের সময় এলো। গ্রুপ ভাগ করে দেওয়া হলো। আমাদের গ্রুপে আমি ছাড়া একজন ইরানি মেয়ে, একজন ভারতের মেয়ে ও একজন দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়ে ছিল। প্রথমেই ইরানের নাসিম বলল তার দেশের মানবাধিকার কর্মী আইনজীবী নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদির কথা। একমাত্র আমিই উত্তর দিতে পেরেছিলাম।
এরপর ভারতীয় রূপাল বলল মহাত্মা গান্ধীর কথা। আমি এবং নাসিম দুজনেই পেরেছিলাম সঠিক উত্তর দিতে।
এরপর আমার পালা। আমি বললাম, মানে চেষ্টা করলাম বলার। আমাদের জাতির জনককে চেনানোর চেষ্টা করলাম। যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটির অর্থ তাদের ভেঙে ভেঙে বললাম, আমার শিক্ষক আরো কিছু প্রশ্ন করলেন বিস্তারিত বোঝার জন্য। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা, বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের কথা বললাম।
এতকিছু বলার পরেও কেউ চিনতে পারলো না তাকে। রূপাল গুগলে দেখে উত্তর দিল, ‘শেখ মুজিব!’।
সে বলল যে আগে কখনোই নাকি তার কথা শোনেনি। আমি বললাম, “আমি ভেবেছিলাম তুমি বলতে পারবে রূপাল। শত হলেও আমরা প্রতিবেশী! শত শত বছর একসঙ্গে থাকার ইতিহাস আমাদের!”
ও জবাব দিল আসলে ইতিহাস সম্পর্কে তার যথেষ্ট ধারণা নেই। আমি বললাম, “ইতিহাসের যে যায়গা থেকে তুমি মহাত্মা গান্ধীকে তুলে এনেছো তার আশপাশে অনেক বাংলাদেশিও ছিলেন। তখন অবশ্য তারা বাংলাদেশি হয়ে ওঠেননি। সেখানেও শেখ মুজিব ছিলেন। যদিও অত বড় নেতা তখনও হননি, তার বয়স অনেক কম ছিল তখন। হয়তো তখন তিনি তোমার বয়সি ছিলেন।”
শেখ মুজিবের পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়েছিল, শুধু দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন তার দুই মেয়ে। তার বড় মেয়ে এখন আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী- আমি জানালাম।
এবার নাসিম নড়েচড়ে বসলো। তারপর যখন আমি নামটা বললাম ‘শেখ হাসিনা’, তখন সবাই চিনতে পারলো। আমার দেশের পিতাকে না, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতাকে!
এরপর থেকেই মনের মধ্যে এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। এটা ঠিক যে পৃথিবীর ম্যাপে অনেক কষ্টে খুঁজে পাওয়া বাংলাদেশকেই অনেকে চিনতে পারে না। কেউ প্রশ্ন করে সেটা কোথায়? ভারতে? কেউ প্রশ্ন করে সেটা কি থাইল্যান্ডের আশপাশে?
এই যখন বাংলাদেশ বিষয়ে মানুষের জ্ঞান, তখন সেই দেশের ইতিহাস সম্পর্কেও আসলে বাইরের মানুষ কতটা জানবে সেটাই প্রশ্ন থাকে।
লেখক: ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট