ময়নাতদন্তে আসা আত্মহত্যার প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে আদালতে হত্যা মামলার পর ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারলে তার কাছেই ‘সব কিছু’ বলবেন তিনি।
Published : 24 Nov 2016, 03:46 PM
দিয়াজের মৃত্যু ঘিরে নানা প্রশ্ন-সন্দেহ
দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন: ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন
জাহেদা আমিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম আদালতে মামলা করার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, “কারও করুণা চাই না। ন্যায় বিচার, সত্য বিচার চাই। আমার মেধাবী ছেলে দেশের সম্পদ ছিল। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই। যা বলার উনাকেই বলব। আর কাউকে কিছু বলব না।”
চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিবলু কুমার দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী জাহেদার মামলা মামলা গ্রহণ করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
গত রোববার রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বাসায় ঝুলন্ত অবস্থায় তার লাশ পাওয়ার পর সোমবার তার ময়নাতদন্ত হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
এ ঘটনার পর তার অনুসারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দাবি করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের দরপত্র নিয়ে জটিলতার জেরে দিয়াজকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
এরই মধ্যে বুধবার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজ আত্মহত্যা করেছেন।
পরিবার ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে হত্যা মামলা দায়ের করে।
মামলায় আসামি করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু, কর্মী রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরাব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমানকে।
মামলার পর আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও দিয়াজের পরিবারের সদস্যদের চোখেমুখে আতঙ্ক দেখা যায়।
সাংবাদিকরা জানতে চাইলেও দিয়াজের বোন জুবায়েদা সরোয়ার চৌধুরী প্রথমে আসামিদের নাম বলতে অস্বীকৃতি জানান, এসময় দিয়াজের মা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জুবায়েদা পরে বলেন, “আপনারা সাংবাদিক। আসামি কারা থাকতে পারে, সেটা আপনারা জানতে পারবেন।
“যারা আমাদের বাসায় হামলা করেছে, যারা চাঁদা দাবি করেছিল, যারা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আসার আগে থেকেই বলে দিয়াজ ‘আত্মহত্যা’ করেছে তারাই আসামি।”
জুবায়েদা বলেন, “আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা আওয়ামী পরিবারের সন্তান। প্রধানমন্ত্রীর কাছেই আমাদের আবেদন।”
দিয়াজের মৃত্যুর একদিন পর তার বাসায় গিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে টেলিফোনে দিয়াজের মাকে কথা বলিয়ে দিয়েছিলেন।
তখন সুষ্ঠু তদন্তে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে জাকির বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীও ঘটনাটি জানেন।
ঘটনার পর থেকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ করেন দিয়াজের বোন।
“পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক। পরিবারের সদস্যরা আসার আগেই তারা লাশ নামিয়ে ফেলতে চায়। থানায় যাওয়ার পরও মামলা নেয়নি। তাই বাধ্য হয়েই আদালতে মামলা করেছি।”
পরে এক সংবাদ সম্মেলনেও একই অভিযোগ করেন মিয়াজের মা, বোন ও তাদের আইনজীবী।
চাঁদা দাবি, হামলা ও হত্যার হুমকির অভিযোগ মামলায়
জাহেদা চৌধুরীর করা মামলার এজাহারে দিয়াজের কাছা চাঁদা দাবি, বাসায় হামলা ও হত্যার হুমকির কথা উল্লেখ করে এরই ধারাবাহিকতায় দিয়াজকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
এজাহারে বলা হয়- আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে দিয়াজের মা’র কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে আসছিল। চাঁদা না দিলে দিয়াজকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়।
“চাঁদা না দেওয়ায় ৩১ অক্টোবর রাতে বাসায় প্রবেশ করে ভাংচুর ও লুটপাট করে। এ নিয়ে হাটহাজারী থানায় মামলা করতে গেলে আলমগীর টিপুর নাম বাদ দিয়ে ২ নভেম্বর মামলা নেয়।”
ওই মামলার পর আসামিরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে দিয়াজের মা’কে মামলা তুলে নিতে বলে এজাহারে বলা হয়। না নিলে ‘দিয়াজকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলবে’ বলে এমনও হুমকি দেয় আসামিরা।
মামলায় বলা হয়- হত্যাকারীরা আলামত গোপনের জন্য দিয়াজকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে বিছানার চাদর দিয়ে ঝুলিয়ে রেখে বেলকনি দিয়ে পালিয়ে যায়।
“দিয়াজের কক্ষের উত্তর পাশে বেলকনির দরজা খোলা ছিল। আসামিরা বেলকনি দিয়ে দুই তলা থেকে নামার জন্য পাশের নির্মাণাধীন ভবনের কাজে ব্যবহৃত মই ব্যবহার করে।”
দিয়াজকে ‘হত্যার’ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এজাহারে বলা হয়, “আসামিরা সুকৌশলে দিয়াজের কক্ষে ঢুকে তাকে শোবার ঘরের খাটের উপর ফেলে দুই হাত ঝাপটে ধরে।
“গলার বাম পাশে কিছু দিয়ে সজোরে পেঁচানো হয়। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করায় দিয়াজের হাতে ও পায়ে আঘাতের চিহ্ন সৃষ্টি হয়।”
হত্যার রহস্য ও আলামত লুকাতে বিছানার চাদর গলার ডান পাশে পেঁচিয়ে বামপাশে ঢিলা গিট দিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলানো হয় বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।
“গ্র্যাভিটি নিয়মানুসারে গলার ডানপাশে গুরুতর জখম হওয়ার কথা। কিন্তু জখম গলার বামপাশে। এতে অনুমেয়, লাশ হত্যার পর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
এজাহারে বলা হয়- দিয়াজের উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি অথচ ঘরের ফ্যান থেকে বিছানার উপরের অংশের উচ্চতা (যেখানে লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল) পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। দিয়াজের পা বিছানার ওপর ছিল। হাত ছিল মুষ্টিবদ্ধ।
বাদীপক্ষের আইনজীবী জানান, আদালত মামলা গ্রহণ করে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে সাক্ষীদের ১৬১ ধারায় জবানবন্দি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
“জবানবন্দি নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে ঘটনার বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।”