দিয়াজের মৃত‌্যু ঘিরে নানা প্রশ্ন-সন্দেহ

নিজের ঘরে ঝুলন্ত ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী কি আত্মহত‌্যা করেছেন, না কি তিনি হত‌্যাকাণ্ডের শিকার, তা দুদিনেও স্পষ্ট হয়নি।

মিঠুন চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব‌্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2016, 02:54 PM
Updated : 27 Dec 2016, 01:18 PM

তার পরিবার হত‌্যার অভিযোগ করলেও কোনো মামলা করেনি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছেন তারা।

পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর আত্মহত‌্যার ধারণার কথা জানালেও তারাও অপেক্ষা করছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন‌্য।

গত রোববার রাতে লাশ উদ্ধারের পর সোমবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দিয়াজের ময়নাতদন্ত হয়েছে। তবে এখনও প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেননি চিকিৎসকরা।

দিয়াজের পরিবার জানিয়েছে, মৃত‌্যুর পর থেকে তার মোবাইল ফোনটি পাওয়া যাচ্ছে না। এটি উদ্ধার করা গেলে কোনো সূত্র বেরিয়ে আসত।   

পরিবারের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মাণকাজের দরপত্রসহ কয়েকটি কারণে ‘ষড়যন্ত্র’ করে হত্যা করা হয়েছে দিয়াজকে।

দিয়াজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‌্যালয়ে উপাচার্য অধ‌্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এই ছাত্রলীগ নেতার মৃত‌্যুর ঘটনাটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ‌্যমে তদন্ত চাইছেন।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন মঙ্গলবার দিয়াজের বাসায় গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। এই মৃত‌্যুর সুষ্ঠু তদন্তে প্রশাসনকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।

বিশ্ববিদ‌্যালয়ের দুই নম্বর ফটকের ভাড়া বাসার সিলিংয়ের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় রোববার রাতে দিয়াজের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

দিয়াজ (২৭) ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‌্যালয় কমিটির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক।

ফটিকছড়ির দিয়াজ চট্টগ্রাম ছাত্রলীগে সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী পক্ষের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ক‌্যাম্পাসের ওই বাসায় মাসহ থাকতেন দিয়াজ। তার বাবা-মা দুজনই বিশ্ববিদ‌্যালয়ের কর্মচারী। বিচ্ছেদ নেওয়া এই দম্পতির তিন মেয়ে ও দুই ছেলেন মধ্যে দিয়াজ দ্বিতীয়।

বিশ্ববিদ‌্যালয় ছাত্রলীগের কর্মীরা জানায়, দিয়াজ সংগঠনের নেতাদের মধ‌্যে অনেকের চেয়ে পরিশীলিত ছিলেন। তিনি বিতর্ক প্রতিযোগিতা করতেন। বাংলাদেশে ব‌্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তিনি ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ‌্যালয়ের সভাপতি হওয়ার আশায় সেখানে যোগ দেননি।

মোবাইল ফোনের হদিস নেই

দুই নম্বর গেইট এলাকায় চারতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় ভাড়া বাসা থেকে যখন দিয়াজের লাশ উদ্ধার করা হয়, তখন মোবাইলটি পাওয়া যায়নি।

দিয়াজের বোনের স্বামী সরওয়ার আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তার মোবাইলটা পাওয়া গেলে অনেক কিছু জানা যাবে।

“যে ঘরে দিয়াজের লাশ পাওয়া গেছে, সেখানে তার চশমাটি ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেছে। খাটের নিচে রক্তের দাগ আছে। দুটি কাপড়ের টুকরোও পাওয়া গেছে। কক্ষে সেগুলো ওভাবেই রাখা আছে।”

দিয়াজের মামা রাশেদ বিন আমিন চৌধুরী বলেন, দিয়াজের বাসার পেছনেই মই পাওয়া গেছে। ব্যালকনির রেলিংও ভাঙা।

লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ দিয়াজের বাসার মূল দরজা ও কক্ষের দরজা বন্ধ পায়। নিজের কক্ষের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল দিয়াজ।

দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর কবর

দিয়াজের বন্ধু বিশ্ববিদ‌্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটি মহল আত্মহত্যার কথা প্রচার করছে। এটা হত্যা।

“দিয়াজের পা খাটের উপর এবং হাত মুষ্টিবদ্ধ ছিল। তার জিহ্বাও ছিল মুখের মধ্যে। বাইরের পোশাক পরা ছিল সে।”

পুলিশ যখন লাশ উদ্ধার করছিল, তখন দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ওই বাসায় সামনে জড়ো হয়ে বিশ্ববিদ‌্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপু এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল।

হত‌্যার অভিযোগ করলেও মামলা না করার বিষয়ে ভগ্নিপতি সরওয়ার বলেন, “আসলে পরিবারের সদস্যরা এখনো বসে আলোচনা করার সুযোগ হয়নি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনও এখনো পাইনি। তবে আমরা নিশ্চিত এটা হত্যাকাণ্ড।”

মঙ্গলবার রাতেই পারিবারিকভাবে আলোচনার পর মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান সরওয়ার।

দরপত্র আর চেক ঘিরে নানা প্রশ্ন

বিশ্ববিদ‌্যালয়ের নতুন কলা ভবন ও শেখ হাসিনা হলের দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজের প্রায় ৯৫ কোটি টাকার দরপত্রকে কেন্দ্র করে গত আড়াই মাস ধরে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে হামলা-পাল্টা হামলার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে। দিয়াজের মৃত‌্যুর সঙ্গে তার যোগসূত্র রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

দিয়াজের ভগ্নিপতি সরওয়ার বলেন, “টেন্ডারসহ কয়েকটা বিষয় আছে। নানা দিক থেকে বিশাল ষড়যন্ত্র করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।”

নভেম্বরের শুরুর দিকে মেসার্স দ্য বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জিকেবিএল (জেভি) কে ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন কলা ভবন নির্মানের এবং মেসার্স মঞ্জুরুল আলম চৌধুরী ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা হলের দ্বিতীয় পর্যায়ের কার্যাদেশের জন্য মনোনীত করা হয়।

তার আগে গত ২৯ অক্টোবর ক্যাম্পাসের দুই নম্বর গেট এলাকায় দিয়াজের বাসাসহ ছাত্রলীগের চার নেতা-কর্মীর বাসায় হামলা ও লুটপাট চালানো হয়।

অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর টিপুর অনুসারীরা এ হামলা চালায় বলে অভিযোগ আছে। তবে দিয়াজ ও টিপু দুজন মেয়র নাছিরের অনুসারী।

সোমবার ক্যাম্পাসে দিয়াজের জানাজায় অংশ নিতে গেলে তার অনুসারীরা নাছিরের সামনে বিক্ষোভ দেখায়।

সহসভাপতি মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাসায় ভাংচুরের পর দিয়াজের মা থানায় গেলে মামলা নেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও ছিল নিরব।

“শেষ দিকে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে দিয়াজ সক্রিয় ছিল না। সোমবার চাকরির খোঁজে তার ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল।”

দিয়াজ ইরফান চৌধুরী

তবে আলোচিত চেকের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান দিয়াজের বন্ধু মামুন।

ভগ্নিপতি সরওয়ার বলেন, “মাস দুয়েক আগে দিয়াজ একটি চেক পেয়েছিল বলে জানায়। পরে এ নিয়ে আর কিছু বলেনি। ওই চেক সে ভাঙাতেও পারেনি। দুই দিন আগেও চার হাজার টাকা চেয়ে নিয়েছিল।”

দিয়াজের মামা রাশেদ বিন আমিন বলেন, “ঘরে ভাংচুরের পর দিয়াজ ফোন করে হাত খরচের টাকা চেয়েছিল। হামলার বিষয়ে ভিসি স্যারকেও জানাতে বলেছিল। অবশ্য ভিসি স্যারের সাথে আমার কথা হয়নি।”

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক জাকির বলেন, “টেন্ডার সংক্রান্ত কিছুর প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। প্রমাণ পেলে, প্রয়োজনে সিআইডি ঘটনার তদন্ত করবে।”

উপাচার্য ইফতেখার চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ‌্যালয়ের ভাবমূর্তি রক্ষায় ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চান তিনি।

“প্রশাসন তো আমি একা নই। আরও অনেকে আছে। আমি সৎ ভাবে কাজ করি। প্রশাসনের কোনো ভুল আছে কি না, তা সিআইডি-ডিজিএফআই বা যে কোনো সংস্থা তদন্ত করুক।”

দিয়াজের মৃত‌্যু নিয়ে নানা প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে হাটহাজারী থানার ওসি বেলাল উদ্দিন জাহাঙ্গীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। সন্দেহজনক কিছু আছে কি না সেটা তদন্তের পর বলা যাবে।”

দিয়াজের বাসায় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক

মঙ্গলবার বিকালে দিয়াজের বাসায় যান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন।

দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন জাকির। এরপর বিশ্ববিদ‌্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ কবরস্থানে দিয়াজের কবর জিয়ারত করেন তিনি।

জাকির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে তাকে যতটুকু জানি, তার আত্মহত্যা করার কথা নয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাথে কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রীও বিষয়টি সম্পর্কে জানেন।”

সরওয়ার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ফোনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দিয়াজের মাকে কথা বলিয়ে দিয়েছেন।

“প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত একজন কর্মকর্তার সাথেও কথা বলিয়ে দিয়েছেন। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে ছাত্রলীগ সব রকম সহযোগিতা করবে বলেছে।”