বছর চারেক বিরতিতে আরেকটি ক্রিকেট বিশ্বকাপ চলে এসেছে প্রায়। অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডের সেই আসরের আবহে উত্তেজনা বাড়ছে প্রতি দিন; প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে উন্মাদনা। খেলা মাঠে গড়ানোর আগে সময়ের আয়নায় ফিরে দেখা যাক আগের ১০ আসর। এর মধ্যে ১৯৯৬ সাল পুঁচকে’ এক ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ শ্রীলঙ্কার আভিজাত্যে উত্তরণের কাহিনী।
Published : 05 Feb 2015, 06:17 PM
২০১১: বাংলাদেশেও বিশ্বকাপ, শিরোপা ভারতের
২০০৭: অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক শিরোপা, বাংলাদেশের সেরা সাফল্য
২০০৩: অস্ট্রেলিয়ার টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা
১৯৯৯: অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপের জয়ের সূচনা
১৯৯২: পাকিস্তানের ক্রিকেটীয়-রূপকথা
১৯৮৭: উপমহাদেশে প্রথম বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যের সূচনা
১৯৮৩: অঘটনের তৃতীয় বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ভারত
ভারতের ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয় ছিল নিঃশব্দ ঘাতকের মতো। শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয় সেখানে সশব্দ বিস্ফোরণ। হঠাৎ ধেয়ে আসা ঝড়ে সব উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার গল্প। দিনবদলের হাওয়ায় ‘পুঁচকে’ এক ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের আভিজাত্যে উত্তরণের কাহিনী।
হ্যাঁ, টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক আগে আগে তারা অস্ট্রেলিয়ার বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপের ফাইনালে উঠে চমক দেখিয়েছিল বটে। কিন্তু ওই শ্রীলঙ্কা বিশ্বকাপে আর কত দূর যাবে! আগের পাঁচ বিশ্বকাপ মিলিয়ে সাকুল্যে জিতেছিল যারা মোটে ৪টি ম্যাচ। তাই তাদের হিসেবে রাখার মতো লোক ছিল সামান্যই। কী চমক যে অপেক্ষা করছিল তখনও! সনাৎ জয়সুরিয়া-রমেশ কালুভিথারানার ‘পিঞ্চ হিটিং’, অরবিন্দ ডি সিলভার ধ্রুপদী ব্যাটিং, চামিন্ডা ভাস-মুত্তিয়া মুরালিধরনদের চৌকস বোলিং আর সর্বোপরি অর্জুনা রানাতুঙ্গার বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব ও কোচ হিসেবে ডেভ হোয়াটমোরের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক- ট্রফি জয়ের সব উপাদানই মজুদ ছিল তাদের। বারুদে ঠাসা দলটি বিশ্বকাপে গিয়ে ঘটায় তাই বিস্ফোরণ।
টুর্নামন্টের আবহেও আলোচনার বড় অংশজুড়ে ছিল ‘বিস্ফোরণ’। সেটি আক্ষরিক অর্থেই। আর সেখানেও জড়িয়ে শ্রীলঙ্কার নাম। ১৯৮৭ বিশ্বকাপ থেকে যৌথ আয়োজনের পথে হাঁটা শুরু বিশ্বকাপের। সেবার দায়িত্ব ছিল ভারত-পাকিস্তানের, চার বছর পর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের। আর ’৯৬ সালে বিশ্বকাপ যখন ফিরল উপমহাদেশে, দুই ক্রিকেট পরাশক্তির সঙ্গে উদীয়মান শ্রীলঙ্কাকেও দেওয়া হয় আয়োজনের ভার। তাতে বড়সড় গোল বাধে টুর্নামেন্ট মাঠে গড়ানোর মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে কলম্বোয় তামিল টাইগারদের বোমা বিস্ফোরণে। সেন্ট্রাল ব্যাংকের সামনের ওই বিস্ফোরনে আহত-নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। ফলে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ শ্রীলঙ্কায় দল পাঠাতে অস্বীকৃতি জানায়। কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার আশ্বাস, আইসিসির নিরাপত্তার অনুমোদনেও মত বদলায়নি তাদের। ফলে নিয়ম অনুযায়ী গ্রুপের ওই দুটি ম্যাচে জয়ী ঘোষণা করা হয় শ্রীলঙ্কাকে।
টুর্নামেন্ট মাঠে গড়ানোর আগেই তাই কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠে যায় রানাতুঙ্গার দল।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ ‘পিঞ্চ হিটারদের' বিশ্বকাপ, শ্রীলঙ্কার বিশ্বজয়ের বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্ট শুরুর আগের বোমা হামলা, বয়কট ও ইডেন গার্ডেনসের 'জঘন্য' উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং সেমিতে দর্শকদের আরো জঘন্য আচরণের বিশ্বকাপ। কিন্তু সমান্তরালে সেটি কি বাংলাদেশের দীর্ঘশ্বাসের বিশ্বকাপও নয়! ফরম্যাটের পরিবর্তনের কারণে সেখানে খেলার সুবর্ণ সুযোগ যে ছিল বাংলাদেশের!
এই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলের সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ১২। ১৯৯২ বিশ্বকাপের পর জিম্বাবুয়ে আইসিসির পূর্ণ সদস্য হয়ে যাওয়ায় সহযোগী সদস্যদের ভেতর থেকে তিনটি দেশ পায় বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্র। ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে সেরা তিনে থাকার সুযোগ ভালোভাবেই ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাত, কেনিয়া ও নেদারল্যান্ডস পায় বিশ্বকাপের টিকেট। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হয় বাংলাদেশকে।
বিশ্বকাপে ১২ দলকে ভাগ করা হয় দুই গ্রুপে। লিগ পদ্ধতিতে সবাই সবার সঙ্গে খেলার পর সেরা চারটি করে দল উঠবে কোয়ার্টার-ফাইনালে। অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজের বয়কটের কারণে তাই খেলা মাঠে গড়ানোর আগেই শেষ আটে ওঠা নিশ্চিত শ্রীলঙ্কার। ‘এ’ গ্রুপে ভারত-জিম্বাবুয়ে-কেনিয়ার বিপক্ষেও বাকি তিন ম্যাচ জিতে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন তারা। সমান তিন জয়ে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত তাদের সঙ্গী। সঙ্গে বিবর্ণ ওয়েস্ট ইন্ডিজও। পাঁচ ম্যাচের মধ্যে দুই জয় নিয়ে কোনোমতে কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠে তারা। এর মধ্যে কেনিয়ার কাছে হারটি হয়ে আছে ক্যারিবিয়ানদের কলঙ্কতিলক।
‘বি’ গ্রুপে বোমা হামলার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, মাঠের ক্রিকেটেও ছিল না অঘটন। টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে দক্ষিণ আফ্রিকা নিজেদের ঘোষণা করে টুর্নামেন্ট 'ফেভারিট' হিসেবে। চার, তিন ও দুই জয় নিয়ে যথাক্রমে পাকিস্তান-নিউ জিল্যান্ড-ইংল্যান্ডও নিশ্চিত করে সেমি-ফাইনাল। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে ১৮৮ রান করে প্রোটিয়া ওপেনার গ্যারি কার্স্টেন গড়েন বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড।
আকাশে উড়তে থাকা এই দক্ষিণ আফ্রিকাকে মাটিতে নামিয়ে আনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ব্রায়ান লারা। তার চোখ ধাঁধানো সেঞ্চুরিতে কোয়ার্টারেই থেমে যায় প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ অভিযান। পাকিস্তান থেমে যায় ভারতের কাছে হেরে। তবে চোটের কারণ দেখিয়ে ওই ম্যাচে ওয়াসিম আকরামের না খেলাটা আজো সন্দেহের চোখে দেখেন পাকিস্তানের সমর্থকরা। সনাৎ জয়সুরিয়ার ৪৪ বলে ৮২ রানের ঝড়ে অন্য কোয়ার্টার-ফাইনালে ইংল্যান্ডকে উড়িয়ে শেষ চারে ওঠে শ্রীলঙ্কা। আর নিউ জিল্যান্ডের ক্রিস হ্যারিসের সেঞ্চুরি বিফল করে দিয়ে মার্ক ওয়াহর টুর্নমেন্টে তৃতীয় শতক অস্ট্রেলিয়াকে তোলে সেমিফাইনালে।
সেখানে জন্ম আরেক কলঙ্কের। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ভারতের ফাইনালে ওঠার সাক্ষী হতে ইডেনে এসেছিল লাখখানেক দর্শক। ম্যাচের প্রথম ওভারে জাভাগাল শ্রীনাথ যখন জয়সুরিয়া-কালুভিথারানাকে আউট করেন, তখন তাদের উল্লাস যে আকাশ ছোঁয়। অরবিন্দ ডি সিলভার প্রতিআক্রমণের ৬৬ রানে ম্যাচে ফেরায় শ্রীলঙ্কাকে। আট উইকেটে ২৫১ রান নিয়ে ইনিংস শেষ করে তারা। দর্শকরা তখনো স্বাগতিকদের জয়ের ব্যাপারে প্রবল আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু টুর্নামেন্ট-সর্বোচ্চ ৫২৩ রান করা শচীন টেন্ডুলকার আউট হয়ে গেলে দর্শকরা বুঝে যায়, আর আশা নেই। ১২০ রানের মধ্যে ভারতের আট উইকেট পড়ে যাওয়ায় পরাজয় অবধারিত জেনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে তারা। গ্যালারির জায়গায় জায়গায় ধরিয়ে দেয় আগুন। নিরাপত্তাজনিত কারণে ক্রিকেটারদের নিয়ে মাঠ ছাড়েন আম্পায়াররা, বিজয়ী ঘোষণা করা হয় শ্রীলঙ্কাকে।
অন্য সেমি-ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হারটি ছিল নির্মম। ম্যাচের নাটাই যে প্রায় পুরোটা সময়ই ছিল ক্যারিবিয়ানদের হাতে! ১৫ রানে অস্ট্রেলিয়ার চার উইকেট তুলে নিয়েছিল তারা। এরপর অস্ট্রেলিয়া ২০৭ করলে ফেভারিট লারার দল। ৪২তম ওভারে দুই উইকেটে ১৬৫ রানে পৌঁছে যাওয়ার পর তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাজি ধরার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। নির্বোধের মতো ব্যাটিংয়ে শেষ ৫০ বলে মাত্র ৩৭ রানে আট উইকেট হারিয়ে ঠিকই ম্যাচটি হেরে যায় তারা। অধিনায়ক রিচি রিচার্ডসন ৪৯ রানে অপরাজিত থাকলেও হারের দায় এড়াতে পারেন না। শেষ ওভারে ১০ রানের প্রয়োজনীয়তার মুখোমুখি হয়ে প্রথম বলে চার মেরেছিলেন তিনি। পরের বলে তিনি যে কেন ঝুঁকিপূর্ণ রান নিতে গেলেন! তাতে রান আউট কার্টলি অ্যামব্রোস। শেষ ব্যাটসম্যান কোর্টনি ওয়ালশও আর পারেননি রিচার্ডসনকে স্ট্রাইক দিতে। তিন বল বাকি থাকতে ২০২ রানে অলআউট হয়ে ৫ রানে সেমিতে হেরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আগের ব্যাটিং করা অস্ট্রেলিয়া সাত উইকেটে তোলে ২৪১ রান, অধিনায়ক মার্ক টেলরের ৭৪ রান যে ইনিংসের জ্বালানি। ৯ ওভার অফস্পিন করে ডি সিলভা ৪২ রানে নেন তিন উইকেট। দারুণ দুটি ক্যাচও ধরেছিলেন তিনি। তবে সেসব এখন আর মনে রেখেছে কে! তাঁর ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের স্মৃতিটাই যে জ্বলজ্বলে সবার মনে!
বিশ্বকাপের আবহে যাদের সম্ভাবনা তেমনভাবে উচ্চারিত হয়নি কোথাও, সেই শ্রীলঙ্কাই কিনা জিতে নিল ’৯৬-র বিশ্বকাপ!
সবচেয়ে বেশি রান:
খেলোয়াড় (দেশ) | ম্যাচ | রান | সেরা | গড় | ১০০/৫০ |
শচীন টেন্ডুলকার (ভারত) | ৭ | ৫২৩ | ১৩৭ | ৮৭.১৬ | ২/৩ |
মার্ক ওয়াহ (অস্ট্রেলিয়া) | ৭ | ৪৮৪ | ১৩০ | ৮০.৬৬ | ৩/১ |
অরবিন্দ ডি সিলভা (শ্রীলঙ্কা) | ৬ | ৪৪৮ | ১৪৫ | ৮৯.৬০ | ২/২ |
গ্যারি কারস্টেন (দ.আফ্রিকা) | ৬ | ৩৯১ | ১৮৮ | ৭৮.২০ | ১/১ |
সাইদ আনোয়ার (পাকিস্তান) | ৬ | ৩২৯ | ৮৩* | ৮২.২৫ | ০/২ |
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
খেলোয়াড় (দেশ) | ম্যাচ | উইকেট | সেরা | গড় | ইকোনমি রেট |
অনিল কুম্বলে (ভারত) | ৭ | ১৫ | ৩/২৮ | ১৮.৭৩ | ৪.০৩ |
ওয়াকার ইউনিস (পাকিস্তান) | ৬ | ১৩ | ৪/২৬ | ১৯.৪৬ | ৪.৬৮ |
পল স্ট্র্যাং (জিম্বাবুয়ে) | ৬ | ১২ | ৫/২১ | ১৬.০০ | ৪.৫৫ |
রজার হার্পার (ও. ইন্ডিজ) | ৬ | ১২ | ৪/৪৭ | ১৮.২৫ | ৩.৭৭ |
ড্যামিয়েন ফ্লেমিং (অস্ট্রেলিয়া) | ৬ | ১২ | ৫/৩৬ | ১৮.৪১ | ৪.৮৭ |