যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর নিয়ে উত্তেজনা আর দোলাচলে একটি দিন পার করল বাংলাদেশ।
Published : 11 Apr 2015, 12:45 AM
শুক্রবার সকালে কারাগারে দুই ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে উত্তেজনার শুরু। নানা ঘটনাপ্রবাহ আর গুঞ্জনে দফায় দফায় উত্তেজনার পারদে ওঠানামা চলে রাত পর্যন্ত।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ‘কামারুজ্জামানকে আর সময় দেয়া হবে না’ জানানোর পর সন্ধ্যায় উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। এরইমধ্যে কারাগারের নিরাপত্তা বাড়ানো এবং অন্যান্য প্রস্তুতি দেখে সংবাদ মাধ্যমে চোখ রাখা মানুষ রাতেই ফাঁসি কার্যকর হতে পারে ভাবতে শুরু করে।
তবে শেষ পর্যন্ত রাত ১০টার দিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল আরও অপেক্ষার ইংগিত দেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আজ রাতে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম।”
একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা ও নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ৯ মে ময়মনসিংহের আল বদর কমান্ডার কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে সেখানেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল থাকে।
সর্বোচ্চ আদালতের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য কামারুজ্জামানের আবেদন গত সোমবার খারিজ করে দেয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ। কারা কর্তৃপক্ষের চিঠির প্রেক্ষিতে কামারুজ্জামানের পরিবারের সদস্যরা ওইদিনই কারাগারে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন।
এরপর বুধবার দুপুরে রায়ে বিচারপতিদের সইয়ের পর তা কারাগারে পাঠানো হয়। কারা কর্তৃপক্ষ ওই রায় পড়ে শোনায় ফাঁসির আসামি কামারুজ্জামানকে। শুরু হয় দণ্ড কার্যকরের আগে আসামির প্রাণভিক্ষার আনুষ্ঠানিকতা।
কিন্তু প্রাণভিক্ষার জন্য কামারুজ্জামান কতো সময় পাবেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে অস্পষ্টতা থাকায় চলতে থাকে নানা আলোচনা। সংবাদকর্মীরা কারাগারের সামনে চোখ রাখার পাশাপাশি দফায় দফায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, অ্যাটর্নি জেনারেল, কারা কর্মকর্তা ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নানা প্রশ্ন নিয়ে।
নিয়ম অনুযায়ী একজন ফাঁসির আসামি প্রাণভিক্ষার আবেদন করলে কারা কর্তৃপক্ষ তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠায়। রাষ্ট্রপতি সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত দেন। আসামি আবেদন না করলে বা তার আবেদন খারিজ হয়ে গেলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করে।
এর আগে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা প্রাণভিক্ষার সুযোগ না নেওয়ায় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রিভিউ খারিজের দিনই ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
কামারুজ্জামান অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না- বুধবার তার কাছে তা জানতে চায় কারা কর্তৃপক্ষ। সে সময় তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলতে চান।
সে অনুযায়ী আইনজীবীরা বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে দেখা করে সাংবাদিকদের বলেন, কামারুজ্জামান ভেবে দেখার জন্য সময় চেয়েছেন।
কামারুজ্জামানের সিদ্ধান্ত জানতে শুক্রবার সকালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব জামিল ও তানভীর মোহাম্মদ আজিম।
এক ঘণ্টার বেশি কারাগারে অবস্থানের পর বেলা ১১টা ৩৭ মিনিটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলে বেরিয়ে যান ম্যাজিস্ট্রেটরা। এরপর কারা ফটকের সামনে আসেন জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক ফরমান আলী। তিনিও ‘নো কমেন্টস’ বলে এড়িয়ে যান সাংবাদিকদের প্রশ্ন।
কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য না আসায় এ সময় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চলতে থাকে নানা আলোচনা।
এরই মধ্যে দুপুরে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কামারুজ্জামানকে মার্সি পিটিশনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। উনি সময় নিচ্ছেন। বলছেন- ‘সিদ্ধান্ত দিচ্ছি, দেব’।”
তবে এই যুদ্ধাপরাধীকে ‘দ্রুত’ তার সিদ্ধান্ত জানাতে হবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “সে যাই বলুক, আমরা বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।”
মন্ত্রীর বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে আসার পর উত্তেজনা কিছুটা থিতিয়ে এলেও সন্ধ্যায় কারাগার এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ পায় পুলিশ ও র্যাব। কারা ফটকের সামনে গড়ে তোলা হয় দুই স্তরের নিরাপত্তা বলয়। ফলে নাজিম উদ্দিন রোড ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় সংবাদকর্মীদের তৎপরতাও বেড়ে যায়।
চকবাজার থানার ওসি আজিজুল হক সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওপরের নির্দেশেই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।”
এরইমধ্যে ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শিল্পকলা একাডেমীতে যান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে অনুষ্ঠানস্থল থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “ম্যাজিস্ট্রেট আজ গিয়েছিলেন, তার (কামারুজ্জামান) সঙ্গে কথা বলেছেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
কামারুজ্জামান প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন কি না জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “তাকে আর সময় দেওয়া হচ্ছে না।”
এর পরপরই তিনি দ্রুত অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যান এবং উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একটি রিকশা ভ্যানে করে অন্তত আটটি বাঁশ ও বড় আকারের তিনটি কার্টন প্রধান ফটক দিয়ে কারাগারের ভেতরে নেওয়া হয়। এর আধা ঘণ্টা পর একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নেওয়া হয় ত্রিপল। ৩০ থেকে ৪০টি প্লাস্টিকের চেয়ারও ভেতরে নিতে দেখা যায়।
কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, ফাঁসির মঞ্চের ওপরে আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাঁশ ও ত্রিপল প্রয়োজন হয়। আশেপাশের কোনো উঁচু ভবন থেকে যাতে দেখা না যায় সেজন্য কাদের মোল্লার ফাঁসির সময়ও এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
অধিকাংশ বেসরকারি টেলিভিশন কারাগারের সামনের পরিস্থিতি একটু পর পর সরাসরি দেখাতে থাকলে উত্তেজনার পারদও চড়তে থাকে।
কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না করায় রাতেই দণ্ড কার্যকর হচ্ছে কি না সে অস্পষ্টতা থেকেই যায়।
কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইকবাল রাত ১০টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সারা দিন আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। বলা হয়েছিল কিছু হলে আইনজীবীর মাধ্যমে যোগাযোগ করা হবে। তবে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।”
এরপর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি রাতে ‘আর কিছু’ না হওয়ার ইংগিত দেন।
কামারুজ্জামানকে আর সময় দেওয়া না হলে শনিবার ফাঁসি কার্যকর করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা কাল দেখা যাবে।”