ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে ঘরের হাঁড়ি-পাতিল আর চটের বস্তা নিয়ে সুন্দরবনের শেলা নদীতে ট্যাংকার দুর্ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করছেন জেলে ও স্থানীয় গ্রামবাসীরা।
Published : 12 Dec 2014, 01:11 PM
সুন্দরবনের তেল অপসারণে ‘হাতুড়ে পদ্ধতি’
দুই দিন তেল ছড়ানোর পর উদ্ধার হলো ট্যাংকার
রাসায়নিক নিয়ে সুন্দরবনে কান্ডারি-১০
তেল ছড়িয়েছে আরও, দেখা মিলছে না ডলফিনের
তেলদূষণ: ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা, তদন্ত কমিটি
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানির ঠিকাদার তাদের কাছ থেকে ওই তেল কিনে নিচ্ছেন ৩০ টাকা লিটার দরে।
এভাবে সারা দিনে ২৬ ব্যারেল, অর্থাৎ ৫ হাজার ২০০ লিটার তেল কেনা হয়েছে বলে পদ্মা অয়েলের ঠিকাদার আবদুল্লাহ ট্রেডার্সের মালিক রফিকুল ইসলাম বাবুল জানিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই এতে পানি ও নদীর বর্জ্য মিশে থাকছে।
বন বিভাগের সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, আগের দিনের ঘোষণা অনুযায়ী, স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তেল সংগ্রহের কাজ চলে। শনিবার সকাল আবারো তা শুরু হবে।
শেলা নদীর জয়মনি থেকে আন্ধারমানিক পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন খাল প্রথম দিনে এই কাজ চলে বলে সহকারী বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেন জানান।
তিনি বলেন, “সবাই স্বতস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছে। অনেক পরিবারের নারী ও শিশুরাও হাঁড়ি পাতিল নিয়ে এ কাজে নেমে পড়েছে। আমরা তিন দিন এভাবে তেল সংগ্রহ করার পরিকল্পনা নিয়েছি।”
তেল সরানোর এই পুরো কাজ তদারক করছে বনবিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ, কোস্ট গার্ড, নৌপুলিশ ও মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ।
তেল যাতে আরো ছড়াতে না পারে সেজন্য জেলেদের সহায়তায় বনরক্ষীরা বুধবার থেকেই দুর্ঘটনাস্থলের কাছে শেলা নদীর খালগুলোর মুখ জাল দিয়ে আটকে দেওয়ার কাজ শুরু করেন।
খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে গত মঙ্গলবার ভোরে দুর্ঘটনায় পড়ে ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ নামের ট্যাংকারটি।
এমটি টোটাল নামে একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাউদার্ন স্টারের একপাশের খোল ফেটে যায় এবং সেটি ডুবতে শুরু করে।
দুর্ঘটনার দুই দিন পর ডুবে যাওয়া ট্যাংকারটি বৃহস্পতিবার উদ্ধার করা হয়। তবে এরই মধ্যে সাউদার্ন স্টারে থাকা সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস অয়েলের প্রায় পুরোটাই সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের ধারণা।
এই তেল বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবন, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিন এবং বনের প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
প্রথমে রাসায়নিক (অয়েল স্পিল ডিসপারস্যান্ট) ছিটিয়ে তেল অপসারণের কথা থাকলেও সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কায় তা স্থগিত রাখা হয়।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেলেই অয়েল স্পিল ডিসপারসেন্ট ছিটিয়ে তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু হবে বলে জানান চট্টগ্রাম থেকে আসা টাগবোট কাণ্ডারি-১০ এর মাস্টার আবু বকর সিদ্দিক।
১০ হাজার লিটার ‘অয়েল স্পিল ডিসপারসেন্ট’ নিয়ে বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাণ্ডারি-১০ ভাসমান তেলের ওপর রাসায়নিক ছিটানো শুরু করলেও বন বিভাগের আপত্তিতে তা স্থগিত করা হয়।
নৌ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, কাণ্ডারি-১০ যে অয়েল স্পিল ডিসপারস্যান্ট নিয়ে গেছে তা ছিটিয়ে দিলে ভাসমান তেলের রাসায়নিক গঠন ভেঙে যাবে এবং ভেসে থাকা তেল পানির নিচে চলে যাবে। এতে পানির অক্সিজেন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমবে।
কিন্তু বৃহস্পতিবার মংলায় বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্মেলন কক্ষে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে বন বিভাগ, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জাহাজ মালিকের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সভায় স্পঞ্জ ও চট ব্যবহার করে স্থানীয়দের দিয়ে তেল অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়।
মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ শফিকুল ইসলাম রাসেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা বৃহস্পতিবার থেকেই মসজিদে ও রাস্তায় রাস্তায় মাইকিং করে সবাইকে তেল সরানোর কাজে যোগ দিতে আহ্বান জানান। শুক্রবারও মাইকিং চলে।
চিলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বলেন, “প্রথম দিন ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের লোকজন এই কাজে এসেছে। টাকা পাওয়া যাবে এই আশাতেই অনেকে তেল সংগ্রহ করছেন।”
পদ্মা অয়েলের ঠিকাদার আবদুল্লাহ ট্রেডার্সের মালিক বাবুল জানান, সংগ্রহ করা তেল কেনার জন্য তারা জয়মনির ফরেস্ট ঘাট, জয়মনি খাদ্য গুদাম, কাটাখালি ও ঘটনাস্থল শেলা নদীর বাদামতলা এলাকায় চারটি ক্রয়কেন্দ্র খুলেছেন।
শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে ২৬ ব্যারেল তেল কেনা হয়েছে। এসব ব্যারেলের প্রতিটিতে ২০০ লিটার করে তেল ধরে।
জয়মনি এলাকার বাসিন্দা শেখ রাজ্জাক আরও তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে একটি ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে সারাদিন নদী থেকে তেল সংগ্রহ করেন। হাঁড়ি, বালতি ব্যবহার করে তিনি তুলেছেন চার ব্যারেল তেল।
জয়মনির সাত নম্বর ওয়র্ডের বাসিন্দা জাহিদ জানান, তিনি সংগ্রহ করেছেন দুই ব্যারেল তেল।
তেল সংগ্রহ ও বিক্রির ক্ষেত্রে স্থানীয়দের সহযোগিতা করছেন হাফিজুর রহমান সুমন নামের একজন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জোনান, শুক্রবার ১৫ থেকে ২০টি ইঞ্জিনচালতি নৌকায় করে শেলা নদীর মৃগমারী, বাদামতলা, চরের খাল, ছোট ভাইজোড়া ও বড়ভাইজোড়া, টেংরা খাল, আমবাড়িয়া, তেঁতুলবাড়িয়া, সূর্যমুখী, ছোট মোরগবাড়ি, বড় মোরগবাড়ি খালে তেল তোলার কাজ চলে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে পরিবারের নারী ও শিশুদের নিয়ে এ কাজে যোগ দেন।
রফিকুল ইসলাম বাবুল জানান, বৃহস্পতিবারের বৈঠকে স্পঞ্জের কথা বলা হলেও এতো স্পঞ্জ পাওয়া সহজ নয় বলে চট ও কাপড়ের ন্যাকড়া ব্যবহার করছেন স্থানীয়রা। সেই সঙ্গে থালা, হাড়ি, বালতি বা যে কোনো পাত্র দিয়ে তারা পানিতে ভাসমান তেল বা তীর মাটেতে লেগে থাকা তেলের স্তর সংগ্রহ করছেন।
এরপর মাটিতে গর্ত খুঁড়ে পলিথিন বিছিয়ে সেখানে তেল রেখে থিতানো হচ্ছে। যতোটা সম্ভব পানি থেকে আলাদা করে তা ড্রামে ভরে নিয়ে আসা হচ্ছে ক্রয় কেন্দ্রে।
তবে এভাবে খালি হাতে নদী থেকে তেল তোলায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে কি না- সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কেউ সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি।
মংলা কেস্ট গার্ডে পশ্চিম জোনের কমান্ডার মেহেদী মাসুদ জানান, তেল সংগ্রহ ও বিক্রিতে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা যাতে না হয় সেজন্য কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী, নৌ পুলিশ, বন বিভাগের কর্মীরা নজর রাখছেন।
ট্যাংকারডুবির কারণে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের সমূহ বিপদের পাশাপাশি প্রাণী বিশেষজ্ঞদের সবচেয়ে বড় শঙ্কা ইরাবতী ডলফিন নিয়ে, যার অভয়াশ্রমের কাছেই ট্যাংকারটি আরেকটি কার্গোর ধাক্বায় ডুবে যায়।
সুন্দরবনের শেলা ও পশুর নদীর মোট ৩১ কিলোমিটার এলাকা ডলফিনের অভয়ারণ্য। পশুর নদীর কোল ঘেঁষে যে স্থানে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, তা ডলফিনের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র।
কিন্তু বুধবার থেকে একটি ডলফিনও লাফাতে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার আব্দুর রব। এই প্রজনন কেন্দ্রের দুটি চৌবাচ্চায় রাখা লবণপানির সাতটি কুমির ছানার মুখে বৃহস্পতিবার ঘা দেখা দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
লবণ পানির কুমিরের চৌবাচ্চায় প্রতিদিনই পানি পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। কিন্তু নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় আপাতত চৌবাচ্চার পানি পরিবর্তন বন্ধ রাখা হয়েছে।
এছাড়া নদীর বিভিন্ন স্থানে তেলের স্তুরের মধ্যে আটকা পড়া মৃত কাকড়া ভাসতে দেখা গেছে।স্থানীয় বাসিন্দাদের যেসব হাঁস নদীতে নামে, তাদের গায়েও জড়িয়ে গেছে ঘন তেল।
তবে নদীতে মরা মাছ ভেসে ওঠার কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি বলে সহকারী বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেন জানিয়েছেন।