ঈদযাত্রা এখন পর্যন্ত স্বস্তির

বেহাল মহাসড়কগুলো ভোগান্তির চোখ রাঙানি দিলেও স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে রাজধানী থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের ঘরে ফেরায় গত কয়েকদিনে বড় কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।

মঈনুল হক চৌধুরী কামাল তালুকদার, গোলাম মুজতবা ধ্রুব, সেলিম আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 July 2014, 04:46 PM
Updated : 26 July 2014, 04:46 PM

ট্রেন স্টেশন, বাস টার্মিনাল ও নৌবন্দরে ভিড় এবং টিকিটের তুলনামূলক উচ্চমূল্য যতটুকু দুর্ভোগ তৈরি করেছে, তা মেনে নিয়েই এখন বাড়ির পানে মানুষ।

এবার ঈদের ছুটির শুরুর আগে সাপ্তাহিক ছুটি যোগ হয়ে যাওয়ায় মানুষের ঘরে ফেরার চাপ এক কিংবা দুই দিনে পড়ছে না। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছুটি রোজার প্রথম দিন থেকে। ফলে যাত্রার ভোগান্তি এবার কম বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।  

শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির পর ঈদের আগে কেবল রোববার অফিস খোলা। সোম থেকে বুধবার পর্যন্ত ঈদের ছুটি। রোজা ৩০টি হলে বৃহস্পতিবারও ঈদের ছুটি থাকবে।

ফলে মাঝের একদিন ছুটি নিয়ে আগামী সপ্তাহের রোববার পর্যন্ত টানা নয়দিন অফিস যাবেন না অনেক কর্মজীবীই।  

বৃহস্পতিবার থেকে ঘরমুখো মানুষের বাড়ি ফেরার এই স্রোতে শনিবার বিকাল নাগাদ ঢাকার বেশিরভাগ রাজপথই তুলনামূলকভাবে ফাঁকা দেখা যায়। শুধু বিপণি বিতান সংলগ্ন সড়কগুলোতেই কিছুটা ভিড় ছিল।

যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও এবারের ঈদযাত্রা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, “যানজটবিহীন ঘরমুখী মানুষের যাত্রার ক্ষেত্রে বিগত কয়েক বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে।”

শনিবার সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের একথা বলেন।

বেহাল মহাসড়ক নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত প্রতিবেদন নিয়ে ওবায়দুল কাদের আরো বলেন, “রাজনীতিতে যেমন খারাপ মানুষ রয়েছে, তেমন মিডিয়াতেও রয়েছে। এখানে ভালো খবর প্রকাশের পাশাপাশি খারাপ খবরও প্রকাশিত হয়।”

তবে গণমাধ্যমের সমালোচনাকে বন্ধুভাবে নিয়েছেন বলে জানান তিনি।

সময়সূচি ধরে চলছে ট্রেন

শনিবার দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশন ঘুরে দেখা গেছে গন্তব্যে পৌঁছাতে নির্দিষ্ট ট্রেনে উঠছেন যাত্রীরা। ঢাকা ছাড়তে স্টেশনে আসা যাত্রীদের মালবহনকারী শ্রমিকদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে।

কমলাপুর স্টেশনের শ্রমিক মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষ পরিবারের লগে ঈদ করতে ঢাকা ছাড়তাসে। তাগো নতুন জামার ব্যাগ আমরা টাইনা গাড়িতে তুলতাসি। তারাও আমগো খুশি হইয়া ঈদ বকশিস দিতাসে।”

স্টেশনে ব্রাক্ষণবাড়িয়াগামী যাত্রী আবদুল হাকিম মন্ডল বলেন, “শুক্রবার নামাজ পড়েই বাড়ি যাবো বলে স্টেশনে চলে এসেছি। ঈদের পরও অন্তত তিন দিন পরিবারের সঙ্গে থাকবো। আবার কবে যে বাড়ি যাওয়া হবে তার ঠিক নাই।” 

স্টেশন সংলগ্ন বিভিন্ন খাবার দোকানগুলো থেকে যাত্রীদের পানি ও ইফতারের জন্য হালকা খাবার কিনে রাখতে দেখা গেছে।

পাবনাগামী যাত্রী সাইফুল ইসলাম রবিন বলেন, “ঈদে আমি আর বাবা ঢাকা থেকে বাড়ি যাচ্ছি। বাবা রোজা আছেন। তাই কমলাপুর থেকে পানি কিনে রাখছি। ট্রেনে পানি ও খাবার খেয়ে গতবছর পেটের সমস্যা হয়েছিল।”

কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি হাকিম মণ্ডল কিংবা সাইফুলের কাছে থেকে।

কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার মো. খায়রুল বশীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে রেলওয়ে শনিবার থেকে দেওয়ানগঞ্জ, পার্বতীপুর, খুলনার জন্য তিনটি বাড়টি ট্রেন চালু করেছে।”

তিনি বলেন, “ট্রেনে করে যাত্রীরা যেন নিরাপদে আরামে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারে সেজন্য তিনটি স্পেশাল ট্রেন চালু করা হয়েছে। ঈদের পরও সাতদিন এগুলো আসা যাওয়া করবে।”

তবে যদি বাড়তি আরো ট্রেন দরকার হয় সেটিরও ব্যবস্থা আছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “শনিবার সবগুলো ট্রেনই মোটামুটি সময় মেনে ঢাকা ছেড়েছে আর ঢাকায় পৌঁছেছে।”

স্টেশনে রেলপুলিশের কমলাপুরের ওসি আবদুল মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্টেশনে যেন যাত্রীরা কোনো ধরনের হয়রানি বা অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি না হন সেজন্য সবসময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি। আল্লাহর রহমতে এবার কোনো ধরনের অপ্রীতকর ঘটনা ঘটেনি।”

গত ২০ জুলাই থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। শুক্রবার থেকে অগ্রীম টিকিট কেনা যাত্রীরা ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন।

বাসে ভিড় এখনো নেই

গাবতলী বাস টার্মিনালে বিকালে সালমা বেগম পুত্র-কন্যা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন পাবনাগামী বাসের জন্য। তিনি জানান, রেসিডেন্সিয়ালে ক্লাস নাইনে পড়ুয়া সন্তান ইমুর কোচিং থাকায় শনিবার ঢাকা ছাড়তে হচ্ছে।

“স্কুল ছুটি বেশ আগে হওয়ায় ইতোমধ্যে তো অনেকেই ঢাকা ছেড়েছে। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ শুনে অনেকের বিকল্প প্রস্তুতিও ছিল। অন্যান্য বছরও তাই হয়েছে। এবার শেষ মুহূর্তে এসে অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে। বাস কাউন্টারে আসতেই ১০-১৫ মিনিট লেগেছে। বাকি পথটুকুও ভালোভাবে পৌঁছাবো আশা রাখি।”

কেয়া পরিবহনের অফিস সহকারী মনির হোসেন জানান, আগাম টিকিটের যাত্রীরাই নির্ধারিত সময়ে ঢাকা ছাড়তে পারছেন। যানজটের কারণে টার্মিনালে বাস পৌঁছাতে দেরি হয়েছে এমনটা এবার হয়নি।

তিনি বলেন, “গত দু’দিনে মানুষ চলে গেছে অনেক। এখন বাকি গার্মেন্টস-এর যাত্রী। আজ রাতে একটু ভিড় হবে, আর রোববার রাতে হতে পারে।”

মনির জানান, বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত তাদের সাত-আটটি গাড়ি যথাসময়ে ছেড়েছে। কোথাও কোনো যানজটের খবর নেই।

তবে হানিফ পরিবহনের টিকিট মাস্টার সোহেল ও শাহজাহান জানান, ঢাকা থেকে বের হতে শ্যামলী থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত ও ইপিজেড এলাকায় সামান্য যানজটে পড়তে হচ্ছে।

শাহাজাহান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্রেনের যাত্রী এবার বেশি হওয়ায় বাসে ঘরমুখো মানুষের চাপ একটু কম। আর জ্যাম তো শুধু ঢাকায়। পুরা রোড ক্লিয়ার। আজকেই যানজট শেষ, কালকের পর তো পুরো ফাঁকাই। একটু জ্যাম থাকলেও তা আর আগের মতো না।”

চালকদের কাছ থেকেও রাস্তা খারাপ বা তীব্র যানজট বা মানুষের দুর্ভোগের চিত্র তেমন শুনেননি বলে দাবি করেন সোহেল ও শাহজাহান।

বাস-ট্রাক মালিক সমিতির নেতা নুরুল ইসলামও দাবি করেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার মানুষকে তেমন দুর্ভোগে পড়তে হয় নি।

“এবার স্কুল-কলেজে আগে ছুটি দিয়েছে। দুর্ভোগের আশঙ্কায় নিরাপদ ভ্রমনের জন্য অনেকে বিকল্প পন্থাও নিয়েছে। শেষ মুহূর্তে আর আগের মতো চাপ নেই। তবে রোববারের রাতে একটু ভিড় বাড়তে পারে।”

কোনো কোনো লোকাল বাস স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দামে টিকিট বিক্রির অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

বাবলু ট্রাভেলসের জুলফিকার আলী জানান, বিলাসবহুল পরিবহনে টিকিট না থাকলেও লোকাল বাসে টিকিট রয়েছে বেশ। শনিবার রাতে ও রোববার শেষ সময়ে এসব বাসের চাহিদাও বাড়বে।

স্থানীয় দোকানদার সজীব হোসেন বলেন, “গতবছরও এ সময়ে ভরপুর বিক্রি হয়েছে। এবার তেমন লোক নেই, বেচাবিক্রিও নেই। ঢাকা ছেড়ে গেছে লোক। গার্মেন্টসের লোকের ভিড় পড়বে আজ।

“ঈদের আগের দিন রাতে ২৮ তারিখ বা ঈদ বৃহস্পতিবার হলে আগের রাতে একটু চাপ থাকতে পারে। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা থাকায় এবার মনে নয় না ঝামেলা হবে।”

লঞ্চ টার্মিনালে তৎপর প্রশাসন

ঈদের তিন দিন বাকি থাকলেও শনিবার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে সকাল থেকেই দেখা গেছে ঘরমুখো মানুষের ব্যস্ততা।

ছাদের যাত্রীবহন নিষিদ্ধ থাকলেও প্রায় সব লঞ্চের ছাদেই অতিরিক্ত যাত্রী দেখা গেছে। এসময় এম ভি ভোলা নামে একটি লঞ্চকে ছাদে ওঠার সিঁড়ি রাখার কারণে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

নির্বাহী ম্যাজিস্টেট সাইফুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এম ভি ভোলা লঞ্চের ছাদে যাত্রী দেখে আমরা লঞ্চে উঠি। অন্যান্য লঞ্চে যাত্রীরা বিভিন্ন মাধ্যমে ছাদে উঠলেও ওই লঞ্চে ছাদে উঠার জন্য একটি সিঁড়ি পাওয়া যায়।

“ছাদে উঠার সিঁড়ি রাখার কারণে লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে দশ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।”

নৌমন্ত্রী শাজাহান খান শনিবার সকালে ও বিকালে সদরঘাট পরিদর্শন করেন।

বিকালে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “নিরাপদে ও সুন্দরভাবে মানুষের বাড়ি ফেরার জন্য যা করা দরকার, সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

শুক্রবার রাতে বরিশালে একটি লঞ্চের সঙ্গে বালূবাহী কার্গোর ধাক্কায় বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “ঈদের পাঁচদিন আগে ও পরে এ ধরনের বালুবাহী কার্গো চলাচল নিষেধ করা হয়েছে।

এই নিষেধ অমান্য করায় শনিবার বিভিন্ন নদীতে অভিযান চালিয়ে বিআইডব্লিটিএ ১১টি কার্গো জব্দ করেছে। মালিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ)পরিবহন পরিদর্শক সৈয়দ মাহফুজুর রহমান বলেন, “শনিবার সন্ধ্যা নাগাদ ৩৫টি লঞ্চ সদরঘাট থেকে ছেড়ে যায়। শুক্রবার সারাদিন ৮৩টি লঞ্চ ছেড়ে গিয়েছিলো। তবে রাত নাগাদ মোট লঞ্চ ছাড়ার পরিমাণ কালকের (শুক্রবার) সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে।

নৌমন্ত্রী বলেন, “শনিবারের থেকে রোববারের যাত্রী সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।”

লঞ্চের কেবিনের ভাড়া বেশি নেয়ার ‘অভিযোগ’ সম্পর্কে শাজাহান খান বলেন, “এ ধরনের অভিযোগ ঘাট কর্তৃপক্ষকে জানালে সঙ্গে সঙ্গে ওই লঞ্চের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

নিউ বোরাক লঞ্চের মাস্টার মোহাম্মদ আলমাস বলেন, “যাত্রী পাচ্ছি। তবে আপনারা (সাংবাদিক) যেভাবে বলেন বা লেখেন লঞ্চে ‘তিল ধারণের জায়গা’ নেই, সেরকম যাত্রী পাচ্ছি না।”

সুন্দববন গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক আবুল কালাম ঝন্টু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যাত্রী রয়েছে,  তবে যেভাবে ঈদের যাত্রী পেয়ে থাকি-সেরকম পাচ্ছি না। এবার সংখ্যা অনেক কম।”

এদিকে দুপুরে টার্মিনালে থাকা হকারদের উঠিয়ে বিকাল ৩টার দিকে পন্টুনে পরিবহন পরিদর্শকদের বিরুদ্ধে মিছিল করেছেন প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন হকার।

তাদের অভিযোগ, পরিবহন পরিদর্শকরা তাদেরকে মারধর করে উঠিয়ে দিয়েছে।

পরিবহন পরিদর্শক মো. সোলায়মান বলেন, “পন্টুনে কোনো হকার থাকাতে পারবে না। তাদেরকে উঠিয়ে দিতে গেলে তারা আমাদের ওপর চড়াও হয়। এসময় আনসার ও পুলিশ গিয়ে তাদেরকে উঠিয়ে দেয়।”

এ বিষয়ে নৌমন্ত্রী বলেন, “পন্টুনে কোনো ধরনের হকার থাকতে পারবে না।

সদরঘাট খেকে ৪৫টি রুটের জন্য প্রায় ১৭০টি লঞ্চ রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানান।