স্মরণসভায় ওদের কান্নায় চোখে জল মানেনি কারো

সাভারের রানা প্লাজা ধসে মা হারিয়েছিল সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আরিফা খাতুন। ঠিক এক বছরের মাথায় ওই ঘটনায় নিহতদের স্মরণসভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাজী নজরুল ইসলামের ‘মা’ কবিতাটি আবৃত্তির সময় তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।

আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2014, 01:27 PM
Updated : 24 April 2014, 05:47 PM

কবিতার শেষ কয়েকটি চরণ- ‘মার  মতো বড় কেহ নাই/কেউ নাই, কেউ নাই/ নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’ উচ্চারণ শেষ হওয়ার পরেও কয়েক মুহূর্ত পুরো স্মরণসভা ছিল স্তব্ধ। আরিফার সঙ্গে তখন চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত অনেকেই।

বৃহস্পতিবার সকালে বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত এই সভায় এসময় চোখ মুছতে দেখা যায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, এমসিসিআই সভাপতি রোকেয়া আফজাল রহমান, বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম এবং শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তারসহ অনেককেই।

সভায় এসেছিল ভবন ধসের ওই ঘটনায় বাবা, মা হারানো আরো ৩৬ শিশু-কিশোর, যারা আঞ্জুমান-ই-মুফিদুল ইসলাম, রাজশাহী ওল্ড ক্যাডেট কলেজ হোমস এবং বিজিএমইএর সহযোগিতায় লেখাপড়া করছে।

এদের পাশাপাশি ওই ঘটনায় স্বজন হারানো এবং অঙ্গ হারানো অনেকেই স্মরণসভায় আসেন। 

আরিফা জানায়, তার মা রীণা বেগম রানা প্লাজার চতুর্থ তলায় কাজ করতেন।

ওই ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে হতাহতদের উদ্ধার তৎপরতা দেখে মানুষের জন্য কিছু করার তাগাদা  তৈরি হয়েছে আরিফার।

উদ্ধার কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে সপ্তম শ্রেণির এই ছাত্রী বলে, “আমি বড় হয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হতে চাই, যেন দেশের সেবা করতে পারি।”

এর পরপরই সমবেত কন্ঠে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানটি গেয়ে শোনায় স্বজন হারানো শিশুরা।

আরিফার ‘মা’ কবিতা আবৃত্তি শুনে মঞ্চ তো বটেই, মঞ্চের বাইরে পুরো সভাস্থল জুড়ে নেমে আসে ঠিক যেন একবছর আগের সেই শোকাবহ দিনটি।

স্মরণসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, “একটি বাচ্চা মেয়ে একটু আগে ‘মা’ কবিতা আবৃত্তি করছিল। এটা আমার হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে এ ধরনের দুর্ঘটনা হবে এটা আমি কখনো ভাবিনি।

“যারা কারখানা মালিক, যারা এ শিল্পের সাথে জড়িত তাদের আজ শপথ নিতে হবে এদেশে আর একটি কারখানাতেও এমনটা যেন না ঘটে।”

মন্ত্রী বলেন, পোশাক শিল্পকে আধুনিক ও নিরাপদ হিসেবে গড়ে তুলতে যে ধরনের ব্যবস্থা বা যন্ত্রপাতি প্রয়োজন সেগুলোর শুল্কমুক্ত আমদানির ব্যবস্থা সরকার করেছে।

“বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। কিন্তু এ খাতকে যদি আমরা প্রথম অবস্থানে নিতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের কমপ্লায়েন্সের দিকে যেতে হবে।”

তৈরি পোশাকের উৎসে কর দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৩ শতাংশ করার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, “এ ঘটনায় অনেক শিশু এতিম হয়েছে। অনেকগুলো পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। আজ আমাদের শপথ নিতে হবে এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ যেন আমরা কোনদিনও না করি।”

এরআগে বক্তব্য দিতে গিয়ে এমসিসিআইয়ের সভাপতি রোকেয়া আফজাল বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, “এ বাচ্চাগুলোকে দেখে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। সেই সাথে লজ্জাও।”

গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তার বলেন, “আমার নিজেরও একটি ১৬ এবং একটি ১০ বছরের সন্তান আছে। এখানে যে বাচ্চাগুলো এসেছে তাদের বয়স আমার বাচ্চাদের বয়সের অনেক কম। আমার ভাবতেই কষ্ট লাগছে। আমাদের নিজেদের ভুলের খেসারত আজকে এ বাচ্চাগুলোকে দিতে হচ্ছে।”

সরকার ও কারখানা মালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “এ অবস্থা যেন আর কোনদিনও না ঘটে, সরকারি কোন কর্মকর্তা যেন দুর্নীতি করে এমন পরিস্থিতির পথ করে না দেন তা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। তাদের দুর্নীতির জন্যই আজকে এ অবস্থা হয়েছে। আর রাজনীতিবিদরা আমাদের নিয়ে অনুগ্রহ করে খেলবেন না।”

রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানির জন্য দায়ীরা যেন কোন দিন ক্ষমা না পান সরকারের কাছে সেই দাবি জানান উদ্ধার কাজের সময় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারানো ইজাজ উদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী কায়কোবাদের বড় বোন নুরুন্নাহার।

ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি।

“যাদের জন্য আমি আমার ভাইকে হারিয়েছি তাদের আমি কোনদিনও ক্ষমা করবো না। আর আপনারাও দেখবেন এরা যেন কোনদিন ক্ষমা না পায়,” বলেন নুরুন্নাহার।

ভবন ধসের এ ঘটনায় একটি পা হারানোর পাশাপাশি কাজ করার ক্ষমতাও হারিয়েছেন আহত শ্রমিক রায়হান কবির।

মঞ্চে উঠে কিছুই বলতে পারলেন না তিনি। 

এছাড়া স্মৃতিচারণে অংশ নেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম, সংগঠনটির সহ-সভাপতি এস এ মান্নান কচি, আহত শ্রমিক নিলয় সরদার, সাথী আক্তার, উদ্ধারকর্মী মোস্তফা কামাল প্রমুখ।

অনুষ্ঠানের আগে বেলা সোয়া ১১টায় বিজিএমইএ ভবনের সামনে থেকে বের হয় শোকযাত্রা। 

নিহতদের স্মরণে শোকার্ত মানুষের ওই মিছিল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিজিএমইএ ভবন থেকে বেড়িয়ে সোনারগাঁও হোটেল মোড় ঘুরে আবারো বিজিএমইএর সামনে এসে শেষ হয়।

এরপর বিজিএমই ভবনের নিচতলায় বেলা সোয়া ১২টা পর্যন্ত প্রার্থনা হয়।

এর পাশাপাশি রানা প্লাজায় নিহতদের উদ্দেশ্যে বিজেএমইএর উদ্যোগে প্রতিটি পোশাক কারখানায় বিশেষ মোনাজাতের আয়োজন করা হয়।