তাদেরই একজন রফিকুল ইসলাম। ধসের শুরুর দিন থেকে টানা ২১ দিন উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
উদ্ধারকাজে টানা অংশ নিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন পেশায় রাজমিস্ত্রী রফিকুল। পরে তার স্থান হয় শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে।
“প্রতিদিন আমারে ওরা ডাকে। আমি আইসা স্যালাইন গুইল্যা খাওয়াইয়া থুইয়া যাই। বালতিতে কইরা স্যালাইন গুইল্যা বোতলে কইরা দিয়া যাই। খা, তোরা খাইয়া থাক। আমি পরে আইস্যা নিয়া যাব। যাইয়া দেখি যা’ক যা’ক খাওয়াইসি মারা গ্যাছে। আর যারা বাঁইচা আছে তারা কয়- ভাই, আমি আর কুলাইতে পারতেসি না। আমার জান বাইরায়া যাইতেসে ভাই।”
রানা প্লাজার সামনে বসে বলছিলেন রফিকুল, যিনি দীর্ঘ এক বছরেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেননি। এখনো নিয়ম করে স্যালাইন বানিয়ে ছুটে যান রানা প্লাজায় ‘আটকে পড়াদের’ খাওয়াবেন বলে।
বাবার অসুস্থতায় বন্ধ হয়ে গেছে দুই মেয়ে ও এক ছেলের পড়াশোনা। ধার-দেনা করে কোনোমতে হাসপাতালের দেয়া ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ জোগাড় করলেও ঢাকায় এসে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারছেন না রফিকুল।
রানা প্লাজার ঘটনার পরের অনেক ঘটনাই স্মরণে নেই তার। ছোট ছেলে আট মাস বয়সী রমজানের জন্মের কথাও জানেন না।
গতবছর ২৪ এপ্রিল রফিকুল যখন রানা প্লাজায় ছুটে আসেন তার স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। ফলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ২১ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর সাভারে ফিরে যেতে হয় তাদের। ঢাকায় চিকিৎসা নেয়ার কথাও স্মরণ করতে পারছিলেন না রফিকুল।
“আমি তাগো মাথা শুতাইসি (হাত বুলিয়ে দিয়েছি)। শুতাইয়া কইসি আমি এক্ষণ আইসা তোগোরে নিয়া যাইতেসি। আমি ওইহান থে খালি বাইরাইসি, বাইরায়া কইসি, এইটা দেও। দিসে, দিয়া গেসি, দেহি মারা গ্যাসে।”
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন গর্ত দিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে রফিকুল বের করে এনেছিলেন জীবিত অনেককে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উদ্ধার কাজের সময় অংশ ‘ডোম’ হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। টেনেছেন মৃতদের লাশ।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পরপরই বিভিন্নভাবে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিলেন মূলত আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষই।
উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া মানবতার টানে ছুটে আসা এই মানুষগুলোর নির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও সে সংখ্যা হাজারের কম হবে না বলেই নানা সূত্রে জানা গেছে। এর সঙ্গে যোগ দেন কয়েকশ’ ফায়ার সার্ভিসকর্মী।
এই ধরনের উদ্ধারকাজে অংশ নেয়ার পরে প্রশিক্ষিত ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের তেমন কোনো মানসিক সমস্যা হয়নি বলেই জানালেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান।
রানা প্লাজার পাশের একটি রেস্তোরাঁয় বসে সাভারের বাসিন্দা কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান খান বলছিলেন, “আশেপাশের এই দোকানগুলোতে প্রায় মাস দুয়েক কিছু খেতে পারতাম না আমি। মনে হতো খাবারে রক্ত-মাংস লেগে রয়েছে।”
অধরচন্দ্র হাই স্কুলের মাঠে লাশের ব্যবস্থাপনার কাজে সরাসরি যুক্ত থাকা তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী নীরব কথা বলতেই চান না রানা প্লাজা নিয়ে। রানা প্লাজা ধসের সময় এইচএসসি পরীক্ষা চলছিল তার।
সেই সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিতে গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত রাজীব বলেন, “আমার যতটুক মনে পড়ে রাত সাড়ে ১১-১২টার দিকে ঘুম থেকে উঠার পর আমি খাইও নাই। আমি দরজা খুলে ফট করে বের হয়ে গেলাম। ওই রাত্রেই আমি নিজে নিজে সদরঘাট চলে যাই। সারাদিন পাগলের মতো কয়দিন ঘুরসি, আমি নিজেও কইতে পারি না।”
রাজীব বলেন, নিজের এলাকার চেয়ারম্যান নাম আর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা ছাড়া কিছুই বলতে পারতেন না। পরে লোকজন মিলে তাকে শরীয়তপুরে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
“বাড়িতে আমাকে ১২ দিন শিকল দিয়ে আটকায়ে রাখা হইসিলো বলে আমার মায়ের কাছে শুনসি। পরে আমার বাবা, মা আর আমার বড়মামা আমাকে মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে যায়।”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী বলেন, “ডিজাস্টার ভিকটিমদের নিয়ে সাইকোলজিক্যাল সাপোর্ট দেয়াটা আমাদের দেশে নতুনই। কাজটা সাধারণত নিজেরা নিজেরাই করে বা ভলেন্টিয়াররা করে।
“ডিজাস্টারের ফলে শুধু যে হাত-পা ভাঙার ঘটনা ঘটে তা না, অনেক রকমের সাইকিয়াট্রিক প্রবলেম হয়। রানা প্লাজার ঘটনার পরই বলা যায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের সাপোর্ট দেয়া শুরু করেছি আমরা।”
তিনি জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি প্রকল্পের অধীনে এনআইএমএইচ’ রানা প্লাজার ভিকটিম ও স্বেচ্ছাসেবীদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়। এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন মোট ৭৮ জন স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকর্মী।
এদের মধ্যে নান ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা গিয়েছিলো। তাদের মধ্যে সাত জনের একিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, ২৩ জনের পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, পাঁচ জনের বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, চার জনের কনভার্সন ডিজঅর্ডার (হাইপারটেনশন জাতীয় সমস্যা), দুই জনের জেনারেল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, এক জনের প্যানিক অ্যাটাক, এক জনের সাবস্টেন্স অ্যাবিউজ (মাদকাসক্তি), এক জনের ম্যানিক ডিজঅর্ডার এবং আরো কয়েকজনের একাধিক মানসিক সমস্যার লক্ষণ দেখা দিয়েছিল।
এদের মধ্যে ছয়জন এনআইএমএইচে চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে অন্তত দুইজন হাসপাতাল ছাড়ার পরেও নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন।
ওয়াজিউল আলম চৌধুরী জানান, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে সচেতনতা কম হওয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসার পরে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার হারও কম। তবে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
রফিকুলের মতো কারো কারো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলেও রানা প্লাজার বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকর্মী পরবর্তীকালে উপযুক্ত মানসিক চিকিৎসা পাননি। এমনই একজন উদ্ধারকর্মী আফরোজা আক্তার।
রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকে উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া একমাত্র নারী ছিলেন আফরোজা। ঘটনার খবর শুনে নিজের ননদের স্বামীকে খুঁজতে এসে উদ্ধারকাজে অংশ নেন এই পোশাক শ্রমিক।
রানা প্লাজায় উপস্থিত সেনা অফিসাররাও আফরোজার কাজ দেখে অবাক হয়েছিলেন। নয়দিন পর্যন্ত তাকে বারবার ঘুমাতে বলা হলেও কারো কথা শোনেননি আফরোজা। এরপর একেবারেই ক্লান্ত হয়ে পড়লে সেনাবাহিনীর গাড়িতে করেই বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয় তাকে।
আফরোজা বলেন, “বাসায় যাওয়ার পর রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমার মাথার মধ্যে আটকা পড়াদের কথাগুলা শুনতাম সবসময়। রাতে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতাম। কেউ যদি বলতো মেয়ে মানুষ এতো রাতে রাস্তায় কী করো, তাদের বলতাম, আমি রাস্তায় হাঁটলে তোমাদের কী সমস্যা?”
যে বাসায় ভাড়া থাকেন আফরোজা, সেই বাসার মালিক একজন চিকিৎসক। তিনি নিজেই প্রাথমিক অবস্থায় আফরোজাকে চিকিৎসা দেন। পরে বড় ধরনের কোনো মানসিক সমস্যা না হওয়ায় আর বাড়তি চিকিৎসা নেননি তিনি।
তবে এখনো মাঝেমাঝে প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ভোগেন বলে জানালেন আফরোজা।
অধ্যাপক ওয়াজিউল আলম বলেন, “এ ধরনের বিপর্যয়ের পরে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো চিকিৎসকদের রোগীর কাছে যাওয়া। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা তৈরি হয়নি।”