রানা প্লাজাকে ভুলে থাকতে চান রেশমা

কর্মস্থল ওয়েস্টিন হোটেল থেকে এক মাসের ছুটি পেয়েছেন রেশমা আক্তার, এক বছর আগে নয় তলা ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ দিন পর যাকে উদ্ধার করা হয়েছিল।

রিয়াজুল বাশারও আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2014, 02:04 PM
Updated : 22 April 2014, 03:59 PM

ছুটি কাটাতে রেশমা চলে গেছেন সাভারের রাজাসনে ভগ্নিপতির বাড়িতে, যেখান থেকে রানা প্লাজার দুরত্ব মাত্র কয়েকশ’ গজ। গত বছরের ২৪ এপ্রিল এই রানা প্লাজা ধসে ১১৩৫ জন নিহত হন।

আগের কর্মস্থলের এত কাছে থেকেও একবছর আগের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ১৭ দিন কাটানোর কোনো স্মৃতিতেই আর ফিরতে রাজি নন ১৯ বছর বয়সী রেশমা।

“আমি ওই ঘটনা মনেও করতে চাচ্ছি না। মনে করতে আমার খারাপ লাগে, এটা আপনাদের বুঝতে হবে,” মঙ্গলবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন রেশমা।

২৪ এপ্রিল নয়তলা ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর প্রথমে জীবিতদের উদ্ধারে হালকা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়, এরপর জীবিত আর কেউ নেই-এরকম ধরে নিয়ে ২৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয় ভারী যন্ত্রপাতির ব্যবহার।

যখন ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক গলিত লাশ বের হচ্ছিল, তখনি ১০ মে বিকালে তিনতলা থেকে জীবিত বের করা হয় রেশমা আক্তারকে।

এরপর রেশমাকে নিয়ে সাংবাদিকরা ব্যাপক কৌতূহলী হয়ে ওঠে। রেশমা কী খেয়ে ১৭ দিন বেঁচে থাকলেন এবং তার পোশাক এত পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে কেন, তা নিয়ে রেশমাকেই প্রশ্ন করা শুরু করেন।

রেশমার উদ্ধারের কিছুদিন পরই ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড সানডে মিরর রেশমা উদ্ধারের ঘটনা ‘সাজানো’ বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

মিররের বরাত দিয়ে বাংলাদেশর বেশ কয়েকটি দৈনিকেও ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তবে এ প্রতিবেদনটিকে নাকচ করে দেয় উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সেনাবাহিনী।

উদ্ধারের পরপরই রেশমাকে সাভারের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে প্রায় একমাস চিকিৎসা দেওয়ার পর ঢাকা ওয়েস্টিনে চাকরি পান।

রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগ মুহূর্তে রেশমাকে নিয়ে গণমাধ্যমে আবারো আগ্রহ তৈরি হয়েছে। রেশমার সাক্ষাৎকারের জন্য বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই ওয়েস্টিন হোটেলে যোগাযোগ শুরু করেন সাংবাদিকরা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকের পক্ষ থেকে ওয়েস্টিনে যোগাযোগ করা হলে সেখান থেকে জানানো হয়, রেশমা ছুটিতে বাড়িতে আছেন।

এরপর রেশমার ভগ্নিপতি শহীদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাভারে গিয়ে মঙ্গলবার সকালে দেখা মেলে রেশমার।

সাভার বাজার থেকে ধুলোমাখা পথে কয়েকশ’ গজ গিয়েই একটি একচালা টিনের ভাড়াবাড়িতে থাকেন রিক্সাচালক শহীদুল। ডেলটা মোড়ে এসে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পথে শহীদুল জানালেন, গতকাল বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এসেছিল, আরো কয়েকজন এখনি আসবে।

খোঁজ পাওয়ার আগে রেশমার সন্ধান চেয়ে লিফলেট

বাড়ির ভিতরে গিয়ে একটি কক্ষে বসতেই চোখে পড়লো লেমিনেট করা রেশমার সন্ধান চেয়ে একটি লিফলেট, রানা প্লাজা ধসের কয়েকদিন পর যে লিফলেটটি হাতে রেশমার বোন, ভাই পথে পথে ঘুরেছেন বলে জানালেন শহীদুল।

কালো সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে স্কার্ফে মাথা ঢাকা রেশমা বাড়ির বারান্দায় বসে কথা বলতে শুরু করেন।

বর্তমান চাকরি কেমন লাগছে?

আগের চেয়ে ভালো লাগছে। গার্মেন্টসের থেকে অনেক আলাদা।

গার্মেন্টসে ফিরতে ইচ্ছে করে?

গার্মেন্টসে আর কাজ করবো না। অনেক পরিশ্রম ছিল, জীবনটা অনেক কষ্টের। 

রানা প্লাজা ধসের কোনো স্মৃতি মনে করতে পারেন?

মনে করি না। মাঝে মাঝে মনে পড়লে খারাপ লাগে, ভয় পাই।

আগের জীবনের সঙ্গে বর্তমান জীবনের কোনো পার্থক্য-পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন?

হ্যাঁ, অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে অনেক কষ্ট করতাম, অনেক সময় মাকে দেখতে যেতে পারতাম না। তেমন সহায়তা করতে পারতাম না, এখন মা-ভাই বোনদের দেখতে পারি, সবাইকে সময়ও দিতে পারি।

কথা বলার এই পর্যায়ে কয়েকটি টেলিভিশনের সাংবাদিক উপস্থিত হন। রেশমাকে ঘিরে কয়েকটি ক্যামেরা বসানো হয় উঠানে, মাঝখানে রেশমা বসেন একটি চেয়ারে। আর সাংবাদিকরা রেশমার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন খবর শুনে পাড়া-পড়শীরা ভিড় জমিয়ে ফেলেন সেখানে।

এই পর্যায়ে এক টেলিভিশন সাংবাদিক প্রশ্ন শুরু করেন-

ধ্বংসস্তূপে শেষ সময়ের কাজের চিত্র

রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর কী অবস্থায় ছিলেন?

ওই ঘটনা মনে করতে চাচ্ছি না, অনেক খারাপ লাগে, বলতে চাচ্ছি না।

ওইদিন সকালে বাসা থেকে কখন বের হয়েছিলেন?

প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৭টায় বের হতাম। ওইদিনও একই সময় বের হয়েছিলাম.... আপনি বুঝছেন না কেন? আমি মনে করতে চাচ্ছি না। খারাপ লাগলে সেটা বুঝতে হবে। ....আমার অনেক খারাপ লাগে, এজন্য বলতে চাই না।

ধ্বংস্তূপের ভেতরে কী খেয়েছিলেন?

কিছু না কিছু তো খেয়েছিই, না খেয়ে তো আর ছিলাম না। আমি চাচ্ছি, ওই সময়ের কথা মনে না আনতে। যে জিনিসটা খারাপ লাগে ওই জিনিসটা কেন বলব।

মানুষ তো সন্দেহ করে?

অনেকে অনেক কিছুই বলে, শুনেও না শোনার ভান করি। আমার কাছে অনেক খারাপ লাগে, আপনি থাকলে বুঝতেন, কেমন লাগতো।

ওই ঘটনা না বলার জন্য কেউ কি চাপ দিয়েছে?

কারোর প্রেসার নেই।

কেউ কি না বলার জন্য শপথ করিয়েছে?

কেউ শপথ করায়নি।

এসব প্রশ্নের এক পর্যায়ে রেশমার বড় বোন আসমা আক্তার উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তিনি বলতে থাকেন, “কালকেও তো অনেক সাংবাদিক এসেছিল। তারা তো এরকম প্রশ্ন করে নাই। আপনি এভাবে প্রশ্ন করছেন? ও এখনো রাতে একা ঘুমোতে পারে না, ভয় পায়।”

এরপর ওই টেলিভিশন সাংবাদিক থেমে গেলে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে আবার কথা বলতে শুরু করেন রেশমা।

বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে রেশমা

রানা প্লাজায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাদের জন্য কেমন লাগে?

তাদের জন্য অনেক খারাপ লাগে। আমি চাই, সরকার যেন সবসময় তাদের পাশে থাকে। আমিও লেখাপড়া করে, হয়তো খুব বড় কিছু করতে পারবো কি না জানিনা, কিন্তু তাদের পাশে থাকতে চাই।

বাংলাদেশের কারখানাগুলোর মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে চান?

আমি শুধু এটাই চাই আর কোনো কারখানা যেন এভাবে ধসে না পড়ে। মালিকরা যেন কারখানাগুলো শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ ভাবে গড়ে তোলে। শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টা যেন নিশ্চিত হয়।

মালিকরা তো বলছেন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, আপনার কী মনে হয়, আসলেই হয়েছে?

মালিকরা বললেও শ্রমিকরা তো কখনো বলে না। অনেকের সাথে তো আমার কথা হয়। টেলিভিশনেও তো দেখি, কই কোনো পরিবর্তন তো হয়েছে বলে মনে হয় না।

অনেকে তো অনেক রকম কথা বলে আপনার উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে। রাগ লাগে আপনার?

রাগ লাগে না। যারা বলে, তারা তো না জেনে বলে। তারা তো ওখানে থাকেনি। থাকলে বুঝতো। কারো সাথে ঝগড়া বা মারামারি করে তো আমি পারবো না। কেউ সামনে বললে বোঝানোর চেষ্টা করি।

আপনাকে যখন উদ্ধার করা হলো এরপর আপনার বাড়িওয়ালা গণমাধ্যমে বলেছিলো সে আপনাকে ঘটনার দুদিন পরে দেখেছে। এ বিষয়ে কি বলবেন?

হ্যাঁ, আমিও এটা শুনেছি। সে নাকি বলেছে, আমাকে দুদিন পরে উদ্ধার করা হয়েছে, পরে আবার সেখানে ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু যে একবার ওখান থেকে বের হয়ে এসেছে, সে কেন আবার ওখানে যাবে। এটা সম্বন্ধে যার অভিজ্ঞতা নাই, সে বুঝবে না। যারা আমাকে উদ্ধার করেছে, তারা তো দেখেছে আমি সেখানে কী অবস্থায় ছিলাম, কী করছিলাম।

কিভাবে এটা প্রমাণ হবে যে আপনি আসলেই ১৭ দিন পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপে ছিলেন?

এটা এখন কিভাবে প্রমাণ করবো? যারা আমাকে উদ্ধার করেছেন, তারা তো দেখেছেন।

রেশমাকে বের করে আনার ছবি

উদ্ধার পাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কী করেছিলেন মনে আছে? মানে উদ্ধারকর্মীরা কিভাবে বুঝতে পারলো আপনি ভেতরে আছেন?

শেষ মুহূর্তে উদ্ধারকর্মীদের হাঁটাচলার শব্দ পেয়েছিলাম। তখন একটি পাইপ দিয়ে বাড়ি দিতে থাকি। আর জোরে জোরে চেঁচাচ্ছিলাম। তখন উদ্ধারকর্মীরা শুনতে পেয়ে আমাকে বের করে আনে।

আপনাকে যখন বের করা হলো তখন আপনার পরনের কাপড় অনেক পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিলো, এটা কিভাবে হলো?

আমি যখন ভেতরে ছিলাম আমার পরনের সব কাপড় ছিড়ে ফেটে গিয়েছিলো। আমি বের হওয়ার আগে হাতের কাছে যা পেয়েছি, তাই পরেছি। ওখানে অনেকগুলো কাপড় ছিল। সেখান থেকেই নিয়েছিলাম।

সে সময় আপনার চুলও কাটা ছিলো..

হ্যাঁ, চুলে অনেক সময় টান পড়ত, ব্যথা লাগতো তখন। ওখানে কাঁচি ছিল, কাঁচি দিয়ে চুল কেটেছিলাম। এত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন! আসলে আপনি যদি ওখানে থাকতেন বা উদ্ধার করতেন তাহলে বুঝতেন।

এ ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের কী ধরনের শাস্তি চান?

আমি চাই, তাদের দ্রুত শাস্তি হোক। তাদের এতদিনে ফাঁসি দেয়া উচিত ছিল। এত লোক যাদের জন্য মারা গেল, তাদের কঠিন শাস্তি দেয়া হোক।

রেশমা জানালেন, আগের গার্মেন্টসের চাকরির চেয়ে বর্তমানের চাকরিতে তিনি বেশি বেতন পাচ্ছেন। চাকরির পাশাপাশি লেখাপড়াও চালিয়ে যেতে চান তিনি। সম্প্রতি গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ঐশিবাড়ি থেকেও ঘুরে এসেছেন চার বছর আগে পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করা রেশমা, যেখানে অনেকেই তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন বলে জানান তিনি।