সেজে উঠছে ‘এলোমেলো’ পোশাক শিল্প

রানা প্লাজা ধসের পরপরই সবচেয়ে সমালোচিত বিষয় কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করার বড় তাগাদাটি আসে ক্রেতাদের দিক থেকে।

রিয়াজুল বাশারও আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2014, 08:44 PM
Updated : 23 April 2014, 10:09 PM

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতারা অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামে দুটি জোট গঠন করে।

পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশের ওপর তাদের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নিতে সরকার গঠন করে রিভিউ কমিটি।

দেশের সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি সক্রিয় পোশাক কারখানার মধ্যে অ্যালায়েন্স ৭০০ ও অ্যাকর্ড ১৬১৯টি কারখানার কর্মপরিবেশ খতিয়ে দেখছে। কারখানাগুলো দেশে তৈরি পোশাকের ৮৬ শতাংশ উৎপাদন করছে, যা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হয়।

এই জোট ইতোমধ্যে প্রায় ৭০০ কারখানা পরিদর্শন শেষে তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে রিভিউ প্যানেলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব থাকায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের চারটি ভবনের ১৩টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

সাড়ে তিন দশক আগে বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা হাফিজ আহমেদ মজুমদার মনে করেন, শুরুর দিকটায় অনেকটা অসংগঠিত হলেও বর্তমানে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তারা কমপ্লায়েন্স ইস্যুকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বমানের কারখানা গড়ে তোলার বিষয়ে মনোযোগী হয়েছেন এবং ৯০ শতাংশ কারখানা ভালো ভবনে অবস্থিত। 

গত বছরের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে সেখানকার ৫টি পোশাক কারখানার ১১৩৫ জন শ্রমিক নিহত হন, যা পৃথিবীতে ভবন ধসে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা। এ ঘটনার কয়েক মাস আগেই আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ১১১ জন নিহত হন।

এরপরই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা নিয়ে সারা পৃথিবীতে হৈ চৈ শুরু হয়।

‘অনিরাপদ পরিবেশ’ থেকে পোশাক নেয়া পশ্চিমা ক্রেতারা নিজ নিজ দেশে সমালোচনা মুখে পড়ে। গত জুনে কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নেই এমন কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাতিল করা হয়।

এতো সমালোচনা গায়ে নিয়ে চাহিদার জোরে দাঁড়িয়ে থাকে পোশাক রপ্তানি।

বাণিজ্য ও শিল্প নীতি বিষয়ক শীর্ষ একজন গবেষক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রানা প্লাজা ধসের পর যে ভয়টা হয়েছিল সেটা কেটে গেছে। ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করতে পেরেছি আমরা।”

সমন্বিত উদ্যোগ

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে বড় বড় শিরোনামের পর ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী পোশাক খাতের জন্য সরকার, উদ্যোক্তা, বিদেশি ক্রেতা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও শ্রমিকদের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ খাতকে এগিয়ে নেয়ার নানা উদ্যোগের বাস্তবায়ন শুরু হয়।

এর মধ্যে রয়েছে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি, আইনকানুন ও নানা ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার এবং আইনের প্রয়োগ।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান একে দেখছেন ঘুরে দাঁড়ানোর নজির হিসেবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অতীতে এতো বড় দুর্ঘটনাও ঘটেনি, এতো বড় উদ্যোগেরও প্রয়োজন পড়েনি। এই যে সমন্বিত একটা কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে দুর্ঘটনার বাস্তবতাটাকে বিবেচনায় রেখে, এটাকে এক কথায় আমি বলবো অভূতপূর্ব।”

রানা প্লাজার ঘটনার পরই অগ্নিনির্বাপনের ওপর সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ অ্যাকশন প্ল্যান এবং সরকারের গঠিত বিভিন্ন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের কাজ চলছে। 

কারখানার কমপ্লায়েন্স ইস্যুটি যথাযথ গুরুত্ব পেয়েছে বলে মানছেন বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কমপ্লায়েন্স ইস্যু বলতে আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এবং এই পরিবেশ তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

ফাইল ছবি

বেড়েছে বেতন

গত ডিসেম্বর থেকে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন প্রায় ৭৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩০০ টাকা করা হয়।

বহুল আলোচিত ট্রেড ইউনিয়ন ইস্যুতেও নমনীয় হয়েছে সরকার ও কারখানা মালিকরা।

কারখানায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নতুন আইন করা হয়েছে। শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার সুবিধা বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৩৮টি পোশাক কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন গত চার মাসে বেড়ে ১৮০টির বেশি হয়েছে।

নজরদারিতে উন্নতি

কারখানা পরিদর্শন অফিসের ব্যাপক সংস্থার করে এর লোকবল কয়েক গুণ বাড়ানো হয়েছে, ২৩টি পরিদর্শক টিম গঠন করে ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কারখানা পরিদর্শন করা হয়েছে।

নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে, বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে অগ্নিনির্বাপন খাতে, শ্রমিক কল্যাণেও নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ।

একই ভবনে বিভিন্ন ধরনের কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলে সেই ভবনের কারখানা থেকে (শেয়ার্ড বিল্ডিং) ভবিষ্যতে পোশাক কেনার বিষয়ে ক্রেতাদের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

এটা মাথায় রেখেই দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের জন্য ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জে সরকার একটি পোশাক শিল্প পল্লী গড়ে তোলারও উদ্যোগ নিয়েছে।

বিদেশি ক্রেতাদের কড়া নজরদারি পোশাক শিল্প মালিকদের অনেকে ভালো চোখে না দেখলেও বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশের সিংহভাগ কারখানা কর্মপরিবেশের উন্নতি ও শ্রমিক অধিকার মেনে টিকে থাকবে। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আগে অনেক জায়গা থেকে এমনভাবে বলা হতো যেন বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ফ্যাক্টরি খারাপ। আসলে কিন্তু তা না। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শন করা প্রায় ৭০০ ফ্যাক্টরির মাত্র ১৩টা ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়েছে। তার মানে সিংহভাগ ফ্যাক্টরিই কিন্তু ভালো।”

দাম বাড়ানোর দাবি

কমপ্লায়েন্ট কারখানার বিপরীতে পোশাকের দাম বাড়ানোর দাবি তুলছেন মালিকরা।

আতিকুল ইসলাম বলেন, “গত এক বছরে আমাদের পোশাক উৎপাদনে খরচ বেড়েছে ১৮ শতাংশ, অন্যদিকে ইউরোপ, আমেরিকাতে পোশাকের দাম কমেছে ৭ শতাংশ। তাই ক্রেতাদের বলবো পোশাকের দাম বাড়াতে।”

মালিকদের এ দাবির বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি নেই ক্রেতাদের।

পোশাকের দাম বাড়ানোকে রপ্তানিকারকদের দর কষাকষির দক্ষতা হিসেবেই দেখছেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত।

তিনি বলেন, “সমস্যাটা আমাদের দিকে। ক্রেতারা প্রতিযোগিতা করে মূল্য কমিয়ে ফেলে।”

সম্ভাবনা

ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সেরা অবস্থানে চলে যাবে।”

ক্রেতাদের উদ্যোগে নতুন সম্ভাবনা দেখছেন মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, “অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে পোশাক খাতকে ইমপ্রুভ করতে চাচ্ছে। এই সুযোগটাও কাজে লাগাতে হবে। তাদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে কমপ্লায়েন্সকে কিভাবে শক্তিশালী করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।”

সম্ভাবনা দেখছেন গবেষক নাজনীনও।

তিনি বলছেন, “মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো অশুল্ক বাধা। আর কমপ্লায়েন্স ইস্যুকেই কেন্দ্র করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বাধা আরোপ করা হয়। শ্রীলঙ্কা এই ইস্যুকে ব্যবহার করে বাণিজ্য বৃদ্ধি করছে, কমপ্লায়েন্সের উন্নতি ঘটিয়ে তারা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে।”

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে দেশের রপ্তানি ৭০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

পোশাক শিল্প উদ্যোক্তা ও বর্তমানে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ।

“গতবছর রাজনৈতিক অস্থিরতা, রানা প্লাজা ধসের মতো ঘটনার পরও পোশাক রপ্তানিতে অভাবনীয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এ প্রবৃদ্ধি আরো বাড়বে। আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে পোশাক রপ্তানি বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে।”

আত্মবিশ্বাসী হাফিজ রানা প্লাজা ধসকে সামগ্রিক পোশাক শিল্পের বিপুল অগ্রগতির মধ্যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই দেখছেন।