নারায়ণগঞ্জের স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনায় মন্ত্রী থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এ কে এম সেলিম ওসমানের শাস্তি দাবি করলেও ওই ঘটনায় এই সংসদ সদস্যের কোনো দোষ পায়নি পুলিশ।
Published : 07 Aug 2016, 06:43 PM
এই শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করাতে নির্দেশ দিতে জাতীয় পার্টির এই সংসদ সদস্যকে দেখা গেলেও তিনি ‘পরিস্থিতির শিকার’ বলে হাই কোর্টে দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এই ঘটনায় কাউকে জড়িয়ে কারও কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে বলেছেন, এজন্য কারও বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে গত ১৩ মে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লাঞ্ছিত করার ঘটনাটি প্রকাশ পেলে দেশজুড়ে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়।
ওই ঘটনার ভিডিওতে ওই শিক্ষককে কান ধরে উঠ বসের নির্দেশ দিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানকে দেখা গেলে তার শাস্তির দাবিও উঠে। তবে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের এই সদস্য শুরু থেকেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আসছিলেন।
ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন নজরে আসার পর হাই কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেয়।
আদালতের নির্দেশনায় ২৯ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বন্দর থানার ওসির প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ, যা দায়সারা বলে অসন্তোষ জানিয়েছিল আদালত।
এরপর ৮ জুন জেলা প্রশাসক নতুন করে প্রতিবেদন দেন হাই কোর্টে। ওই ঘটনার করা জিডির পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে অগ্রগতি আছে জানিয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ও বন্দর থানার ওসি ৬০ দিন সময় চেয়ে আবেদন করেন।
আদালত তখন স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে লাঞ্ছনার ঘটনায় করা জিডির তদন্তে আসা ফল হলফনামা আকারে ৪ অগাস্ট আদালতে দাখিল করতে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার ও বন্দর থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়।
রোববার ওই প্রতিবেদন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাই কোর্ট বেঞ্চে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ওই প্রতিবেদনটি দাখিল ও পড়ে শোনান ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। অন্যপক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান।
পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার বিষদ বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, “স্থানীয় সাংসদ এ কে এম সেলিম ওসমান ওই দিন ১৫.৪৫ ঘটিকার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে উত্তেজিত জনতা প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিচারের দাবিতে পুনরায় উত্তেজিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকে।
“তখন পুলিশ উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করার সময় প্রধান শিক্ষককে জনগণের রোষানল থেকে রক্ষার জন্য উত্তেজিত জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কান ধরে ওঠ-বস করার ঘটনাটি আকস্মিকভাবে ঘটে।”
“ওই ঘটনার জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ও স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান দুজনই উদ্ভূত ঘটনায় পরিস্থিতির শিকার। ওই ঘটনা সংক্রান্তে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট (পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়) কারোই কারও বিরুদ্ধে কোনোরূপ অভিযোগ না থাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় আকস্মিকভাবে ওই ঘটনাটি হয়েছে বলে জানা যায়।”
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তদন্তকালে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তসহ ১১ জনের জবানবন্দি নেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা।
এসব জবানবন্দিসহ তদন্ত প্রতিবেদন গত ২ অগাস্ট নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত দাখিল করে পুলিশ। আদালত পরদিন তা নথিভুক্ত করেন।
“এ আদেশ ও জিডির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছি ও পড়ে শুনিয়েছি,” বলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
হাই কোর্ট ১০ অগাস্ট পরবর্তী আদেশের জন্য দিন রেখেছে বলে জানান তিনি।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনা আইনজীবী এম কে রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি বলেছি দাখিল করা ওই প্রতিবেদনটি সার্বিক বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য নয়। আদালত মন্তব্য করেছেন, তাহলে মাস্টার মাইন্ড কারা? ঘটনা কারা ঘটাল?-তা আসেনি।”
নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত ৩ অগাস্ট দেওয়া আদেশে বলেছে, “জিডির বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।… তদন্তকালীন সাক্ষিপ্রমাণে জিডির ঘটনার বিষয়ে কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। দেখিলাম। শুনিলাম। নথি ও আইও এর প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে ঘটনার বিষয়ে সত্যতা না পাওয়ায় জিডিটি নথিজাত।”
ওই ঘটনার পর দায়ীদের শাস্তি দাবি ওঠার পর নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন তখন বলেছিলেন, তিনি কোনো ‘ফৌজদারি অপরাধ’ দেখছেন না। ওই ঘটনায় পুলিশের কিছু ‘করার ছিল না’।
ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে আসা প্রতিবেদন ১৮ মে আদালতের নজরে এনেছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান ও মহসীন রশিদ। সেদিনই আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেয়।
সাংসদ সেলিম ওসমানসহ ওই ঘটনায় যাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। পাশাপাশি ওই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে কী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছ- তাও জানতে চাওয়া হয়।
‘মিথ্যা গুজবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা’
পুলিশের প্রতিবেদনে শ্যামল কান্তির জবানবন্দি যুক্ত রয়েছে; যাতে তিনি বলেছেন, তিনি ও সেলিম ওসমান ‘উদ্ভূত পরিস্থিতির শিকার’।
চিকিৎসা শেষে গত ১০ জুলাই কর্মস্থলে যোগদানের পর শ্যামল কান্তির জবানবন্দি নেওয়া হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
“আমি এবং এমপি সেলিম ওসমান উদ্ভূত ঘটনায় পরিস্থিতির শিকার। একটি মিথ্যা গুজবের কারণে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে। এই ঘটনায় আমি কাউকে দোষারোপ করছি না এবং এই ঘটনায় আমার কারও বিরুদ্ধে কোনোরূপ অভিযোগ নাই। এই ঘটনায় পুলিশ বা আদালতে কোনো অভিযোগ বা মামলা করব না।”
এছাড়া বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান মুকুল, কল্যান্দী পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মাসুম মিয়া, কলাগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন প্রধান, বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুর রশিদ, কল্যান্দী পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. ফারুকুল ইসলাম, কমিটির সদস্য মো. মতিউর রহমান মেজু, কমিটিতে অভিভাবক প্রতিনিধি মোবারক হোসেন, বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. মোশাররফ হোসেন, মো. আনোয়ার হোসেন ও উত্তম কুমার গুহর বক্তব্য নেওয়া হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে আসা তথ্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮ মে বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে মারধর এবং কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানিকর মন্তব্যের ঘটনা নিয়ে ১৩ মে সকাল সাড়ে ১০টায় বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির উন্নয়ন সভায় প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে বিষয়টি নিষ্পত্তির উদ্যোগ চলছিল।
“কটূক্তিকারী প্রধান শিক্ষকের বিচার স্কুলে হবে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়লে (জুম্মার নামাজের আগে মাইকে প্রচার হওয়ায়) এলাকার এবং পাশ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লোক ওই বিদ্যালয়ে জড়ো হন।এ সময় উত্তেজিত জনতার মধ্যে কতিপয় ব্যক্তি প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে। এ খবর পেয়ে বন্দর থানা পুলিশ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও এলাকার জনপ্রতিনিধি ও গণমান্য লোকজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।”
“সর্বশেষ স্থানীয় সাংসদ এ কে এম সেলিম ওসমান ১৫.৪৫ (পৌনে চারটায়) ঘটিকার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে উত্তেজিত জনতা প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিচারের দাবিতে পুনরায় উত্তেজিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। তখন পুলিশ উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করার সময় প্রধান শিক্ষককে জনগণের রোষানল থেকে রক্ষার জন্য উত্তেজিত জনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কান ধরে ওঠ-বস করার ঘটনাটি আকস্মিকভাবে ঘটে।”
“ওই ঘটনার জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত ও স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান দুইজনই উদ্ভূত ঘটনায় পরিস্থিতির শিকার। ওই ঘটনা সংক্রান্তে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট (পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়) কারোই কারও বিরুদ্ধে কোনোরূপ অভিযোগ না থাকায় উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় আকস্মিভাবে ওই ঘটনাটি হয়েছে বলে জানা যায়।”
ওই ঘটনার পর সেলিম ওসমান এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, শিক্ষক শ্যামল কান্তি ঘটনার পর তার কাছে এক কোটি টাকা দাবি করেছিলেন।
ওই ঘটনার পর শিক্ষক শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে এমপিওভুক্তির প্রলোভন দেখিয়ে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তুলে তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মামলা করেন, যা নারায়ণগঞ্জের আদালতে শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।
এছাড়া শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে কথিত নির্যাতিত ছাত্রের মায়ের একটি এবং ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে করা আরেকটি মামলার আরজি নারায়ণগঞ্জের আদালত খারিজ করে দেয়।