৭ খুনের মামলার অভিযোগপত্রে ‘ক্রটি’ দেখছে হাই কোর্ট 

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলার অভিযোগপত্রে ‘ত্রুটি রয়েছে’ বলে মন্তব্য এসেছে উচ্চ আদালত থেকে, যে অভিযোগপত্র নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন মামলার বাদী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2015, 03:31 PM
Updated : 6 Dec 2015, 11:05 AM

অধিকতর তদন্ত চেয়ে বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটির করা একটি আবেদনের উপর শুনানির সময় মঙ্গলবার অভিযোগপত্রে ত্রুটির কথা বলেন হাই কোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।

যে বেঞ্চে এই আবেদনের শুনানি চলছে, তার জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম। বেঞ্চের অন্য বিচারক হলেন বিচারপতি আমির হোসেন।

অভিযোগপত্রে ত্রুটির কথা বললেও অধিকতর তদন্তের ফাঁকে বিচার বিলম্বিত না হওয়ার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিয়েছে হাই কোর্ট।

আদালত আগামী রোববার পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছে। সেদিন উভয় পক্ষকে অভিযোগপত্র হয়ে যাওয়ার পর অধিকতর তদন্তের সুযোগ আছে কি না, সে বিষয়ে আইনগত দিক দেখে আসতে বলা হয়েছে।

২০১৪ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও তার চার সঙ্গী এবং আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালককে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।

তখন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা নারায়ণগঞ্জের আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেন। সেই সঙ্গে র‌্যাবের কর্মকর্তাদেরও হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলে নজরুলের পরিবার।

তদন্তে র‌্যাবের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ উঠে আসার পর দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও আলোচনায় ওঠে এই হত্যাকাণ্ড।

প্রায় এক বছর পর গত ৮ এপ্রিল নূর হোসেন ও র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় গোয়েন্দা পুলিশ, যাতে বাদ পড়েন এজাহারের পাঁচ আসামি।  

নূর হোসেন বাদে অন্য আসামিদের বাদ দেওয়ায় অভিযোগপত্র প্রত্যাখ্যান করে নারাজি আবেদন করেন বাদী সেলিনা। নারায়ণগঞ্জের আদালত তা খারিজ করে দেওয়ার পর হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন তিনি।

গত ২৩ নভেম্বর হাই কোর্টে করা ওই আবেদনের উপর ২৯ নভেম্বর শুনানি নিয়ে ১ ডিসেম্বর পরবর্তী দিন রাখে আদালত।

শীতলক্ষ্যা থেকে লাশ তোলার পর শোকাতুর স্বজনরা

মঙ্গলবার শুনানির শুরুতে নিহত নজরুলের স্ত্রীর করা নারাজি আবেদন নিম্ন আদালতে নামঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন তার আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার।  

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘ওয়েল রিজন’ দেখিয়ে অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে বাদীর নারাজি আবেদন নিম্ন আদালত খারিজ করেছে দেখা যাচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে ভুলটা কোথায়? বলেছে, আসামির নাম-পরিচয় পাওয়া গেলে দেওয়া যাবে।

তখন বাসেত মজুমদার বলেন, মামলার বাদী যদি এজাহারে কারও নাম বলে থাকলে সাধারণত অভিযোগপত্রে সেই নাম থাকা উচিত। তবে পুলিশ যে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে, সেখানে কারও নাম রয়েছে, আবার কারও নাম বাদ দিয়েছে।

“ঘটনার হোতা ষড়যন্ত্রকারী মামলার তদন্তকালে দেশে ছিল না। সরকার তাকে ফিরিয়ে এনেছে। এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে।..এজন্য অধিকতর তদন্ত চাচ্ছি।”

হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন নূর হোসেন। সেখানে ধরা পড়ার পর দুই দেশের আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্প্রতি তাকে ফেরত আনা হয়।

বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এরপরে যার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র হয়েছে, সেই আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের কোনো নজির আছে কি? আইন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

“বিশাল মামলা। সবকিছু অর্জন করতে গিয়ে মামলার বিচার যদি কোনো কারণে বিলম্বিত হয়, তাহলে যারা ভেতরে (কারাগারে) রয়েছে, তারা তো বেনিফিট নেওয়ার চেষ্টা করবে? আবার এটিও সত্য, যারা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদেরও বিচার হওয়া দরকার।”

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক ইনায়েতুর রহিম বলেন, বলেন, ‘অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখেছি, মনে হয়েছে এতে মারাত্মক ক্রটি রয়েছে। আপনারা দেখেন। যদিও ত্রুটির বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে বলছি না। ওই সেন্সে ডিফেক্ট না। আপনারা অভিযোগপত্রটি ভালো করে দেখুন।”

তখন বাসেত মজুমদার অভিযোগপত্র পর্যালোচনার জন্য সময় চাইলে আদালত রোববার শুনানির দিন রাখে।

শুনানিতে বাসেত মজুমদারকে সহায়তা করেন আইনজীবী মন্টু ঘোষ। রাষ্ট্র পক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ এ কে এম মনিরুজ্জামান কবির ও সহকারী অ্যার্টনি জেনারেল শহীদুল ইসলাম।

আবেদনকারী সেলিনাও উপস্থিত ছিলেন এজলাসে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে স্বামীর ওয়ার্ডে এখন তিনি কাউন্সিলর।

যে পাঁচজনের নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ পড়ায় তার আপত্তি, তারা হলেন- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন আশিক ও ইকবাল হোসেন।

তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মামুনুর রশিদ মণ্ডল অভিযোগপত্র দেওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেছিলেন, “নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, পেশাদারিত্ব ও ত্রুটিমুক্তভাবে অভিযোগপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে।”

তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানা

নূর হোসেন

এই হত্যাকাণ্ডের পর হাই কোর্টের নির্দেশেই র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, এম এম রানা ও আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রশাসন তদন্ত কমিটিও করে আদালতের নির্দেশে।

সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত এই তিন কর্মকর্তা ছাড়া আসামিদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন নূর হোসেন, মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশার, র‌্যাব সদস্য এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এএসআই  বজলুর রহমান ও আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার এমদাদুল হক ও নাসির উদ্দিন, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন ও বাবুল হাসান, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, বেলাল হোসেন, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন, সিপাহী আবু তৈয়ব, নুরুজ্জামান ও আসাদুজ্জামান নূর।

র‌্যাবের সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই  কামাল হোসেন, কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আব্দুল আলিম, মহিউদ্দিন মুন্সী, আল আমিন শরীফ, তাজুল ইসলাম ও কনস্টেবল হাবিবুর রহমান পলাতক।

এছাড়া নূর হোসেনের সহযোগী বন্দর উপজেলার কুড়িপাড়া এলাকার সেলিম ভারতের কারাগারে আটক রয়েছেন।

গত বছরের ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর তাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে পাওয়া যায়

নিহত অন্যরা হলেন- নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।

তদন্তে উঠে এসেছে, সেদিন দুপুরের পর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে নজরুলকে অপহরণের পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু দেখে ফেলায় চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালককেও তুলে নেওয়া হয়।