৭ খুনের মামলায় ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেন এবং র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।

মজিবুল হক পলাশ, নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2015, 12:29 PM
Updated : 8 April 2015, 04:44 PM

হত্যাকাণ্ডের প্রায় এক বছর পর বুধবার নারায়ণগঞ্জের আদালতে এই অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামনুর রশিদ মণ্ডল।

র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন ও এম এম রানার সঙ্গে এই বাহিনীর ২৫ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।

২০১৪ সালের এপ্রিলে এই হত্যাকাণ্ডের সময় র‌্যাব-১১ এর অধিনায়কের দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা।

বাকি ১০ আসামির মধ্যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর নুর হোসেন বর্তমানে ভারতে কারাবন্দি। তাকে ফেরত আনার চেষ্টা চলছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

অভিযোগপত্রে তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন আরেক কাউন্সিলর নুর হোসেন।

তবে নুর হোসেনের সঙ্গী আরও পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়ায় অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন দেবেন বলে জানিয়েছেন নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম।

নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম চাঁদনী রূপমের আদালতে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের দুই মামলায় অভিযোগপত্র জমা পড়ে।

নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের পরিবার একটি মামলা করে, অন্য মামলাটি করেন নিহত আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের পরিবার। 

আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কেএম ফজলুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, অভিযোগপত্র গ্রহণ করে বিচারক আগামী ১১ মে অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন রেখেছেন।

দুই মামলায় ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে এবং ১৬২টি আলামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী। দুটি বস্তায় ভরে আলামতগুলো আদালতে নেওয়া হয়।

অভিযোগপত্র দেওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, “৭ খুনের মামলাটি তদন্তের জন্য ১১ মাস খুব বেশি সময় নয়, আবার কমও নয়। নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা, পেশাদারিত্ব ও ত্রুটিমুক্তভাবে অভিযোগপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে।”

হত্যাকাণ্ডের কারণ কী পাওয়া গেছে- জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “নজরুলের সঙ্গে নুর হোসেনের প্রভাব প্রতিপত্তিসহ বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্ব ছিল। তার জের ধরে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অভিযুক্ত র‌্যাব সদস্যদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।”

র‌্যাব কর্মকর্তার ৬ কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, “টাকা লেনদেন হয়েছে। তবে টাকার পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।”

গত বছরের ২৭ এপ্রিল কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। তিন দিন পর তাদের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে পাওয়া যায়

নিহত অন্যরা হলেন- নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।

তদন্তে উঠে এসেছে, সেদিন দুপুরের পর ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে নজরুলকে অপহরণের পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু দেখে ফেলায় চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালককেও তুলে নেওয়া হয়।

নিহত ৭ জন

নদী থেকে তোলা হচ্ছে লাশ

লাশ উদ্ধারের পর নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, র‌্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।

নজরুলের শ্বশুর এই অভিযোগ তুললে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জে দায়িত্বরত র‌্যাব কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করলেও পরে বাহিনীর তদন্তেই অভিযোগের সত্যতা আসতে থাকে।

বিষয়টি হাই কোর্টে গড়ালে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয় তিন র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানাকে। পরে তাদের সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়।

ঘটনার পর নুর হোসেন গোপনে পালিয়ে গেলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সে দেশের পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তার বিরুদ্ধে সেখানে মামলাও হয়েছে।  

তদন্তে উঠে এসেছে, এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের জের ধরে নুর হোসেন র‌্যাবকে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক আরেক কাউন্সিলর নজরুলকে খুন করান। 

হাই কোর্টের নির্দেশে পুরো ঘটনার তদন্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান আলী মোল্লাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এই কমিটির সদস্য সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন গত সপ্তাহে বলেছেন, তাদের তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছে। শিগগিরই তা জমা দেবেন।

১৩ আসামি পলাতক

অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের মধ্যে র‌্যাবের আট সদস্যসহ ১৩ পলাতক বলে তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ উল্লেখ করেছেন।

তারেক সাঈদ, আরিফুর ও রানা

সাবেক সেনা কর্মকর্তা তারেক সাঈদ ও আরিফ হোসেন এবং সাবেক নৌকর্মকর্তা রানা কারাগারে রয়েছেন। নুর হোসেনও ভারতের কারাগারে।

কারাবন্দি অন্য আসামিদের মধ্যে সাবেক র‌্যাব সদস্যরা হলেন- এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এএসআই বজলুর রহমান, আবুল কালাম আজাদ, হাবিলদার এমদাদুল হক ও নাসির উদ্দিন, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, বাবুল হাসান, আরজিওয়ান আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, বিল্লাল হোসেন, রুহুল আমিন, সিপাহী আবু তৈয়ব, নুরুজ্জামান ও আসাদুজ্জামান নূর।

নুর হোসেনের সহযোগীদের মধ্যে কারাবন্দি আসামিরা হলেন- মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী ও আবুল বাশার।

এই ২২ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। তারেক সাঈদ, আরিফ ও রানাসহ কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। 

পলাতক ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দিন জানান, যিনি এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব নিয়ে আসেন।

হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কিংবা এজাহারে নাম ছিল- এরকম ১৬ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সেলিনার প্রত্যাখ্যান

স্বামী হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র দেওয়ার খবর শুনে আদালতে ছুটে আসেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি।

কলকাতায় গ্রেপ্তার নূর হোসেন

হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যে মামলাটি করেছিলেন, তাতে নুর হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করেছিলেন। তাদের মধ্যে নুর হোসেন ছাড়া অন্য পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়ায় আপত্তি সেলিনার।

স্বামীর ওয়ার্ডে উপনির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া সেলিনা সাংবাদিকদের বলেন, “নুর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই অভিযোগপত্র দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ নুর হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে জানা যাবে, এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় আর কারা কারা জড়িত।”

সেলিনার মামলায় আসামির তালিকায় ছিলেন- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, হাসমত আলী হাসু, আমিনুল ইসলাম রাজু, আনোয়ার হোসেন আশিক ও ইকবাল হোসেন

অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে আদালতে না-রাজি আবেদন দেবেন বলে জানান মামলার বাদী সেলিনা।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “আমরা অভিযোগত্রের অনুলিপি সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে বাদীর মতামত নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।”

এদিকে পুলিশ সুপার মহিদ উদ্দিন বলেন, “অভিযোগপত্রে দোষী কাউকে বাদও দেওয়া হয়নি। আবার অহেতুক কাউকে জড়ানোও হয়নি। স্বাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সব কিছু করা হয়েছে।”