নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর অপহৃত, আইনজীবী নিখোঁজ

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওয়ামী লীগ সমর্থক কাউন্সিলরকে র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ করা হয়েছে বলে তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছে।

গাজীপুর প্রতিনিধিনারায়ণগঞ্জ ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2014, 02:27 PM
Updated : 11 Dec 2014, 01:37 PM

রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড থেকে চার সহযোগীসহ অপহৃত নজরুল ইসলাম সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র। তার বিরুদ্ধে জোড়া খুনের অভিযোগসহ অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে।

এদিকে নজরুল অপহৃত হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার। আইনজীবীদের সন্দেহ, নজরুল অপহরণের সঙ্গে এই আইনজীবীর নিখোঁজ হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে।

২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি র‌্যাব পরিচয়ে তার স্বামীকে তুলে নেয়ার অভিযোগ করলেও এই বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা কাউকে গ্রেপ্তার করেননি।

নজরুলের সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। রাতে গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় এই কাউন্সিলরের গাড়িটি পাওয়া গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের ভূঁইগড় থেকে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিককে তুলে নেয়ার ১২ দিনের মাথায় কাউন্সিলর অপহরণের ঘটনা ঘটল।

নজরুলের পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, দুপুরে একটি মামলায় জামিন নিয়ে কাউন্সিলর নজরুল সহযোগীদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জের আদালতপাড়া থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছিলেন। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে তাদের তুলে নেয়া হয়।

নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য নজরুলের সঙ্গে অপহৃত অন্যরা হলেন- তার প্রাইভেটকারের চালক জাহাঙ্গীর, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহসভাপতি তাজুল ইসলাম, ৭নং ওয়ার্ড যুবলীগকর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন ও লিটন।

অপহরণের পর বিকালে নজরুলের সমর্থকরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের সাইনবোর্ড এলাকায় আধাঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে। তারা ১০/১২টি যানবাহন ভাংচুরও করে। পরে পুলিশ ও র‌্যাব গিয়ে লাঠিপেটা করে তাদের তুলে দেয়।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, কাউন্সিলর নজরুল ও তার ৪ সহযোগীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে তার স্ত্রী মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অপহৃত সবাইকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃতি দিয়ে নজরুলের স্ত্রী সেলিনা সাংবাদিকদের বলেন, র‌্যাব পরিচয়ে তার স্বামীকে তুলে নেয়া হয়েছে।

স্বামীকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

নজরুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না- জানতে চাওয়া হলে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারিক সাইদ মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, এই ঘটনায় র‌্যাব সম্পৃক্ত নয়।

দুপুর পৌনে ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি মামলায় জামিন নিয়ে নজরুল ও তার চার সঙ্গী একটি সাদা রঙের টয়োটা করোলা প্রাইভেটকার নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হন।

সেলিনা বলেন, “পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোড থেকে অপহৃত হন তারা। তার (নজরুল) মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।”

সেলিনার অভিযোগ, ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেন ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মো. ইয়াসিনসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তার স্বামীর বিরোধ রয়েছে।

“নুর হোসেন ও ইয়াসিন এলাকায় জমি দখল, মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির করে আসছিলেন। আমার স্বামী এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করার কারণেই তাকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।”

সেলিনা বলেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সিটি কর্পোরেশনের একটি রাস্তা প্রশস্তকরণ কাজকে কেন্দ্র করে নুর হোসেনের ফুফাতো ভাই মোবারকের সঙ্গে নজরুলের বিরোধ ও বাগবিতণ্ডা হয়।

ওই ঘটনার পর নূর হোসেনের আত্মীয় মোবারক বাদী হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নজরুলের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। সেই মামলায় নিম্ন আদালতে হাজির হয়ে জামিন পেয়ে তিনি ঢাকায় যাচ্ছিলেন।

সেলিনার দাবি, এই অপহরণকাণ্ডে নূর হোসেনেরও হাত রয়েছে।

এ বিষয়ে নূর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নজরুলের স্ত্রীর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমি এই ঘটনায় কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই।”

পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম আরো জানান, নজরুল অপহরণের খবর শোনার পর তার সমর্থকরা বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংকরোডের সাইনবোর্ড সড়ক অবরোধ করে। ভাংচুর করা হয়েছে ১০/১২টি যানবাহন।

এই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা এ কে এম শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, “নুর হোসেন ও নজরুল ইসলামের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, কিন্তু এ নিয়ে অপহরণ ও গুমের মতো ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমার মনে হয় না।”

নজরুল অপহরণের ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে তাকে উদ্ধারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, র‌্যাব ও পুলিশকে অনুরোধ করেন এই সংসদ সদস্য।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল মতিন জানান, নজরুলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একটি জোড়া খুনসহ অন্তত ১৫টি মামলা এবং বহু সাধারণ ডায়রি (জিডি) রয়েছে।

ঢাকার ধানমণ্ডিতে অ্যাডভোকেট বাবর আলী হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে নজরুলের ফাঁসির দণ্ড হলেও উচ্চ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান। 

গাজীপুরে গাড়ি উদ্ধার

নজরুলের প্রাইভেটকারটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রাত সাড়ে ৯টার দিকে গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার রাজেন্দ্রপুর শালবন এলাকায় পাওয়া যায়।

হোতাপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, শালবনের পাশে একটি ব্যক্তিগত গাড়ি পড়ে থাকতে দেখে এলাকাবাসী পুলিশে খবর দেয়।

রাজেন্দ্রপুর-কাপাসিয়া সড়কের পাশে শালবন এলাকায় পড়ে থাকা গাড়িতে নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীরের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেছে। 

গাড়ির ভেতরে এক নারীর জাতীয় পরিচয়পত্র এবং এক পুলিশ পরিদর্শকের ভিজিটিং কার্ডও পাওয়া গেছে।

আইনজীবী চন্দন নিখোঁজ

নজরুল অপহরণের পর থেকে নারায়ণগঞ্জের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার (৬০) ও তার গাড়িচালকের কোনো খোঁজ মিলছে না।

সন্ধ্যা পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুঁড়ির বাসা বা শহরের সমবায় মার্কেটের চতুর্থ তলায় ব্যক্তিগত চেম্বারে তিনি না যাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা তার মোবাইল ফোনে কল করেও তাকে পাননি।

পরে পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি আইনজীবী সমিতির নেতাদের জানানো হয়। রাতে চন্দনের ভাস্তে অ্যাডভোকেট অরুনাথ কুমার সরকার ফতুল্লা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান সাংবাদিকদের বলেন, তারা বিষয়টি র‌্যাব ও পুলিশকে জানিয়েছেন।

আইনজীবীদের ধারণা, কাউন্সিলর নজরুল ও তার সহযোগীদের অপহরণের ঘটনা সম্ভবত দেখেছিলেন অ্যাডভোকেট চন্দন। ফলে তাকে ও তার গাড়িচালকেও ধরে নেয়া হয়েছে।

অ্যাডভোকেট অরুনাথ সরকার বলেন, দুপুরে তার চাচা চন্দন সরকারের গাড়ি এবং কাউন্সিলর নজরুলের গাড়িটি আদালত প্রাঙ্গণ থেকে পরপর বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন তিনি।