হোসাইনী দালানে বোমাবাজরা ঢুকেছিল ‘মিছিলের সঙ্গে’

নাশকতা এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি ছিল দাবি করে পুলিশ বলছে, হোসাইনী দালানে মিছিলের সঙ্গে মিশে ঢুকে পড়ায় বোমাবাজদের শনাক্ত করা যায়নি।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবকামাল হোসেন তালুকদার ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Oct 2015, 05:30 PM
Updated : 25 Oct 2015, 05:30 PM

দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডের পর দুর্গাপূজা ও আশুরা উপলক্ষে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেই পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের হোসাইনী দালানে শনিবার ভোররাতে বোমা হামলায় এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক আহত হয়।

বরাবরের মতো শিয়া মুসলিমরা ওই সময় আশুরার তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। মিছিলের কিছুক্ষণ আগেই সেখানে তিনটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। পরে অবিস্ফোরিত দুটি বোমাও পাওয়া যায়।

সন্ধ্যার পর থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট ছোট মিছিল আসছিল হোসাইনী দালানে, সব মিছিল জড়ো হচ্ছিল ইমামবাড়ার সামনের চত্বরে। সেখান থেকে বড় মিছিল বের হওয়ার কথা ছিল, তার আগে রাত ২টার দিকে ঘটে বিস্ফোরণ। 

জয়নাল আবেদীন নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বোমা বিস্ফোরণের চার মিনিট আগে ছোট একটি তাজিয়া মিছিল ভেতরে ঢোকে। এর সঙ্গে সঙ্গে ঘটে বিস্ফোরণ।”

সেদিন সন্ধ্যা থেকে ওই এলাকায় ছিলেন কাছের আগা মাসিহ লেইনের এই বাসিন্দা। বোমা বিস্ফোরণ যখন ঘটে, তখন তিনি ছিলেন দালান কমপ্লেক্সের ভেতরে পশ্চিমপাশের গেইটের কাছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সঞ্জিত কুমার রায়ও ওই সময় ছিলেন সেখানে, নিরাপত্তার দেখভাল করছিলেন তিনি।

পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জিত রায়েরও ধারণা, যারা বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল তারা মিছিলের সঙ্গেই ঢুকেছিল।

“তাজিয়া মিছিলের সঙ্গে অপরাধীরা ঢুকেছিল। চার মিনিট আগে যে মিছিলটি ঢুকেছিল। সেই মিছিলটিতেই অপরাধীরা ঢুকতে পারে,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটককে বলেন তিনি।

সেক্ষেত্রে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে ওই মিছিলকারীদের শনাক্ত করা সম্ভব কি না- জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জিত বলেন, “ফুটেজের ভিশন ভালো ছিল না। তবে এক্সপার্টের মাধ্যমে মুভমেন্টগুলো দেখলে তা হয়ত শনাক্ত করা সম্ভব।”

সিসি ক্যামেরাগুলো সচল ছিল হোসাইনী দালানে

 

হোসাইনী দালান কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের ৩২টি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা সচল ছিল সেদিন। ওই ভিডিও থেকে তথ্য পাওয়ার আশা জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জিত বলেন, গোয়েন্দা পুলিশ এ নিয়ে কাজ করছে।

বিস্ফোরণের পর অনেকেই ধারণা করছিলেন, বোমাগুলো বাইরে থেকে ছোড়া হয়েছিল; পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, বাইরে নয় ভেতরে বসেই বোমাগুলো ফাটায় দুর্বৃত্তরা।

সাজেদ হোসেন নামে ইমামবাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সদস্য বলেন, “ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছিলাম, বোমাটি বাইরে থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। পরে বুঝলাম যে ভেতর থেকেই ফাটানো হয়।”

ডিএমপির লালবাগ জোনের সহকারী কমিশনার আর এম ফয়জুর রহমান বলেন, “বোমাগুলো দেশে তৈরি। ছোট বোতল আকৃতির বোমার মাথায় একটি পিন ছিল। ওই পিন খোলার ১০ সেকেন্ড পর বোমাটি বিস্ফোরিত হয়।”

র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর আলম মাতুব্বর বলছেন, হাতে তৈরি এই বিস্ফোরকগুলোকে গ্রেনেড বলা যেতে পারে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দালানের ভেতর থেকে হাতে তৈরি গ্রেনেডের তিনটি ক্লিপ উদ্ধার করে র‌্যাব। তার আগে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দুটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড ও একটি ক্লিপ উদ্ধার করেছিল। উদ্ধার গ্রেনেডের একটির ক্লিপ ছিল না।”

হামলার পর আলামত সংগ্রহে পুলিশ

এগুলোকে হাতে তৈরি গ্রেনেড বলা যেতে পারে, বলছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলামও।

গাবতলীতে পুলিশ খুনের তদন্তে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধার হওয়া বোমার সঙ্গে হোসাইনী দালানে ব্যবহৃত বোমার মিল আছে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উদ্ধার হওয়া গ্রেনেডগুলোর সঙ্গে পুরান ঢাকার হোসাইনী দালানের ভেতরে পাওয়া বিস্ফোরকগুলোর মিল রয়েছে।”

এই ঘটনায় রোববার পুলিশ বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করেছে, তাতে আসামির তালিকায় কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিবিকে।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বিরাজমান সংহতি বিনষ্ট করা এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করার লক্ষ্যে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের পরিকল্পনা এবং ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে

সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর একটি অংশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং তাদের অন্য একটি অংশ ঘটনা সংঘটনে আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয় বলে এজাহারে বলা হয়।

দুই বিদেশি খুনের মতো মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি উঠলেও সরকার তা নাকচ করেছে।

নিরাপত্তা ছিল ‘পর্যাপ্ত’

ওই রাতে হোসাইনী দালানের দুটি ফটকে নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্য ছিলেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। স্থানীয়দের কথায়ও তার সত্যতা মিলেছে।

হোসাইনী দালানে ঢোকার পথে প্রথমে লোহার একটি গেইট পার হতে হয়। কিছুদূর এগুলে পার হতে হয় আরেকটি লোহার দরজা। দালানের ভেতরে ঢোকার দ্বিতীয় দরজার ঠিক ডান পাশেই একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়েছিল।

রোববার গিয়ে সেখানে রক্তের দাগ দেখা যায়। পুরো জায়গাটি ইট দিয়ে ঘিরে রাখা।

দালান থেকে বের হওয়ার পথে বিস্ফোরণস্থলের বামে ‘দারুল কোরআন শেফাখানা এন্ড ডেন্টাল ক্লিনিক’। তার পাশে ৫/৭ গজের একটি সরু পথ। সেখানে দালানে রংয়ের জন্য বাঁশের তৈরি মাচা দেখা গেছে। তার পাশেই ভক্তরা মানত করেন এমন একটি দুই তলা পাকা ঘর।

অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সঞ্জিত রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই গেইটে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। ভেতর ও বাহিরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কোনো ঘাটতি ছিল না।”

সহকারী কমিশনার ফয়জুরও বলেন, যে সব রুটে মিছিল যাবে সেই সব রুটের আশপাশের ভবনের ছাদে পুলিশ সদস্য পাহারায় ছিল।

“এমনকি নাশকতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ যেন কেউ করতে না পারে, সেজন্য ট্রান্সফর্মারগুলোর পাশেও পুলিশ সদস্য রাখা হয়েছিল।”

ইমামবাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সাজেদ বলেন, “উত্তরের দুটি গেইটে প্রচুর পুলিশ-র‌্যাব ছিল। হেঁটে কেউ ভেতরে ঢুকতে চাইলে তার দেহ তল্লাশি করা হত।”

সেখানে কোনো আর্চওয়ে না বসালেও হাতে মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে কাজ করছিলেন কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা।

সেক্ষেত্রে তল্লাশিতে বিস্ফোরকসহ কেউ ধরা পড়ল না কেন- জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা সঞ্জিত বলেন, মিছিলের কারও দেহ তল্লাশি করা সম্ভব হয়নি।”

লম্বা লম্বা লাঠি, বাঁশসহ নানা জিনিসপত্র নিয়ে দ্রুত লয়ে মিছিলকারীদের ঢোকাকে তল্লাশি করতে না পারার কারণ দেখান তিনি।

উপ-কমিশনার মফিজ উদ্দিনও বলেন, “ওইখানে হাজার হাজার মানুষ মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তাদের শরীরে দড়ি ও বিভিন্ন ধরনের পোশাক ছিল। সেখানে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও সবাইকে তল্লাশি করার মতো বাস্তব পরিস্থতি ছিল না।”

“দুর্বৃত্তরা মিছিলের মাধ্যমে ভেতরে ঢোকার কৌশলটিই ব্যবহার করেছে,” বলেন ইমামবাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সাজেদ।

</div>  </p><p> </p>