স্ত্রী, শাশুড়ি, ছোটভাই ও সন্তানদের নিয়ে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে হোসাইনী দালান ইমামবাড়ায় গিয়েছিলেন কেরানীগঞ্জের উত্তর শুভাড্যার মো. রাশেদ; ‘মানত’ ছিল তাদের।
Published : 24 Oct 2015, 06:29 PM
শুক্রবার গভীর রাতে বোমা বিস্ফোরণের পর স্প্লিন্টারের ক্ষত নিয়ে স্ত্রী-শাশুড়ির স্থান হাসপাতালে হলেও ‘ফেরানো যায়নি’ ছোট ভাইকে।
তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলাচালে বোমা বিস্ফোরণে মো. রাশেদের ছোটভাই সাজ্জাদ হোসেন সানজুর মৃত্যু হয়। আহতের সংখ্যা আনুমানিক ৭৫ জন।
চিকিৎসা নিতে আসা বেশিরভাগের শরীরে, মাথায় স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সানজুর মৃত্যুও পিঠে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে রক্তক্ষরণে হয়েছে বলে তাদের ধারণা।
কেরানীগঞ্জের চড়াইল হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজু পাচ ভাইয়ের সঙ্গে কেরানীগঞ্জের উত্তর শুভাড্যা ইউনিয়নে থাকত।
শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কথা হয় নিহতের বড় ভাই মো. রাশেদের সঙ্গে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “একটি মানত ছিল বলে শুক্রবার রাতে ছোটভাই সানজু, স্ত্রী সুমি আক্তার, শাশুড়ি আনোয়ারা বেগম ও দুই সন্তান সিফাত (৫) ও স্নিগ্ধাকে (১১) নিয়ে হোসাইনী দলানে গিয়েছিলাম।”
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাশেদ বলেন, “হঠাৎ করে পৌনে ২টার দিকে দালানের উত্তর গেইটের পূর্ব দিক থেকে ৩টা বোমা ফাটলে সবাই দৌড়াতে থাকে। কেউ রাস্তায় পড়ে যায়। সানজুও পড়ে গিয়েছিল। এ সময় সে পদদলনের শিকার হয়।
“এরপর আমি টেনে বের করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে সানজু মারা যায়।”
বিস্ফোরণে রাশেদের স্ত্রী সুমির পায়েও স্প্লিন্টার লেগেছে বলেও জানান তিনি। শাশুড়ি আনোয়ারাকেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিকেলে সানজুর মরদেহ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাশেদ।
বলছিলেন, “ও ছিল আমার পরিবারের সবার ছোট। যারা ভাইডারে কাইড়া নিল, আমি অগো বিচার চাই। কোনো মা আর ভাইয়ের বুক জানি আর খালি না হয়। অগো ধইরা কঠোর শাস্তি দিতে হবে… কঠোর শাস্তি…।”
একই আর্তি মাথায় স্প্লিন্টারবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ফেরিওয়ালা মো. জামাল উদ্দিনের মায়ের।
বললেন, “কিছু চাই না, আল্লাহর কাছে পোলাডার প্রাণ ভিক্ষা চাই।”
আহতের ছোট ভাই জামিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বড় ভাই, লেইস ফিতা ফেরি করতে হুসনি দালানে গেলে গভীর রাতেই তিনি আহত হন বলে শুনছি। এরপর ঢাকা মেডিকেল আসলে দেখি জরুরি বিভাগে সারা শরীরে রক্ত মাখা অবস্থায় সে মাটিতে পড়ে আছে। এরপর ভোররাতে তাকে আইসিইউতে আনা হয়।”
জামাল উদ্দিনের শরীরের অবস্থা কেমন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখনও বুঝতে পারছি না ভাইয়ের শরীর কেমন। ডাক্তার কী বলবে তা জানার জন্যই আইসিইউর সিঁড়ির পাশে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি। দালান কমিটির লোকজন সকালে এক হাজার টাকার ওষুধ কিনা দেয়। এরপর আর তাগো কোন খোঁজ পাই নাই।”
বড় ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যয় তার পরিবারের পক্ষে বহন সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকার ও বড়লোক মানুষ যদি সাহায্য না করে ভাইডারে হয়তো বাচাইতে পারমু না।”
এরই মধ্যে নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডে মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় শুয়ে আছেন রুনা বেগম (৩০)। তার স্বামী মো. নাজির হোসেন নবাবপুরে একটি ইলেকট্রিক তার তৈরির কারখানার শ্রমিক।
ছেলে সিফাত (১২) ও মেয়ে শ্রাবন্তীকে (৯) নিয়ে হোসাইনী দালানে গিয়ে বোমার স্প্লিন্টারে তারাও আহত হন।
মো. নাজির হোসেন বলেন, “বোমা বিস্ফোরণের জায়গা থেকে আমরা ২০ গজ দূরে ছিলাম। আমি ক্যামেরায় স্ত্রী ও সন্তানদের ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ ৩/৪টা বোমা কেউ পূর্ব দিক থেকে ছুড়লে পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমি বাচ্চাদের সরিয়ে দেবার চেষ্টা করি, আর স্ত্রী রুনা ওদের জড়িয়ে ধরলে রুনার শরীরে স্প্লিন্টার লাগলে ও মাটিতে পড়ে যায়।”
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের (রা.) শহীদ দিবস আরবি মহররম মাসের ১০ তারিখকে ত্যাগ ও শোকের প্রতীক হিসেবে পালন করেন শিয়া মতাবলম্বীরা।
দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো শনিবার ভোররাতে তাজিয়া মিছিলের জন্য হোসাইনী দালানে সমবেত হয়েছিলেন শিয়া মতাবলম্বীরা।
এ সময় সেখানে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ ছিলেন বলে ‘ফিরোজ হোসেন’ নামে তাদের এক নেতা জানিয়েছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মিছিল শুরুর আগে নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা হোসাইনী দালানের চারপাশ পরিদর্শন করেন। এর পরপর বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।”