আন্তর্জাতিক এই আদালতের আদেশ মেনে চলার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু সেটি কার্যকর করার কোনও ক্ষমতা আদালতের নেই।
Published : 27 Jan 2024, 05:47 PM
গাজার যুদ্ধে গণহত্যার মত অপরাধ ঠেকাতে এবং বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করতে ইসরায়েলকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)।
কিন্তু আদালতের এ রায় দক্ষিণ আফ্রিকা বা ফিলিস্তিনিদের জন্য সম্পূর্ণ বিজয় বলা যায় না। কারণ, ইসরায়েলকে সামরিক অভিযান বন্ধের আদেশ দেয়নি আইসিজে। যা প্রচ্ছন্নভাবে গতবছর ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের হামলার পেক্ষাপটে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকেই স্বীকৃতি দেয়। ফলে প্রশ্ন ওঠে, ইসরায়েল আদালতের ওই আদেশ মানবে তো?
জাতিসংঘের শীর্ষ এই আদালত অবশ্য ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজার পরিস্থিতি যে বিপর্যয়কর, তা স্বীকার করে নিয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে আদালত চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগেই “পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাওয়ার মারাত্মক ঝুঁকি” থাকার কথা আদেশে উল্লেখ করেছে। কারণ, গণহত্যার মতো অভিযোগে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
ফলে আদালত ইসরায়েলের কাছে বেশ কিছু দাবি জানিয়েছে, যার বেশিরভাগই দক্ষিণ আফ্রিকা যে ৯ টি “সাময়িক পদক্ষেপ” নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
১৭ জন বিচারকের প্যানেল প্রায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আদেশ দেয় যে, ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা, তাদের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা, গাজার বসবাসের অযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করা কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের জন্মগ্রহণে বাধা দেওয়া- এসব এড়িয়ে চলতে সম্ভাব্য সবকিছুই করতে হবে।
তাছাড়া, ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উদাহরণ দিয়ে আদালত আরও বলেছে, জনগণকে গণহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া ঠেকানো এবং প্ররোচনা দেওয়ার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতে ইসরায়েলের আরও বেশিকিছু করা উচিত। গাজায় মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় ‘তাৎক্ষণিক ও কার্যকর ব্যবস্থা’ নেওয়ার আহ্বানও জানানো হয়েছে আদেশে।
যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো না হলেও যে সব দাবি ইসরায়েলের কাছে করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ধরন আমূল বদলে যাবে।
ইসরায়েল বরাবরই গণহত্যার অভিযোগ জোরালভাবে অস্বীকার করে আসছে। বরং তারা যুক্তি দেখাচ্ছে যে, ফিলিস্তিনিদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলার জন্য হামাসই দায়ী।
ইসরায়েল বলছে, গাজার ঘনবসতিপূর্ণ শহর ও শরণার্থী শিবিরের ভেতরে এবং নিচে থেকে হামাস তৎপরতা চালাচ্ছে, ফলে ইসরায়েলের পক্ষে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা এড়ানো একরকম অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
তারপরও সাধারণ মানুষদের সতর্ক করে দিতে এবং ঝুঁকি এড়াতে যা যা করাদরকার সবই করা হচ্ছে বলে ইসরায়েল দাবি করেছে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ‘বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক বাহিনী’ এমন বিশ্বাস দেশটির ইহুদি নাগরিকদের মধ্যে প্রায় সর্বজনীনভাবে আছে।
কিন্তু গত বছরের অক্টোবরের শুরু থেকে চলমান ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের জেরে গাজার ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যুদ্ধ থেকে পালিয়ে মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে জরাজীর্ণ, উপচে পড়া আশ্রয় কেন্দ্রে, যেখানে তেমন কোনো স্বাস্থ্য সেবা বা মানবিক সাহায্য নেই বললেই চলে।
আইসিজে-র বিচারক প্যানেলের প্রেসিডেন্ট মার্কিন জোয়ান ডানেহিউ রায় পড়া শুরুর পরপরই গাজার দুর্দশার বিষয়টি আদালত কতটা গুরুতরভাবে বিবেচনায় নিয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে পুরো মামলা নস্যাৎ করার ইসরায়েলের চেষ্টা সফল হতে পারেনি।
বিচারক ডানেহিউ গাজায় ফিলিস্তিনিরা যে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, তার একটি করুণ সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সেখানে বিশেষ করে শিশুদের দুর্দশা ‘হৃদয়বিদারক’।
যদিও গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে এটিই আদালতের চূড়ান্ত রায় নয়, সে রায় আসতে কয়েক বছর লেগে যাতে পারে। কিন্তু আজ আদালত যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার ডাক দিয়েছে, সেগুলো মূলত গাজার ফিলিস্তিনিদের কিছু সুরক্ষার ব্যবস্থা করার কথা ভেবেই করা হয়েছে। বিচারকরা একইসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার মূল অভিযোগও বিবেচনায় নিয়েছেন।
আদালত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে বলেছে, গাজা অভিযানে ইসরায়েলের বাহিনী যাতে গণহত্যার মত কিছু না ঘটায়, দেশটিকে তা নিশ্চিত করতে হবে।আদেশ বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এক মাসের মধ্যে তা প্রতিবেদন আকারে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) জমা দিতেও বলা হয়েছে ইসরায়েলকে।
এখন ইসরায়েলকে এ রায়ে কীভাবে সাড়া দেবে সে ব্যাপারে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আইসিজে- এর আদেশ মেনে চলার আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু সেটি কার্যকর করার কোনেও ক্ষমতা আদালতের নেই। ইসরায়েল চাইলে বিচারকদের আদেশ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারে।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় এখন গাজায় দুই মাসের যুদ্ধবিরতি করার সম্ভাবনার দিকে মনোনিবেশ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, গাজায় আরও মানবিক সহায়তা কীভাবে পৌঁছানো যায় সে চেষ্টাও চলছে। এসব বিষয়কে সামনে নিয়ে এসে ইসরায়েল যুক্তি দেখাতে পারে যে, তারা এরই মধ্যে আদালতের আদেশ মানার পদক্ষেপ নিচ্ছে।
কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি যদি হয়ও-(যার কোনেও লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না)– তারপরও ইসরায়েল যে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত সে বাস্তবতা বহাল থাকবে। যে অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, আইসিজে মনে করে, আপাতদৃষ্টিতে তা বিশ্বাসযোগ্য। আর সেকারণেই বিষয়টি আরও বিশদভাবে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে।
বিশ্বে গণহত্যার সবচেয়ে বাজে দৃষ্টান্তের ভস্ম থেকে জন্ম নেওয়া ইসরায়েলকে এখন আদালত রায় না দেওয়া পর্যন্ত আইনি ছায়ার নিচেই থাকতে হবে।
সূত্র: বিবিসি।