বিদায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এখন কী করবেন? শিশু বয়সে ‘পৃথিবীর রাজা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখা জনসন এখন ক্যারিয়ারের পরবর্তী ধাপের পরিকল্পনা করছেন।
Published : 05 Sep 2022, 10:00 PM
কনজারভেটিভ দলকে তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় জয় এনে দেওয়ার মাত্র তিন বছর পর দলের নেতাদের আস্থা হারিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বরিস জনসন।
শিশু বয়সে যিনি ‘পৃথিবীর রাজা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি এখন তার ক্যারিয়ারের পরবর্তী ধাপ শুরু করার পরিকল্পনা করছেন।
জনসনের জীবনী লিখছেন অ্যান্ড্রু গিমসন। তিনি বলেন, ‘‘তিনি (জনসন) এমন ব্যক্তি নন যিনি নিজের এলাকায় গিয়ে স্থানীয় গির্জার জন্য ভালো ভালো কাজ করবেন এবং আড়ালে থেকে নির্বিবাদ জীবনযাপন করবেন।”
নানা উদ্ভট কর্মকাণ্ড এবং বিতর্কিত মন্তব্য করে বরাবর আলোচনায় থাকা জনসন তবে কী করতে চলেছেন?
লেখালেখিতে ফেরা
রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে যুক্তরাজ্যের একজন প্রভাবশালী এবং উচ্চ বেতন পাওয়া সাংবাদিক ছিলেন বরিস জনসন। ওয়েস্টমিনস্টারে যাওয়ার পরও তিনি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি পত্রিকায় লেখা বাদ দেন।
‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় সাপ্তাহিক কলাম লেখার জন্য বছরে দুই লাখ ৭৫ হাজার পাউন্ড দেওয়া হত জনসনকে। আবারও সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লেখা পেতে মিডিয়া হাউজগুলোতে যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ের স্মৃতিকথা লেখার প্রস্তাবেও তিনি প্রলুব্ধ হতে পারেন। ওই বই লেখার জন্য তাকে ‘১০ লাখ পাউন্ড’ সম্মানি দেওয়া হতে পারে।
তিনি এরই মধ্যে আটটি বই (পত্রিকায় তার লেখা কলামের সংকলন করে যে বই প্রকাশ করা হয়েছে সেটি ধরে) লিখে ফেলেছেন।
জনসনের জীবনের হিরো উইন্সটন চার্চিল কে নিয়ে তিনি যে জীবনীমূলক বই লিখেছিলেন, সেটি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছিল। রাজনীতি নিয়ে তার ব্যাঙ্গাত্মক উপন্যাস ‘সেভেন্টি-টু ভার্জিন্স’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।
প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়ার পর জনসন প্রথম যে কাজটি করবেন সেটি হয়ত উইলয়াম শেক্সপিয়ারের জীবনী লেখা শেষ করা। গত সাত বছর ধরে তিনি এ বই লিখছেন। ২০১৫ সালে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঁচ লাখ পাউন্ডে ‘শেক্সপিয়ার: দ্য রিডল অব জিনিয়াস’ বইয়ের স্বত্ব কিনে নিয়েছে।
বইটি ২০১৬ সালে প্রকাশ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোট, জনসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া এবং সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে বই লেখা পিছিয়ে যায়।
বক্তৃতা দেওয়া:
বক্তৃতা (পাবলিক স্পিকিং) দিয়েও প্রচুর অর্থ আয়ের সুযোগ আছে জনসনের। তার পূর্বসুরি টেরিজা মে ২০২২ সালে নয়টি বক্তৃতা দিয়ে সাত লাখ ১৫ হাজার পাউন্ড আয় করেছেন বলে জানায় বিবিসি।
জনসনের ‘সেন্স অব হিউমার’ উঁচু স্তরের। তিনি কৌতুক করতে ভালোবাসেন। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে ডিনারের পরের গল্পগুজবে তিনি দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন।
তবে শুধু মজার বক্তৃতা নয়, জনসন গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়েও বক্তৃতা দিতে পারদর্শী। ২০১৯ সালের মার্চে একটি ব্যাংক এবং ভারতের একটি মিডিয়া গ্রুপে বক্তৃতা দিয়ে তিনি এক লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড আয় করেছিলেন।
জনসনের দীর্ঘদিনের উপদেষ্টা উইডনি-লিস্টার বলেন, ‘‘তিনি যে প্রচুর লেখালেখি করবেন এবং বক্তৃতা দেবেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”
রাজনীতি থেকে দূরে থাকা
একজন এমপি হিসেবে জনসন রাজনীতিতে থাকবেন কিনা তা নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলছেন। লিজ ট্রাসের মন্ত্রিসভার কোনো পদে তাকে দেখা গেলেও যেতে পারে।
যদি তাই হয়, তবে বলা যায়, তিনি ফিরছেন। আগেও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে তাকে ফিরতে দেখা গেছে।
তবে যাই ঘটুক, ব্রিটেনের নিয়ম অনুযায়ী, দুই বছর তাকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে দেখা যাবে না।
উইডনি-লিস্টার বলেন, ‘‘এত তাড়াতাড়ি তিনি পার্লামেন্ট থেকে দূরে চলে যাবেন বলে আমার মনে হয় না।
‘‘তবে আমার এটাও মনে হয়, শুধুমাত্র পাথর ছোঁড়ার জন্য এমনকী সেটা ব্যাক বেঞ্চ থেকে হলেও তিনি সেখানে বসতে যাচ্ছেন না।”
রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন
প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে নিজের শেষ দিনে জনসন ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘‘এখনকার মত অভিযান সম্পূর্ণ হয়েছে।” তারপর তিনি ‘হাস্তা লা ভিস্তা, বেবি’ গেয়ে ওঠেন।
এর মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তিনি এখনও শেষ হয়ে যাননি। তবে তিনি কী আসলেই ফিরবেন? হতে পারে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে। যদি তার উত্তরসুরি পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে হেরে যায়।
কনজারভেটিভ পার্টির ইতিহাস নিয়ে লিখছেন অধ্যাপক ব্যালে। তিনি বলেন, জনসনের রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে তিনি এও বলেন যে, এজন্য দলকে অনেক ‘বেশ মরিয়া’ হতে হবে।
‘‘যদি কনজারভেটিভ পার্টি আবার বরিস জনসনের কাছে ফিরে যায় তাহলে আমি দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুতর উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ব,” বলেন ব্যালে।
বরিস জনসনের আবার ফিরে আসার বিষয়টি একরকম নাকচ করে দিয়েছেন তার দীর্ঘদিনের মিত্র জ্যাকব রিস-মগ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোনের পর নেতৃত্ব হারিয়ে আর কেউই ফিরে আসেননি বলে জানান তিনি।
তবে ব্রিটিশ রাজনীতি বিষয়ক সাংবাদিক অ্যান্ড্রু গিমসন অবশ্য ঐতিহাসিক এই তুলনা নিয়ে চিন্তিত নন। তার মতে, জনসন যাই করুন, তাকে নিয়ে অনুরক্তি থাকবেই। কিছুকালের বিরতির পর বহু মানুষই দুই-তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
নিজের পথে যাবেন:
জনসন যাই করুন, তিনি ‘পাবলিক ডিউটি কস্ট অ্যালাউন্স’ পাবেন। যা তার পরবর্তী জীবন নিশ্চিন্তে চলতে সাহায্য করবে।
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের জন্য এই স্কিমটি চালু করে গেছেন। যে স্কিমের আওতায় একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বছরে এক লাখ ১৫ হাজার পাউন্ড করে ভাতা পাবেন।
যদিও জনসনকে বরাবর নিয়ম ভাঙতে দেখা গেছে। তাই তিনি তার পূর্বসুরিদের পথ অনুসরণ করবেন এমনটা বিশ্বাস করা কঠিন।
সাংবাদিক গিমসন বলেন, ‘‘তিনি কখনোই দুটির মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার মত মানুষ ছিলেন না। বরং তিনি সব সময় ভবিষ্যতে কী হতে পারে সেটা না ভেবে নিজের জীবন উপভোগ করা মানুষ।
‘‘তিনি যাই করুন না কেন, আমার মনে হয় তিনি খুবই ব্যস্ত সময় পার করবেন। তিনি কাজ ছাড়া থাকতে পারার মানুষ নন।”
এমন মত অধ্যাপক ব্যালেরও। তিনি বলেন, ‘‘তার জন্য এখানে যোগ-বিয়োগের পর ফলাফল শূন্য হওয়ার মত সাধারণ জীবন অপেক্ষা করছে না।”
‘‘বরং রাজনৈতিক প্রচার, রাজনীতিতে ফেরা এবং অর্থ উপার্জন, সব হাতে হাত ধরে একসাথে চলবে।”