ঘানার সামেদই কি বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষ?

স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা হওয়ার ফলে তার শারীরিক কিছু জটিলতাও ধরা পড়েছে, সেগুলোর চেকআপের জন্য তাকে প্রতিমাসেই হাসপাতালে যেতে হয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Jan 2023, 05:25 AM
Updated : 3 Jan 2023, 05:25 AM

উত্তর ঘানার স্থানীয় একটি হাসপাতাল সাম্প্রতিক এক চেক আপে ২৯ বছর বয়সী সুলেমানা আবদুল সামেদকে তার উচ্চতা ৯ ফুট ৬ ইঞ্চি হয়ে গেছে বলে জানায়।

এই হিসেবে সামেদ হয়ে যান বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ব্যক্তি। কেননা গিনেস রেকর্ড বুকে এখন বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা মানুষ হিসেবে যার নাম আছে তিনি তুরস্কের সুলতান কোসেন, যার উচ্চতা ৮ ফুট ২.৮ ইঞ্চি।

সেই রেকর্ড ভাঙতে পেরে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কথা, কিন্তু ঝামেলা বেধে যায় অন্যখানে। স্থানীয় ওই হাসপাতাল আসলে সামেদের উচ্চতা সম্পর্কে নিশ্চিত নয়, কারণ তাদের কাছে সঠিক উচ্চতা মাপার সরঞ্জামই নেই।

বিবিসি জানিয়েছে, কয়েক বছর আগে সামেদের জাইগেন্টিজম ধরা পড়ে। যে কারণে তিনি এখনও ক্রমাগত লম্বা হচ্ছেন।

স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা হওয়ার ফলে তার শারীরিক কিছু জটিলতাও ধরা পড়েছে, সেগুলোর চেকআপের জন্য তাকে প্রতিমাসেই হাসপাতালে যেতে হয়।

তেমনই এক চেকআপের সময় তাকে উচ্চতা মাপার সরঞ্জামের সামনে দাঁড়াতে বলা হয়।

“তুমি তো স্কেলের চেয়েও লম্বা হয়ে গেছ,” বলেন হতভম্ব হয়ে পড়া এক নার্স। লোকজনের এই হতবিহ্বল হয়ে পড়া উপভোগ করেন সামেদ, যিনি অনেকের কাছেই তার ডাক নাম ‘আউচে’ নামে পরিচিত।

ডিউটি নার্স পরে সামেদের উচ্চতা মাপতে তার আরেক সহকর্মীর দ্বারস্থ হয়, সেই সহকর্মী আরেকজনকে ডাকে। এভাবে বেশ কয়েকজন জড়ো হয়ে যায়, যারা ভাবতে শুরু করে সরঞ্জাম ছাড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তির উচ্চতা কী করে বের করা যায়।

শেষ পর্যন্ত একজন পরামর্শ দেন, একটি খুঁটি খুঁজে বের করে সেটিকে তাদের সরঞ্জাম মাপার যন্ত্রের ‘এক্সটেনশন’ হিসেবে কাজে লাগিয়ে সামেদের উচ্চতা বের করার। শেষ পর্যন্ত এভাবেই উচ্চতা মাপেন তারা। যেখান থেকে বের হয়, সামেদ ৯ ফুট ৬ ইঞ্চি হয়ে গেছেন।

‘এখনও বাড়ছি’

সামেদের খবর কানে যায় বিবিসির এক সাংবাদিকের। কয়েক মাস আগেই তিনি ২৯ বছর বয়সী এ তরুণকে দেখে এসেছেন, কিন্তু সেসময় তার কাছে উচ্চতা মাপার কোনো যন্ত্র ছিল না।

এরপর গত সপ্তাহে তিনি ১৬ ফুট দীর্ঘ একটি টেপ নিয়ে আবার গাম্বাগা গ্রামে যান, যেখানে সামেদের বাস।

পরিকল্পনা ছিল, কোনো একটি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে, তার মাথার সর্বোচ্চ অবস্থান বরাবর ওই দেয়ালে চিহ্ন কেটে, পরে সঠিক উচ্চতা মেপে বের করা।

কিন্তু দেখা গেল, সামেদের উচ্চতা তার এলাকার সব বাড়ির দেয়ালের চেয়ে বেশি। অনেক খুঁজে একটি ভবন বের হল, যার দেয়াল তার চেয়ে বেশি উঁচু।

সামেদ তার জুতা খুলে সানন্দেই মাপ দিতে রাজি হলেন, তিনি নিজেও স্থানীয় হাসপাতালের দেওয়া মাপে সন্তুষ্ট ছিলেন না।

এক প্রতিবেশী কাঠের একটি টুলে দাঁড়িয়ে সামেদের উচ্চতায় পৌঁছান এবং চক দিয়ে তার (সামেদ) মাথা সমান উচ্চতার দাগ কাটেন।

ওই দাগের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে এবার সেখান থেকে উ্চ্চতা মাপার টেপটি মাটিতে ফেলা হয়।

“আউচে, টেপ দেখাচ্ছে ৭ ফুট ৪ ইঞ্চি,” বলেন বিবিসির ওই সাংবাদিক।

মুখে অতুলনীয় এক হাসি নিয়ে ঘানার এ তরুণ বলেন, “ওয়াও, এর মানে কী?”

“এখন জীবিত সবচেয়ে লম্বা মানুষের উচ্চতা হচ্ছে ৮ ফুট ২ দশমিক ৮ ইঞ্চি, সে তোমার চেয়ে প্রায় এক ফুট লম্বা,” উত্তরে বলেন সাংবাদিক।

সামেদের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। হাসপাতালের মাপের সঙ্গে এই মাপের পার্থক্যে তাকে বিন্দুমাত্র মর্মাহত হতে দেখা গেল না।

“আমি এখনও বাড়ছি। কে জানে, হয়তো একদিন ওই উচ্চতায়ও পৌঁছে যাবো আমি। প্রতি তিন-চার মাস পরপর বাড়ি আমি। যদি আপনি আমাকে তিন বা চার মাস পর দেখেন, বুঝবেন আমার উচ্চতা বেড়ে গেছে,” বলেন সামেদ।

‘জিভ বড় হয়ে যাচ্ছে’

২২ বছর বয়সে, যখন রাজধানী আক্রায় ছিলেন, তখন সামেদ টের পান তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।

সেসময় ওই শহরে তার এক ভাই থাকতেন, মাধ্যমিক স্কুল পেরিয়ে সামেদ সেখানে গিয়েছিলেন ভাগ্য ফেরাতে।

কসাইয়ের দোকানে কাজ করে টাকা জমাতেন ড্রাইভিং স্কুলে যাওয়ার।

কিন্তু একদিন ঘুম থেকে উঠে তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন।

“আমি বুঝতে পারলাম আমার জিভ মুখের ভেতর বড় হয়ে গেছে এবং আমি ঠিকঠাক শ্বাস নিতে পারছি না,” স্মৃতি হাতড়ে বলেন সামেদ।

এ পরিস্থিতিতে ওষুধের জন্য স্থানীয় একটি ফার্মেসিরও দ্বারস্থ হন তিনি; কিন্তু দিনকয়েক পরই তিনি বুঝতে পারেন, কেবল জিভই নয়, তার শরীরের অন্যান্য অংশও বড় হওয়া শুরু করছে।

আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের বন্ধুবান্ধবরা যখন তাকে দেখতে আসতো, সবার চোখেই তার লম্বা হওয়াটা ধরা পড়তো।

লম্বা হওয়ার কারণে তার মেরুদণ্ড অস্বাভাবিক রকম বেঁকে যেতে শুরু হল, দেখা দিল হৃদযন্ত্রে ত্রুটিসহ আরও সমস্যা।

চিকিৎসকরা জানান, তার এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাড়া ঠেকাতে তার মস্তিষ্কে অপারেশন দরকার। কিন্তু ঘানার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা বীমায় এই অপারেশন হবে না, সেখানে কেবল সাধারণ চিকিৎসাই অন্তর্ভুক্ত।

প্রতিবার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য সামেদকে ৫০ মার্কিন ডলার যোগাড় করতে হয়।

শারীরিক নানা সমস্যাই তাকে ছয় বছর আগে গ্রামে ফিরতে বাধ্য করে, বাধ্য করে গাড়িচালক হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে। কারণ তার শারীরিক গড়ন আর গাড়ি চালানোর জন্য মানানসই নয়।

তিনি এখন তার ভাইয়ের সঙ্গে বাস করেন, মোবাইল ফোন রিচার্জের ছোট একটি দোকান দিয়েছেন।

উচ্চতা তার সামাজিক জীবনও অনেকখানি কেড়ে নিয়েছে।

“অন্য তরুণদের মতো আমিও ফুটবল খেলতাম। আমি খেলাধুলায় বেশ ভালো ছিলাম, কিন্তু এখন আমি অল্প দূরত্বও হেঁটে যেতে পারি না,” বলেন সামেদ।

হাল ছাড়েননি

সামেদ অবশ্য তার সমস্যার কাছে হার মানেননি। দীর্ঘকায় গড়ন নিয়ে যখন তিনি গ্রামের ধুলোময় পথ দিয়ে যান, তখন লোকজন ডাকলে হাসিমুখেই তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

তিনি এখন ওই অঞ্চলের বেশ পরিচিতমুখ। অনেকে তার সঙ্গে সেলফি তুলতে চান, অপরিচিত অনেকে এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, তারা যে লম্বা লোকটাকে খুঁজছে, তিনিই সেই লোক কিনা।

“সাধারণত আমি বলি, হ্যাঁ আমিই সেই লোক। কাছে আসো। এরপর আমরা দাঁড়িয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি তুলি,” বলেন সামেদ।

পরিবারের সবাই তাকে যেভাবে মানসিক সমর্থন দিচ্ছে তাতে বেশ কৃতজ্ঞও তিনি।

সামেদ জানান, তার তিন ভাই, পরিচিত আত্মীয়স্বজন কারও মধ্যেই তার মতো জাইগেন্টিজমের লক্ষণ নেই।

“কেউই লম্বা নয়, আমিই সবচেয়ে লম্বা,” বলেন তিনি।

বিয়ে করবেন, বাচ্চাকাচ্চা হবে- এই আশা থাকলেও আপাতত তার পূর্ণ মনোযোগ তার শারীরিক জটিলতাগুলোর সমাধান।

এখন তার অগ্রাধিকার তালিকায় সবার উপরে হচ্ছে উচ্চতা বাড়ায় তার এক পা, গোড়ালি ও পায়ের পাতার ত্বকে যে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে তা ঠিক করতে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করা।

ব্যাপারটা সহজ নয়; কিন্তু ব্যান্ডেজে বাঁধা পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে থাকতেও রাজি নন সামেদ।

“আল্লাহ আমার জন্য এটাই পছন্দ করেছেন। আমি ঠিক আছি। সৃষ্টিকর্তা যেভাবে আমাকে তৈরি করেছেন, তা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই,” বলেন হাল না ছাড়া এ তরুণ।