যুক্তরাষ্ট্র-চীন ‘দূরত্ব বাড়ছেই’, পরিস্থিতি বদলের সম্ভাবনাও ক্ষীণ

১৯৭০ এর দশকে বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে এতটা দূরত্ব আর কখনোই দেখা যায়নি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2023, 09:01 AM
Updated : 25 March 2023, 09:01 AM

যুক্তরাষ্ট্রের একটি যুদ্ধবিমান সন্দেহভাজন একটি চীনা গোয়েন্দা বেলুনকে গুলি করে ভূপাতিত করার পর গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরাশক্তির মধ্যে জমে থাকা মেঘ সরাতে এই বিষয় নিয়ে তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে কথা বলার পরিকল্পনা করছেন।

পাঁচ সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, ওই কথোপকথন এখনও হয়নি।

উল্টো, বেলুনকাণ্ডকে ঘিরে দুই মাসের কূটনৈতিক টানাপোড়েন আর গত সপ্তাহে মস্কোতে শি জিনপিংয়ের সফর যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের ফাটল যে আরও চওড়া হয়েছে, তাই দেখাচ্ছে। কারও কারও মতে ১৯৭০ এর দশকে বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে এতটা দূরত্ব আর কখনোই তৈরি হয়নি।

এপ্রিলের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের যাত্রাবিরতি পরিস্থিতিকে আরও জটিলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে ধারণা বার্তা সংস্থা রয়টার্সের।

লাতিন আমেরিকা থেকে ফেরার পথে ক্যালিফোর্নিয়ায় নেওয়া যাত্রাবিরতিতে সাই মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান স্পিকার কেভিন ম্যাককার্থির সঙ্গে দেখাও করতে পারেন, এই পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত একাধিক সূত্র বলেছে সংবাদমাধ্যমটিকে। 

“আমেরিকার কূটনীতিতে এটা মোটেও ভালো সময় নয়। শেষবার চীন ও রাশিয়া এতটা কাছে এসেছিল ১৯৫৭ সালে। যখন মাও জে দং মস্কোতে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘পূবের বাতাস পশ্চিমা বাতাসকে হারিয়ে দেবে’,” বলেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইনিজ স্টাডিজের অধ্যাপক উইলিয়াম হার্ভে।

শি এবার মস্কো সফরে যাওয়ার পর রাশিয়া-চীন উভয় দেশ একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা করেছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা এখন ভাবছেন, কী করে বিশ্বের দুই শীর্ষ অর্থনৈতিক পরাশক্তির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে।

বাইডেন-শি ফোনালাপ তার প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে। এই ফোনালাপ হলে, তা হবে গত বছরের নভেম্বর বালির জি২০ সম্মেলনে বৈঠকের পর দুই নেতার প্রথম সরাসরি কথোপকথন।

কিন্তু মার্কিন কূটনীতিকদের তুমুল আগ্রহ ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চীন এ ধরনের ফোনালাপের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না বলে রয়টার্সকে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

দুই প্রেসিডেন্টের দেখা-সাক্ষাৎ বা কথা না হলেও গত মাসে বেলুনকাণ্ডের পর মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সঙ্গে চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই-র বৈঠক হয়েছে, কিন্তু তাতেও উত্তেজনা প্রশমিত হয়নি।

বাইডেন প্রশাসনের শুরুর দিকে আলাস্কায় বৈঠকের পর মিউনিখের ওই বৈঠকের মতো যুক্তরাষ্ট্র-চীনের আর কোনো বৈঠকে এত বৈরিতা দেখা যায়নি, বলেছেন বৈঠক সম্বন্ধে অবগত একজন।

তিনি জানান, চীন ওই বৈঠকে বসার ব্যাপারেও খুব একটা আগ্রহী ছিল না। বাধ্য হয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া বিষয়ক শীর্ষ কূটনীতিক ডেনিয়েল ক্রিটেনব্রিঙ্ক নিজে ওয়াং ই-র পেছন পেছন সম্মেলনের কেন্দ্রস্থলে দৌড়ে যান এবং কখন বৈঠক হবে তা জানতে চান। 

স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন বক্তব্য

গত ৪ ফেব্রুয়ারি চীনের বেলুনকে গুলি করে ভূপাতিত করার মার্কিন সিদ্ধান্তে বেইজিংয়ের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ওয়াং ই বেলুন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াকে ‘উন্মাদনা’ বলে অ্যাখ্যা দেন।

এর তিনদিন পর বাইডেনের দেওয়া স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণও বেইজিং-ওয়াশিংটন তিক্ততা আরও বাড়িয়ে তোলে; ওই ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বমঞ্চে শি-র অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, যা চীনের কর্মকর্তাদের ক্ষেপিয়ে দেয়, বলেছে একটি সূত্র।

“একজন বিশ্বনেতার নাম বলুন, যিনি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে জায়গা বদল করবেন। একজনের নাম বলুন,” চীন তাদের দেশের ভেতরে ও বাইরে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে ভাষণে বলেছিলেন বাইডেন। 

এসব বিষয়ে রয়টার্স ওয়াশিংটনে অবস্থিত চীন দূতা্বাসের মন্তব্য চাইলেও তারা সাড়া দেয়নি।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রও মিউনিখের বৈঠক বা বাইডেনের মন্তব্য ঘিরে চীনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে যোগাযোগের ‘খোলামেলা ও গঠনমূলক লাইন’ চালু রাখবে।

“অতীতে, যখন সম্পর্ক বড় ধরনের টালমাটাল অবস্থায় পড়েছিল, যেমনটা ১৯৮৯ সালে তিয়ানআনমেনে হত্যাযজ্ঞ কিংবা ১৯৯৫-৯৬ তে তাইওয়ান প্রণালী সংকটের সময়ে হয়েছিল, দুই দেশই সম্পর্ক ফের স্থিতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছিল।

“কিন্তু এখন সন্দেহের স্তর গভীর, তিক্ত। প্রায় সব আলোচনাতেই একে অপরের দিকে আঙ্গুল তুলে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অর্থপূর্ণ মেলামেশার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে,” বলেছেন কুইন্সি ইনস্টিটিউটের চীন বিশেষজ্ঞ মাইকেল সোয়াইন।

মার্কিন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সোমবার বলেছেন, সাই ইং-ওয়েনের পূর্বনির্ধারিত যাত্রাবিরতি সত্ত্বেও চীন যেন যোগাযোগের চ্যানেলগুলো খোলা রাখে সেজন্য বেইজিংয়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে ওয়াশিংটন।

চীন স্বশাসিত তাইওয়ানকে তার নিজের বিচ্ছিন্ন প্রদেশ দাবি করে, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে সাইয়ের যাত্রাবিরতি তাদের কাছে বেশ সংবেদনশীল বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হবে।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, তারা শি-বাইডেন ফোনালাপ কিংবা বেলুনকাণ্ডের সময় স্থগিত হওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেনের চীন সফরের সময়সূচি পুনঃনির্ধারণ, যে কোনো বিষয়ে চীনের সম্মতির অপেক্ষায় আছেন।  

চীন, তাইওয়ান ও মঙ্গোলিয়া বিষয়ক মার্কিন উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিক ওয়াটার্স এখন চীনে অবস্থান করছেন, সেখানে তিনি ব্লিনকেনের সফরের ভিত গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে তার পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত একজন রয়টার্সকে জানিয়েছেন।

আত্মবিশ্বাসী চীন

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের চীন সংক্রান্ত সিলেক্ট কমিটির রিপাবলিকান চেয়ারম্যান মাইক গালাহারের মতো অনেকে আবার বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ চান।

তাদের ভাষ্য, চীন ও রাশিয়া এরই মধ্যে ‘নতুন স্নায়ু ‍যুদ্ধে’ জড়িয়ে গেছে।

চীন যেন রাশিয়ার ইউক্রেইন অভিযানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাইওয়ানে আক্রমণ করে না বসে, তা নিশ্চিতে ওয়াশিংটনের উচিত ‘আগ্রাসী হয়ে তাইওয়ানে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র বিক্রিতে থাকা সব বাধা তুলে নেওয়া এবং স্বশাসিত দ্বীপটির গণতন্ত্র গিলে খেতে শি জিনপিংয়ের যে উচ্চাশা তা প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি যে সক্ষম তা নিশ্চিত করা’, বলেছেন গালাহার।

তবে শি-র সঙ্গে ফোনালাপে বাইডেন এখন চীনের প্রেসিডেন্টকে বেশ সাহসী আর শক্তিশালী অবস্থানেই দেখতে পেতে পারেন, কেননা ইতিমধ্যেই তিনি সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করে ফেলেছেন, পুতিনের সঙ্গে বৈঠকও সেরেছেন।

যে কারণে শি-র ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকতে পারে, যে ‘ছাড়’ শুভেচ্ছা প্রকাশে অত্যন্ত জরুরি, বলেছেন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ফেলো লিলি ম্যাকএলি।

বারাক ওবামা আমলে পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করা ডেনিয়েল রাসেল বলেছেন, বাইডেন-শি ফোনালাপের জানালা ‘খুলতে দেরি হতে পারে এবং দ্রুতই বন্ধ হয়ে যেতে পারে’, কেননা কোয়াড দেশগুলোর সঙ্গে এবং জি-৭ এর বৈঠক করতে বাইডেন মে মাসে জাপান ও অস্ট্রেলিয়া সফর করবেন; এইসব জোটের মাধ্যমে ওয়াশিংটন চীনের আকাঙ্ক্ষা মোকাবেলায় অন্যদের সামনে এগিয়ে আসার উৎসাহ যুগিয়ে আসছে ।

ওই সফর চীনকে আরও তাঁতিয়ে দেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে, বলেছেন রাসেল।

আরও পড়ুন:

Also Read: যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজকে তাড়ানোর দাবি চীনের

Also Read: চীনের ইউক্রেইন শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র