চীনের ইউক্রেইন শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে শঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র

মার্কিন কর্মকর্তারা শুরু থেকেই চীনের ওই শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে তাদের গভীর সন্দেহের কথা প্রকাশ্যেই বলে এসেছেন।

নিউজ ডেস্ক
Published : 23 March 2023, 11:13 AM
Updated : 23 March 2023, 11:13 AM

ইউক্রেইনের জন্য যে শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে রাশিয়া ও চীন আলোচনা করছে, যুক্তরাষ্ট্র তাকে অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করলেও মস্কোতে শি জিনপিং আর ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনকে অস্বস্তিকর এক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা শুরু থেকেই চীনের ওই শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে তাদের গভীর সন্দেহের কথা প্রকাশ্যেই বলে এসেছেন; শান্তি প্রস্তাবটিতে যে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হচ্ছে, তা অধিকৃত ভূখণ্ডে রাশিয়ার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করার মাধ্যমে মস্কোকে পুরষ্কৃত করবে বলে অভিযোগ তাদের।

ব্লুমবার্গ নিউজ জানিয়েছে, মস্কোর বৈঠক আর বেইজিংয়ের শান্তি প্রস্তাব বাইডেন প্রশাসনের ভেতর অস্বস্তির অনুভূতি উসকে দেওয়ার পাশাপাশি দুই প্রতিপক্ষের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্রান্ত নানা প্রশ্নে ভেতরে ভেতরে আলোচনার সূচনা ঘটিয়েছে।

অভ্যন্তরীণ বিষয় বাইরে আলোচনা করছে, এমন ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হতে না চাওয়া পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বাইডেন প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, চীনের শান্তি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে এক কোনায় ঠেলে দিতে পারে, ওয়াশিংটনের এমন আশঙ্কা আছে।

আপত্তি থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র যদি ওই প্রস্তাব পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে চীন যুদ্ধ নিয়ে ক্লান্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির শিকার দেশগুলোর কাছে ওয়াশিংটন শান্তিতে আগ্রহী নয় এমন যুক্তি তুলে ধরতে পারে।

“যুক্তরাষ্ট্র যদি এই শান্তিচুক্তির প্রস্তাবে পদাঘাত করে, তাহলে চীন এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে, তার মানে যুদ্ধ শেষ হোক যুক্তরাষ্ট্র এটা চায় না।

“চীন-রাশিয়ার বৈঠক থেকে যা-ই আসুক না কেন, তার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে ঋণাত্মকভাবে উপস্থাপনের অসংখ্য উপায় আছে চীনের হাতে,” বলেছেন পেন্টাগনের সাবেক কর্মী, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ফেলো বনি লিন।

শান্তি পরিকল্পনার চীনা সংস্করণ নিয়ে বিতর্ক চলতি সপ্তাহে মস্কোতে শি-র তিন দিনের সফরে সৃষ্ট অনেক অস্বস্তিকর বাস্তবতার একটিকে সামনে নিয়ে এসেছে।

এই সফরে চীনের নেতাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে দেখা গেছে পুতিনকে। দুই দেশ তাদের অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করার অঙ্গীকার করেছে।

ব্লুমবার্গ বলছে, ইউক্রেইন যুদ্ধের শুরু থেকেই বাইডেন প্রশাসন চীনকে সাইডলাইনে রাখার চেষ্টা করে গেছে, আদতে তার উল্টোটাই ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

এমনকী শি আর পুতিনের ঘনিষ্ঠতার মধ্যেও চীন বিশ্বজুড়ে তাদের বিস্তৃত কূটনৈতিক উদ্যোগের মধ্যে গ্রহণযোগ্য শ্রোতা খুঁজে পাচ্ছে।

বুধবার সেনেটের এক শুনানিতে ওরেগনের ডেমোক্র্যাট সেনেটর জেফ মার্কলে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ‘কর্তৃত্ববাদী শক্তির উদ্‌যাপনে পুতিন ও শি-র তিনদিনের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ উৎসব’ সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ব্লিনকেন বলেন, এই সফর মূলত যুদ্ধের আগে দুই দেশ যে ‘সীমাহীন অংশীদারিত্বের’ অঙ্গীকার করেছিল, তারই ধারাবাহিকতা।

“এটা মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। উভয় দেশেরই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেয়ে আলাদা। আমরা এবং বিশ্বের অনেক দেশ যে প্রতিরক্ষা ও অগ্রগতির আকাঙ্ক্ষা বিষয়ক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি তার বিরোধিতার ক্ষেত্রে হয়তো তাদের একই ধরনের কারণ থাকতে পারে,” বলেছেন ব্লিনকেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান সত্ত্বেও যেসব দেশ কোনো পক্ষ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ব্লিনকেন তাদের নাম উল্লেখ করেননি।

রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করা চীনা কোম্পানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে পাত্তাই দিচ্ছে না চীন, পশ্চিমাদের আকাঙ্ক্ষাকে পায়ে দলে ইরান থেকে তেল কিনছে; সৌদি আরব ও ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্কের বরফ গলাতে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলো চীন ও পশ্চিমের মধ্যে যে কোনো এক পক্ষ বেছে নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে; বলছে, তারা আর নতুন স্নায়ু যুদ্ধ চায় না।

সপ্তাহখানেক আগে হন্ডুরাসও তাইওয়ানের হাত ছেড়ে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করেছে।

“এই পদক্ষেপ সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এবং বিশ্বের দেশগুলির সাথে সামঞ্জস্য রেখে অবাধে সীমান্ত প্রসারিত করার আমার সংকল্পের একটি নিদর্শন,” টুইটে এমনটাই বলেছেন হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট সিওমারা কাস্ত্রো।

এসবই হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছে, যা শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আমলের বাণিজ্য যুদ্ধ থেকে। সর্বশেষ চীনা গোয়েন্দা বেলুনকাণ্ডে দুই দেশের ক্রুদ্ধ বাদানুবাদও ওয়াশিংটন-বেইজিং সম্পর্কের তিক্ততাকেই প্রকাশ করেছে।

এই উত্তেজনা, সম্পর্ক স্থিতিশীল করার চেষ্টায় গত বছরের শেষদিকে ইন্দোনেশিয়ায় বাইডেন আর শি-র মধ্যে হওয়া মুখোমুখি বৈঠকের অর্জন ম্লান করে দেয়। এ বছর মিউনিখে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ও শীর্ষ চীনা কূটনীতিক ওয়াং ই-র মধ্যে এক উত্তেজনাপূর্ণ বৈঠকও হয়। পরে শি ‘যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ও দমন’ নিয়ে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন।

মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, বেইজিংকে তারা যেসব কড়া কড়া কথা বলছেন, তা প্রভাব ফেলছে।

রাশিয়াকে মারণাস্ত্র সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে চীনকে প্রকাশ্যে একের পর এক সতর্কবার্তা দেওয়ায় শি-র সরকারকে এখন এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ভাবতে হচ্ছে। এদিকে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু ইউক্রেইনকে অস্ত্র সরবরাহ করেই যাচ্ছে। চলতি সপ্তাহেই তারা কিইভকে ৩২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের যুদ্ধাস্ত্র সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। 

ইউক্রেইন সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক করে দেওয়া শর্তে চীনের মুখোমুখি হতে চেষ্টা করেছিল বাইডেন প্রশাসন, কিন্তু শি এখন তার ঠিক করা শর্ত নিয়েই মাঠে নেমে পড়েছেন। এটাই সম্ভবত বাইডেন প্রশাসনকে খানিকটা আতঙ্কিত করে তুলেছে, বলেছেন রাজনৈতিক ঝুঁকি বিষয়ক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চায়না স্ট্র্যাটেজিস গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টোফার কে জনসন। 

এদিকে ওয়াশিংটনও বেইজিংয়ের ব্যাপারে নিয়মিতই কট্টর লাইনে হাঁটছে, যে কারণে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শিগগিরই সম্পর্ক ভালো করার আশা ছেড়ে দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

“যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ যত কম দেখবে চীন, ততই অন্য পথ ধরে, বিকল্প উপায়ে কাজ হাসিলের দিকে ঝুঁকবে তারা। এর অর্থ হচ্ছে, অনেক উপায়ে ও জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করবে তারা,” বলেছেন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক ফেলো মেলানি সিসন।